নববর্ষে মহাকাশ ভ্রমণ

গ্রিক দেবী আরটেমিস ছিলেন সতীসাধ্বী এক শিকারি। তাঁর একান্ত অনুসারী ক্যালিস্টোর প্রেমে পড়েন গ্রিক দেবতাদের রাজা জিউস। জন্ম নেয় তাঁদের সন্তান আরকাস। বিষয়টা জানতে পেরে জিউসের স্ত্রী, গ্রিক দেবকুলের রানি হেরা রেগে গিয়ে অভিশাপ দেন। ক্যালিস্টো হয়ে যান ভল্লুক। তিনি মহাকাশে তারার বনে ঘুরে বেড়াতে থাকেন। একদিন সেই ভল্লুক তাঁর সন্তান আরকাসকে দেখে মাতৃস্নেহে আপ্লুত হন। তিনি ছেলেকে কোলে তুলে নিতে এগিয়ে যান। পেছনের দুই পায়ের ওপর দাঁড়িয়ে দুই হাত বাড়িয়ে দেন। কিন্তু আরকাস তো মাকে চেনে না। সে আক্রান্ত হওয়ার ভয়ে আত্মরক্ষার জন্য তির-ধনুক নিয়ে তৈরি হয়। স্বর্গরাজ্য থেকে দেবরাজ জিউস এটা দেখে তাঁদের সন্তান আরকাসকে ছোট ভল্লুকে পরিণত করেন এবং মহাকাশে তার মায়ের পাশে স্থাপন করেন। সেই থেকে দুই ভল্লুক উত্তর আকাশে ধ্রুবতারাকে কেন্দ্র করে সারা বছর ঘুরছে। ইংরেজিতে একে বলে গ্রেট বিয়ার। বাংলায় সপ্তর্ষিমণ্ডল। পৃথিবী থেকে এই সপ্তর্ষিমণ্ডলকে সব সময় দেখা যায়। এর কোনো উদয়াস্ত নেই।

বৈশাখের প্রথম দিনে, নববর্ষের সন্ধ্যায় চলো না যাই মহাকাশ ঘুরে আসি! দেখে আসি সেই মা ও ছেলেকে। পৃথিবী থেকে মঙ্গল গ্রহে তো মানুষ যাচ্ছে। চারজনের মধ্যে রয়েছেন বাঙালি নারী লুলু ফেরদৌস। ওরা যাবেন ২০২২ সালে। তার আগেই যদি আমরা মহাকাশটা একটু ঘুরে আসি!

লুলু ফেরদৌসরা মঙ্গল গ্রহে গিয়ে বসতি গড়বেন। এটা কি সম্ভব? হ্যাঁ, খুবই সম্ভব। তবে একটু সময় লাগবে। এই মুহূর্তে সেটা সম্ভব নয়। কারণ, সেখানে অক্সিজেন নেই। কিন্তু মঙ্গল অভিবাসী চারজন যদি বংশপরম্পরায় সেখানে অন্তত শ খানেক বছর টিকে থাকতে পারে, তাহলে পৃথিবীর মতোই শস্য-শ্যামলে সুশোভিত করে তোলা যাবে মঙ্গল গ্রহকেও। এ জন্য সেখানে দরকার বনায়ন। কিন্তু পানি ছাড়া তো বনায়ন হবে না। মঙ্গল গ্রহে পানি নেই, আছে জমাটবাঁধা বরফ। ওই বরফ গলাতে হলে দরকার গ্রিনহাউস গ্যাস। আমাদের পৃথিবীতে জলবায়ুর পরিবর্তনের ফলে বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির যে প্রক্রিয়াটি আমরা থামাতে চাচ্ছি, মঙ্গল গ্রহে সেই প্রক্রিয়া জোরেশোরে চালাতে হবে। এ জন্য রাসায়নিক পদার্থ ব্যবহার করা হবে। তাপমাত্রা বাড়াতে পারলে আরও বরফ গলে পানি তৈরি হবে। পানির ব্যবস্থা হলে মঙ্গলের মাটিতে গাছ লাগানো যাবে, যা বায়ুমণ্ডলের কার্বন ডাই-অক্সাইড শুষে নিয়ে অক্সিজেন বিমুক্ত করবে। তখনই কেবল মানুষ মঙ্গলে বসবাসের উপযুক্ত পরিবেশ পাবে।  নিউইয়র্ক টাইমস -এর বিজ্ঞান সাময়িকীতে (১১ ডিসেম্বর, ২০১২) বিষয়টি বিশদভাবে ব্যাখ্যা করা হয়েছে।

তার মানে শ খানেক বছরের আগে মানুষ মহাকাশে বসতি গড়তে পারছে না। তার আগেই তাহলে চলো আমরা যাই তারার রাজ্যে। একটু অন্যভাবে। শহর থেকে একটু বাইরে যেতে হবে। পরিষ্কার নীল আকাশজুড়ে সেখানে তারার মেলা।  

রাজধানী ঢাকার ঝলমলে আলো আর ধুলাবালুর জন্য এই দিগন্ত বিস্তৃত আকাশভরা তারা খুব কমই চোখে পড়ে। খোলা প্রান্তরে দাঁড়িয়ে উত্তর আকাশে একটু উঁচুতে তাকালে কাছাকাছি সাতটি তারা দেখা যাবে। দেখতে হাতলওয়ালা সসপ্যান বা বাটির মতো একটি পাত্র। আকাশে উপুড় হয়ে আছে। মনে হবে ওই বিশেষ অবস্থানে থেকে সে পৃথিবীর গাছে গাছে বসন্তের ফুল ফোটানোর জন্য পাত্রে জমানো পানি উপুড় করে ঢেলে দিচ্ছে। একে অবশ্য একটি প্রশ্নবোধক চিহ্ন হিসেবেও কল্পনা করা যায়। এই সাতটি তারার সমন্বয়ে গঠিত তারকাপুঞ্জই হলো সপ্তর্ষিমণ্ডল।

এই তারাগুলোর আশপাশের আরও কয়েকটি তারার সম্মিলনে একটি বড় ভল্লুকের ছবি কল্পনা করা যাবে। এ জন্য ইংরেজিতে সপ্তর্ষিমণ্ডলকে বলা হয় ‘গ্রেট বিয়ার’ বা বড় ভল্লুক। ল্যাটিন ভাষায় একে বলা হয় ‘উরসা মেজর’। উরসা অর্থ স্ত্রী ভল্লুক বা ভল্লুকি। সপ্তর্ষির আরেকটি নাম ‘বিগ ডিপার’। ডিপার অর্থ পানি পানের জন্য ব্যবহৃত হাতাওয়ালা বাটি। এর চারটি তারা বাটির মতো বাঁকানো ও তিনটি তারা দিয়ে তৈরি হাতল।

প্রাচীনকাল থেকে সপ্তর্ষিমণ্ডলের প্রতি মানুষের প্রবল আগ্রহ। কারণ, এর বাটির আকৃতির দিকের শেষ প্রান্তের তারা দুটির সংযোজক কল্পিত রেখা বরাবর রয়েছে ধ্রুবতারা। একে দেখার জন্য ওই কল্পিত রেখাকে বাড়িয়ে দিয়ে আনুমানিক ছয় গুণ দূরে চোখ রাখতে হবে। দেখা যাবে উজ্জ্বল একটি তারা। এটাই সেই ধ্রুবতারা, যা সব সময় পৃথিবীর ঠিক উত্তর মেরু বরাবর থাকে। শীত-গ্রীষ্ম-বর্ষায় এর অবস্থানের কোনো নড়চড় হয় না। প্রাচীনকালে কম্পাস ছিল না, তখন নাবিকেরা রাতের আকাশে ধ্রুবতারা দেখে দিক ঠিক করতে পারতেন।

হিন্দু পুরাণে বর্ণিত সাতজন ঋষির নামে সপ্তর্ষিমণ্ডলের সাতটি তারার নামকরণ হয়েছে। তাঁরা হলেন মরীচি, অত্রি, অঙ্গিরা, পুলস্ত্য, পুলহ, ত্রুতু ও বশিষ্ঠ। নামটি ভেঙে বললে  দাঁড়ায়, সাত যে ঋষি=সপ্তর্ষি, কর্মধারয় সমাস।

সপ্তর্ষিমণ্ডল সব সময় ধ্রুবতারাকে কেন্দ্র করে ঘুরছে। একেক ঋতুতে এর অবস্থান একেক রকম। নববর্ষের সন্ধ্যায়, বসন্তের শেষে একে দেখা যাবে উত্তর আকাশে অনেকটা ওপরের দিকে। ঊর্ধ্বাকাশে। বসন্তের পর আসে গ্রীষ্ম। এ সময় সপ্তর্ষি ঘুরে ধ্রুবতারার এক পাশে চলে আসে। একে সসপ্যান হিসেবে কল্পনা করলে মনে হয়, সে তার পাত্রে ঠান্ডা পানি সংগ্রহ করছে। শরৎকালে পাত্রটি ওপরমুখী হয়ে ধ্রুবতারার নিচে অবস্থান নেয়। যেন গাছের ঝরা পাতাগুলো সংগ্রহ করছে। আর শীতকালে তার হাতলটি ঝুলে থাকে নিচের দিকে, যেন ঠান্ডায় জমে যাওয়া তুষারখণ্ড।

ধ্রুবতারাকে ঘিরে রয়েছে আরেকটি তারকাপুঞ্জ। এর নাম ‘উরসা মাইনর’ বা ছোট ভল্লুক। এর আকৃতি অবশ্য ঠিক ভল্লুকের মতো করে কল্পনা করা কঠিন। বলা যায় হাতলওয়ালা একটি পাত্র। এর তারাগুলো অনুজ্জ্বল। শুধু পাত্রের শেষ প্রান্তের তারা দুটি বেশ উজ্জ্বল। এ দুটি তারাকে বলা হয় ধ্রুবতারার অভিভাবক। কারণ, ওরা সব সময় ধ্রুবতারাকে যেন পাহারা দেয়।

ধ্রুবতারার অবস্থান পৃথিবীর উত্তর দিক নির্দেশ করে বলে ধরা হয়। অবশ্য এটা একটু পাশে, পৃথিবীর ধ্রুব অক্ষ (পোলার এক্সিস) থেকে মাত্র কৌণিক এক ডিগ্রি দূরে।

আকাশে ধ্রুবতারার অবস্থান স্থির বললে ভুল হবে। আসলে এটি আপেক্ষিকভাবে স্থির। পৃথিবীর অক্ষরেখা ধীরগতিতে একটি বৃত্তাকার পথে তার অভিমুখ পরিবর্তন করছে। প্রায় ২৬ হাজার বছরে পৃথিবীর উত্তর মেরু বৃত্তাকার পথ পরিভ্রমণ করে আবার আগের জায়গায় ফিরে আসে। এ কারণে অনেক বছর পর ধ্রুবতারা বদলে যায়। দার্শনিক প্লেটোর সময়, আজ থেকে প্রায় দুই হাজার ৪০০ বছর আগে উরসুলা মাইনরের সবচেয়ে উজ্জ্বল তারাটি ছিল ধ্রুবতারা। বর্তমান ধ্রুবতারা পোলারিস আরও অনেক বছর এই অবস্থানে থাকবে। প্রায় ২২ হাজার বছর পর ড্রাকো মণ্ডলীর থুর্বান নামের তারাটি ধ্রুবতারার স্থানে আসবে।