ওষুধেই স্বাস্থ্যঝুঁকি!

‘প্রত্যেক ওষুধই বিষ’ ওষুধ বিজ্ঞানের পাঠ্যপুস্তকে এই ভাবেই শুরু করা হয়েছে। পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াবিহীন কোনো ওষুধ নেই, তা সে আমরা মাথাব্যথার জন্য প্যারাসিটামল অথবা পেপটিক আলসারের সমস্যার জন্য রেনিটিডিন, ওমিপ্রাজল অথবা বিভিন্ন প্রকারের অ্যান্টিবায়োটিক যা-ই খাই না কেন। নিয়ন্ত্রিত মাত্রা ও প্রকৃত প্রয়োজনভিত্তিক ওষুধ না খেলে জীবন রক্ষার উপাদানটি বিনাশী বিষে রূপান্তরিত হতে সময় নিবে না মোটেও। কিন্তু এই বিষয়টি নিয়ে আমরা আশ্চর্য রকম নির্লিপ্ত। চিকিৎসক, রোগী, ওষুধ বিক্রেতা, সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ সকলেই এই ক্ষেত্রে উদাসীন। আর এর মাধ্যমে ধীরে ধীরে মারাত্মক স্বাস্থ্যসংকটের মুখে পড়তে যাচ্ছি।

কিছু উদাহরণ টানছি। প্রায়ই জ্বর, সর্দি, কাশি, ডায়রিয়াজনিত অসুস্থতায় আক্রান্ত রোগী পাওয়া যায়। অনেক ক্ষেত্রেই যেখানে ব্যাকটেরিয়া জাতীয় জীবাণুর সংক্রমণ থাকে না। কখনো অ্যালার্জি, কখনো ভাইরাস সংক্রমণ বা কখনো বদহজম বা অন্ত্রের জন্য যন্ত্রণাদায়ক খাদ্য উপাদান এই ধরনের অসুস্থতার জন্য দায়ী। উল্লিখিত কারণ সমূহের ক্ষেত্রে অ্যান্টিবায়োটিকের কোনো ভূমিকাই নেই। সাধারণ সর্দিজ্বর হলে প্যারাসিটামল এবং অ্যান্টি হিস্টামিন খেলেই চলে। আবার অনেক ডায়রিয়া ২-৩ দিনে স্বাভাবিক নিয়মে ভালো হয়ে যায়, শুধু লক্ষ রাখতে হয় যেন পানিশূন্যতা তৈরি না হয়। এ জন্য প্রয়োজনমতো খাবার স্যালাইন খেলেই চলে। অন্য ওষুধের খুব একটা ভূমিকা নেই। কিন্তু এই ঘটনাগুলোর ক্ষেত্রে অভিজ্ঞতায় দেখেছি রোগীরা সরাসরি চলে যান ওষুধ বিক্রেতার কাছে। বিক্রেতা রোগীকে অ্যান্টিবায়োটিক গছিয়ে দেন।

কোনো কিছুর আঘাতে ব্যথা পেয়ে (কোনো ক্ষত চিহ্ন ছাড়া) ওষুধ বিক্রেতার শরণাপন্ন হলেও অ্যান্টিবায়োটিক দেওয়া হয়। রোগী চিকিৎসকের খরচ বাঁচাতে গিয়ে একগাদা অপ্রয়োজনীয় ওষুধ খেতে বাধ্য হচ্ছেন। মোট খরচ কিন্তু প্রকারান্তরে বেশিই হয়। অনেক ক্ষেত্রে চিকিৎসকেরাও অপ্রয়োজনে অ্যান্টিবায়োটিক দিয়ে থাকেন রোগীর আস্থা আর মানসিক শান্তির জন্য। নতুবা রোগী অন্য চিকিৎসকের কাছে চলে যেতে পারেন অথবা চিকিৎসক নিজেই যখন রোগ নিরূপণ আস্থাহীন তখন অনুমানভিত্তিক অ্যান্টিবায়োটিক নির্ভর চিকিৎসা শুরু করেন। আবার অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায় রোগী চিকিৎসকের কাছে গিয়েছেন ঠিকই, চিকিৎসক ও উপযুক্ত অ্যান্টিবায়োটিক দিয়েছেন। ধরা যাক সাত দিনের জন্য, তিন দিন পরে রোগীর উপসর্গ বিদায় নিল, আর রোগীও তাঁর ওষুধ পূর্ণমেয়াদে গ্রহণ করলেন না। এ ছাড়া প্রায়ই গ্রাম্য ও হাতুড়ে চিকিৎসকের কাছে তাঁরা নিশ্চিত সাফল্যের জন্য সাধারণ অসুস্থতায় উচ্চমাত্রায় অ্যান্টিবায়োটিক প্রয়োগ করেন। কোনো কোনো ক্ষেত্রে রোগী সুস্থও হয়।

ওপরের প্রতিটি ঘটনাই নগদ লাভের মানসিকতা থেকে ঘটছে। কিন্তু বিপদের কথা হলো এই প্রতিটি ঘটনাই বর্তমান ও ভবিষ্যৎ মানবজাতিকে ভয়াবহ বিপদের মুখে ঠেলে দিচ্ছে। অ্যান্টিবায়োটিক জীবাণুকে ধ্বংস করতে ব্যবহার করা হয়, আবার জীবাণুও সতত প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে বিরূপ পরিস্থিতিতে নিজেকে টিকিয়ে রাখার। এখন যদি অপ্রয়োজনে, অসম্পূর্ণ মেয়াদে, নিম্নমাত্রায় অথবা ভুল অ্যান্টিবায়োটিক রোগী গ্রহণ করেন তখন ক্ষতিকর ব্যাকটেরিয়া খুব দ্রুত নিজেদের অভিযোজিত করে ফেলে। তাদের জেনেটিক মিউটেশন ঘটিয়ে সেই অ্যান্টিবায়োটিকের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ ক্ষমতা অর্জন করে। ব্যাকটেরিয়া যেহেতু খুব অল্পসময়ে (প্রায় ২০ মিনিটে) নিজেদের সংখ্যা দ্বিগুণ করতে পারে তাই এই নতুন অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধী ব্যাকটেরিয়া স্বল্প সময়ে নতুন প্রতিরোধী প্রজন্ম প্রজনন করে। ফলাফল পরবর্তীতে সেই প্রজাতিকে অ্যান্টিবায়োটিক প্রয়োগে ঘায়েল করতে পারার অপারগতা। পাঠক এখন চিন্তা করুন যদি সব ব্যাকটেরিয়া এভাবে নিজেদের অভিযোজিত করে নিতে পারে আমাদের স্বাস্থ্যঝুঁকি কী ভয়াবহ অবস্থায় পতিত হবে! বর্তমানে বাংলাদেশে ওষুধ প্রতিরোধী যক্ষ্মা এই অবস্থার এক ভয়াবহ ইঙ্গিত দিচ্ছে। হৃদ্রোগ, উচ্চ রক্তচাপ বা ডায়াবেটিস এই ধরনের অসুস্থতায় অপচিকিৎসা (চিকিৎসক বা রোগী পর্যায়ে) শারীরিকভাবে ভুক্তভোগী হবেন শুধু রোগী কিন্তু অ্যান্টিবায়োটিকের অকার্যকারিতায় পুরো সমাজ আক্রান্ত হবে। সে জন্যই অ্যান্টিবায়োটিককে বলা হয় সোশ্যাল ড্রাগ। সবাই যত তাড়াতাড়ি সম্ভাব্য এই ভয়াবহ স্বাস্থ্যঝুঁকি সম্পর্কে সচেতন হবেন তত কম ক্ষতি হবে আমাদের। আমরা অনেকেই কোনো রকম বাছবিচার ছাড়াই ব্যথানাশক ওষুধ অনির্দিষ্টকাল পর্যন্ত সেবন করি, অনেক সময় দোকান থেকে নিজেরাই কিনে নিচ্ছি চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়াই। দীর্ঘমেয়াদি ব্যথানাশক সেবন কিডনি নষ্ট হওয়ার অনেকগুলো কারণের মধ্যে অন্যতম। মোটা হওয়ার আকাঙ্ক্ষায় অনেকে স্টেরয়েড জাতীয় ওষুধ সেবন করেন। সরাসরি ওষুধ বিক্রেতার পরামর্শে, যা আমাদের আরেক ধরনের মারাত্মক স্বাস্থ্য সমস্যার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। শরীরে পানি জমে যাওয়া, উচ্চ রক্তচাপ, হৃদ্রোগের উচ্চ ঝুঁকি, হাড় ক্ষয়প্রাপ্ত হওয়া, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যাওয়া ইত্যাদি ধরনের সমস্যা সামনে এসে দাঁড়ায় অযৌক্তিক স্টেরয়েড সেবনের ফলে। এসব হলো আমাদের নির্বিচার ওষুধ সেবনের ফলে উদ্ভূত স্বাস্থ্য সমস্যার সামান্য উদাহরণমাত্র। প্রকৃত চিত্র আরও মারাত্মক। তাই আমাদের নিজেদের স্বার্থে নির্বিচারে চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া ওষুধ সেবন বন্ধ করতে হবে এখনই।

লেখক: সাবেক শিক্ষক ফার্মাকোলজি বিভাগ, চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ।