আসক্ত হওয়া সহজ বেরিয়ে আসা কঠিন : জিনাত রেজা খান

জিনাত রেজা খান বড় হয়েছেন সংযুক্ত আরব আমিরাতের দুবাইয়ে। ১৯৮৪ সালে বাবা প্রাণিবিজ্ঞানী ড. রেজা খানের সঙ্গে চলে গিয়েছিলেন আবুধাবির আল–আইনে। ১৯৮৯ সাল থেকে আছেন দুবাইতে। সেখানে স্কুল–কলেজে পড়েছেন। কম্পিউটার বিজ্ঞান ও প্রকৌশল বিষয়ে পড়াশোনা করেছেন। অস্ট্রেলিয়ার ইউনিভার্সিটি অব ওলংগং থেকে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেছেন। তাঁর পিএইচডি গবেষণার বিষয় ছিল তথ্যপ্রযুক্তি (আইটি) নৈতিকতা। ২০০১ সাল থেকে ইউনিভার্সিটি অব ওলংগং ইন দুবাইয়ে শিক্ষকতা করছেন তিনি। বিশ্ববিদ্যালয়টির সহকারী অধ্যাপক জিনাত রেজা খান এখন ইন্টারনেট নৈতিকতা বিষয়টি পড়ান এবং এ নিয়ে গবেষণা করে যাচ্ছেন।
সম্প্রতি জিনাত রেজা খান এসেছিলেন ঢাকায়। গত ২৯ আগস্ট প্রথম আলো কার্যালয়ে তিনি কথা বলেন অধুনার সঙ্গে। তাঁর কথায় উঠে এসেছে সাইবার জগতের ঝুঁকি, ইন্টারনেট আসক্তি, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে হয়রানি, প্রতারণার মতো বিষয় এবং এসব ব্যাপারে সচেতন হওয়ার উপায়গুলো। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন: তৌহিদা শিরোপা

জিনাত রেজা খান। ছবি: আশরাফুল অালম
জিনাত রেজা খান। ছবি: আশরাফুল অালম

তথ্যপ্রযুক্তি বা ইন্টারনেট নৈতিকতা বিষয়টি পড়ানোর আগ্রহ কীভাবে জন্মাল?
জিনাত রেজা খান: আমি যখন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ানো শুরু করি, অনেকে বলতেন ছাত্ররা চিটিং করে। আমার ধারণা ছিল, বাচ্চারা (শিক্ষার্থী) হয়তো চিটিং করে না। কিন্তু দেখলাম, কোনো আলোচনায় যেকোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের সব শিক্ষকই একই সমস্যার কথা বলেন যে স্টুডেন্টরা এত চিটিং করে কেন? এটা মনে হয় প্রযুক্তির কারণে হচ্ছে বেশি। ইন্টারনেট এসে নষ্ট হয়ে গেছে সব।
তখন আমি চিন্তা করি, আমার একটু দেখা উচিত ব্যাপারটা কী। তখন সাইবার এথিকস ধারণাটি চলে আসে। ওখান থেকেই ২০০৫ সালে আমার গবেষণা শুরু হয়। আমি তখন শিক্ষার্থী ও বাচ্চারা যে প্রযুক্তি ব্যবহার করছে, দেখি সেসবে সমস্যা রয়ে গেছে। বাচ্চারা ই-মেইল অ্যাকাউন্ট খুলে ফেলছে, ই-মেইল করছে। কিন্তু বাবা-মা বুঝতে পারছেন না যে কী হচ্ছে, তাঁদের সন্তান কাকে ই–মেইল করছে, কী পাঠাচ্ছে—তা তারা জানেন না। তখন ওটা নিয়ে কাজ শুরু করলাম। তারপর ২০০৮ থেকে একটা বিষয় আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে চালু হলো। সেটা সাইবার নৈতিকতা, এথিকস অ্যান্ড ইনফরমেশন। এই বিষয়টা তাঁরা আমাকে পড়াতে দিলেন। আমার গবেষণাও চলছিল একই বিষয়ে। এটি পড়াতে গিয়ে আমি অনেক কিছু শিখেছি। যুক্তরাষ্ট্রে যা হচ্ছে, তা এখানেও হচ্ছে কি না? শিক্ষার্থীদের সঙ্গে যখন কথা বলি, ওরা বলে, হ্যাঁ, এ রকম শুনেছি, আমার বন্ধু সাইবার বুলিংয়ের শিকার হয়েছে বা আমার বন্ধুকে সাইবার স্টক (অনলাইনে কারো প্রোফাইল নিয়মিত ঘাঁটাঘাটি করা এবং হয়রানি করা) করা হয়। আবার এ–ও শুনলাম, একজনের আইডি আরেকজন নিয়ে নিয়েছে বা একজনের একটা ভুয়া অ্যাকাউন্ট বানিয়ে অন্যদের হুমকি দিয়েছে।
এসব যখন শুনলাম, তখন বুঝলাম এগুলো তো অনেক বড় সমস্যা। এই বিষয়ে প্রতি সেমিস্টারে ছাত্রছাত্রী হয় ১০০ থেকে ২০০ জন। তাদের সঙ্গে যখন আলোচনা করি, তারা থ মেরে যায়। বলে, ‘আমরা তো এগুলা জানতাম না’, ‘কেউ তো এগুলো বলছে না’, ‘আমাদের বাবা-মায়েরাও তো এসব জানেন না’। তাদের এই কথা থেকে আমি বুঝতাম যে এখানে অবশ্যই একটা চাহিদা আছে। মানুষের সঙ্গে দরকার আছে কথা বলার। তিন–চার বছর আগে থেকে আমরা প্রচারণা শুরু করলাম। আমাদের বিপণন ও ইভেন্টস দলের মাধ্যমে বিভিন্ন স্কুলে যাওয়া শুরু করলাম। এখন আমরা নিয়মিত স্কুলে যাই, প্রাথমিক, মাধ্যমিক বা ইউনিভার্সিটি স্তরের প্রত্যেকের সঙ্গে আমরা কথা বলি। এখানে ডিপেন্ড করে যে ফরম্যাটটা কী?

আমাদের দেশের মতো ইন্টারেনেটে নতুন কিন্তু ব্যবহারকারীর সংখ্যা দ্রুত বেড়ে যাওয়া দেশগুলোতে তথ্যপ্রযুক্তি নৈতিকতা বিষয় কতটা জরুরি?
জিনাত রেজা খান: প্রযুক্তি এখন যা চলে এসেছে, তা নিয়ে ভাবলেই চলবে, ২০ বছর পর যা আসবে তা নিয়ে এখন না চিন্তা করলেও হবে—ব্যাপারটা কিন্তু এ রকম নয়। যদিও এটা নতুন ইন্ডাস্ট্রি। কিন্তু সমস্যা সব এখানে এসে পড়বে। এরই মধ্যে অনেক সমস্যা এসে পড়েছে। যেহেতু সংযোগ (ইন্টারনেট) রয়েছে বিশ্বব্যাপী, তাই এটা সীমান্তহীন (বর্ডারলেস) সমস্যা। এটা শুধু আমেরিকা বা অন্য কোনো দেশের সমস্যা নয়, বরং যেখানে ইন্টারনেট যাবে, যেখানে আপনার সংযোগ হবে, যন্ত্র যাবে, শিশু–কিশোরেরা যন্ত্র ব্যবহার করবে—সেখানেই এ সমস্যাগুলো দেখা দেবে। যদি কেউ বলে যে আমরা এখনো নতুন, ডিজিটাল বাংলাদেশ মোটে শুরু হয়েছে, প্রচারণায় অনেক সময় লাগবে—তবে তা ভুল। গত সপ্তাহে আমি চার দিন সুন্দরবন অঞ্চলে চারটা স্কুলে কাজ করেছি। সেখানকার বেশির ভাগ শিশুর হাতে মোবাইল ফোন। সেটিতে ফেসবুক যেমন রয়েছে তেমনি ওদের ফেসবুক অ্যাকাউন্টও আছে। তারা আমাকে জিজ্ঞেস করে গেছে, আপনার ফেসবুক অ্যাকাউন্ট কি আমরা ট্যাগ করব? তাই ডিজিটাল প্রযুক্তি কিন্তু দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ছে।
যাঁদের স্বল্প আয়, তাঁরাও কিন্তু চেষ্টা করেন বাচ্চাদের জন্য বাসায় যেন একটা ফোন ও ইন্টারনেট সংযোগ থাকে। প্রত্যন্ত গ্রামের স্কুলে আমি দেখে এসেছি আটটা প্রজেক্টর, আটটা ল্যাপটপ দিয়ে বাচ্চাদের পড়ানো হচ্ছে। নিজেদের ওয়েবসাইটও হয়ে গেছে। এখন যদি বলি আমরা নতুন, আমাদের অসুবিধা নেই, তা ঠিক না। আমাদের এটা নিয়ে সচেতনতা তৈরি করতে হবে। তা এখনই প্রয়োজন।

কিশোর তরুণদের মধ্যে ইন্টারনেট আসক্তি দেখা যায় এখন। অনেক মা-বাবাও এটি নিয়ে চিন্তিত। এ বিষয়ে মা-বাবাদের কী করার আছে বলে আপনি মনে করেন?
জিনাত রেজা খান: আমাদের দেশেও এখন অনেক প্যারেন্টাল সেশন হয়, যেখানে মা-বাবারা সন্তানের ইন্টারনেট ব্যবহার নিয়ে কথা বলেন। অনেকের সন্তান ইন্টারনেটে আসক্ত হয়ে পড়েছে। ইন্টারনেট ব্যবহারে মা-বাবারা আসলে কী করবেন? তাঁদের উৎসাহ দেবেন, নাকি দেবেন না?
অন্য যেকোনো আসক্তির মতো এটিও আসক্তি। এখানে যদি এটা মাদকাসক্তি হতো, অ্যালকোহল বা সিগারেট আসক্তি হতো, তখন বাবা–মা কী বলতেন, এটা জরুরি? এটা কন্টিনিউ করো! তখন তারা থামিয়ে দেবেন কিন্তু। একজন সন্তানের বাবা-মা যদি জেনে যান যে তার সন্তানের আসক্তি হয়েছে, প্রথম কাজ হলো এটা থেকে ধীরে ধীরে সরিয়ে আনা। সহজ হবে না, নাথিং ইজ ইজি। আসক্ত হওয়া সহজ, কিন্তু এ থেকে বের করে আনাটা অনেক কষ্টকর।

আপনার কোনো পরামর্শ আছে কি?
জিনাত রেজা খান: সন্তানের ইন্টারনেট ব্যবহারের অভ্যাসের সঙ্গে বাবা-মাকে একদম মিশে যেতে হবে। এরপর ধীরে ধীরে বের করে আনতে হবে। শুরুর জন্য আমি হয়তো বাচ্চাকে বলব, ‘তোমাকে ইন্টারনেট ব্যবহার করতে দেব আট ঘণ্টা। যেখানে সে সারা দিন করছে সেখানে আমি দিচ্ছি আট ঘণ্টা। এই সপ্তাহ পুরোটাই আট ঘণ্টা। পরের সপ্তাহে সাত ঘণ্টা।’ কন্ট্রোলটা বাবা–মাকে নিজের হাতে আনতে হবে। যদি বলে সে ফোনে করছে। তবে সে ডেটা প্যাকেজ কীভাবে নিচ্ছে? টাকাটা কোথা থেকে পাচ্ছে? বাবা–মায়ের কাছ থেকেই তো পাচ্ছে। তো ওইভাবে নিয়ন্ত্রণ আনতে হবে। আস্তে আস্তে। প্রথম সপ্তাহ আট ঘণ্টা, দ্বিতীয় সপ্তাহ সাত ঘণ্টা, এরপর দেখতে দেখতে এক মাসে কমিয়ে আনা যাবে। তখন এক–দুই ঘণ্টা।
যখন ইন্টারনেটে স্কুলের কাজ থাকবে তখন তার পাশে থাকতে হবে। দেখতে হবে সে গেমে চলে গেল নাকি ক্লাস প্রজেক্টের কাজে গেল। মোবাইল ফোনটা দেখা যে সে কি ফোনে টাকা ঢুকিয়ে ফেলেছে, নাকি ডেটা প্যাকেজ কিনে ফেলেছে। এখন ৯০ টাকা দিলে ১ জিবি ডেটা প্যাকেজ পায়। ৯০ টাকা অনেক বাচ্চার কাছে এখন কিছু না। এই ৯০ টাকাটাও সে তো পাচ্ছে কারও কাছ থেকে। কারণ, ছেলে হোক বা মেয়ে, সে তে আয় করে না। বাবা-মা তাকে দিচ্ছে। দেখা যায়, টাকা দিলেই তারা সঙ্গে সঙ্গে ভরে নিল মোবাইল ফোনে। তাহলে ৯০ কেন? ৫০ না হয় ২০ টাকা দেবে। এভাবে নিয়ন্ত্রণটা নিজের হাতে নিয়ে নিতে হবে।
অনেক বাবা-মাই উৎসাহ নিয়ে বলেন, ‘আমার বাচ্চার মাত্র ৩ বছর বয়স, কিন্তু ও তো সব পারে। আমিও এত কিছু বুঝি না।’ এগুলো ভুল। তাঁরা নিজেরাই বুঝছেন না বিপদটা কোথায়। মা বা বাবার মনে হচ্ছে, ‘আমি পারছি না, আমার বাচ্চা পারছে, ওয়াও!’
এ ক্ষেত্রে বাবা-মাকে জানিয়ে দিতে হবে, ‘ঠিক আছে, দ্যাট ইজ গ্রেট কিন্তু তুমি খেয়াল রেখো যে এসব ক্ষেত্রে বিপদ রয়ে গেছে। বাচ্চা আসক্ত হয়ে যেতে পারে। ওকে যে কেউ স্টক করতে পারে, সাইবার বুলিংয়ের শিকার হতে পারে এমনকি অপহরণও হতে পারে। নিরাপত্তার দিকগুলো বাবা–মাকে বুঝিয়ে দিতে হবে।

বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আমাদের বিচরণ অনেক। সব স্তরের মানুষই আছেন এখানে। সেখানে আমাদের আচরণ কেমন হওয়া উচিত বা কী কী বিষয় মানা উচিত?
জিনাত রেজা খান: এটিকেটসের মতো নেটিকেটস বলে একটা শব্দ রয়েছে। ইন্টারনেটের যে আদবকেতা, তাকে বলা হয় নেটিকেটস। ওখানে কারও একটি ছবিতে লাইক দিলাম বা পছন্দ করলাম না—আমি আমার এ মতামত দিতেই পারি। এটা আমার মত প্রকাশের স্বাধীনতা। আমার অধিকার। কিন্তু আমার বলার মধ্যে নৈতিকতা থাকতে হবে। একটা গালি দিয়ে বলা হলো, তোমরা কিছুই জানো না! এটা ঠিক নয়। বরং তুমি এটা করেছ কিন্তু আমার মনে হয় এটা না করে ওভাবে করলে ভালো হতো—এভাবেও বলা যায়। এটি হলো সচেতন আচরণ, দ্য ওয়ে অব টকিং। আপনি মার্কিন রাজনীতির বিষয়েই দেখেন, যারা কমেন্টস করছে তাদের অর্ধেকের বেশি মানুষই বিষয়টার ব্যাপারে হয়তো জানেও না। কিন্তু বলে যাচ্ছে। এই যে কথা বলে যাওয়া, এটা শুধু বাংলাদেশ না পুরো পৃথিবীজুড়েই।
যেখানে আমি আপনাকে সরাসরি গালি দিতে পারব না, সেখানে মানুষ ইন্টারনেটকে একটা মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করছে। ইন্টারনেটে মতপ্রকাশের যে স্বাধীনতা আছে, তার অপব্যবহার না করা শেখানোর আদবই হলো নেটিকেটস।

ইনস্টাগ্রাম, টুইটার, স্ন্যাপচ্যাট বা আরও যেসব সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ধীরে ধীরে আমাদের এখানে জনপ্রিয় হচ্ছে, সেসবে ছবি বা কোনো কিছু পোস্ট করার ক্ষেত্রে নিজের নিরাপত্তার জন্য কী কী বিষয় মানা উচিত?
জিনাত রেজা খান: ইনস্টাগ্রাম বা টুইটারে মুশকিলই হয়ে যায়, যখন হ্যাশট্যাগ (#) ব্যবহার করা হয়। হ্যাশট্যাগের কারণে ছবি বা পোস্ট আপনার গণ্ডির মধ্যে থাকে না। পরে যতবার আপনি হ্যাশট্যাগগুলো ব্যবহার করবেন, তখন হাজার মানুষ ওই এক ফটো দেখে ফেলবে। সত্যি বলতে, ফেসবুক তো বিপজ্জনক কিন্তু ছবি নিয়ে যেগুলো কাজ করে, সেসব আরও বিপজ্জনক। বিশেষ করে ব্যক্তিগত গোপনীয়তা বা প্রাইভেসির ক্ষেত্রে। সচেতন না থাকলে দেখা যাবে, আপনার ফটো হাজার হাজার মানুষের কাছে চলে গেছে।
আমরা যেটা বলি, ব্যক্তিগত তথ্য, ছবি যত কম শেয়ার করা যায় ততই ভালো। তবে চাকরি বা পেশাগত কারণে অনেককেই তা করতে হয়। যেমন আমি বিভিন্ন জায়গায় অতিথি হিসেবে বক্তৃতা করি, আমাকে ছবি তুলতে হবে। সেটা আমি প্রকাশ করব। কিন্তু ওই জায়গায় ধরুন, আপনি আমার সঙ্গে একটা ব্যক্তিগত ছবি তুলতে চাইলেন, সেটা তোলার কিন্তু দরকার নেই।

কথা প্রসঙ্গে একটা বিষয় আসছে। ধরুন, হয়তো আপনার সঙ্গে একটা ছবি তুলে দিলাম, লোকে ভাবছে আমার খুব জানা–বোঝা—যেহেতু আপনার সঙ্গে দেখা করেছি, তাই বিষয়টা আমি জানি। যেটা চাকরি পেতে বা পেশাজীবনে প্রভাব ফেলতে পারে। লিংকড-ইন বা ফেসবুক প্রোফাইলে এ ধরনের ছবি বা তথ্য মানুষ দেবে নাকি সাধারণ তথ্য রাখবে?
জিনাত রেজা খান: লিংকড-ইন যেহেতু পেশাজীবীদের একটি সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম, সেখানে সাধারণত আশা করাই হয় যে মানুষ তার চাকরির ক্ষেত্রে যা যা তথ্য লাগবে, সেগুলোই আপলোড করবে। এ রকম একজন কর্মীকে কেউ যদি খুঁজতে থাকে, তখন আমাকে তারা পাবে। সে তখন আমাকে চাকরি বা কাজের জন্য বলবে। লিংকড-ইনের ধারণা ওখান থেকে আসে। এটা ব্যক্তিগত নয়, বরং পেশাদার ফোরাম।

অনেক সময় ফেসবুকে দেখে অনেকে ভাবে, ওর তো অনেক যোগাযোগ, ওকে কাজ দিলে ভালো হবে। ফেসবুকে পার্সোনাল ইনফরমেশনের জায়গায় কতটুক তথ্য দেওয়া ভালো?
জিনাত রেজা খান: আসলে কানেকশনস, নাম্বারস আর নাথিং। আর ইনফরমেশনের জায়গায় তো তথ্য দেবেনই না। একদমই না। কারণ, ওখান থেকেই মানুষ আপনার তথ্য নেবে। ধরুন, আপনাকে আজ আমি উইশ করলাম। আমরা বন্ধু। আমার আরও ৫০০ বন্ধু দেখল, আমি আপনাকে উইশ করেছি। আপনি কিন্তু আমার ৫০০ বন্ধুর বন্ধু না। কিন্তু ওদের কাছে আপনার তথ্য চলে গেল। কোথাও কেউ আপনাকে দেখলে বলবে, ‘আরে, একে তো আমি চিনি! এর তো আজকে জন্মদিন।’ এ কারণে ফেসবুকে ব্যক্তিগত তথ্য দেওয়া উচিত নয়। বাচ্চারা যেমন দেয় না, ‘আমি এখান থেকে এখানে যাচ্ছি।’ এসবে সাইবার স্টকিং খুব সহজ হয়ে যায়। কারণ, তারা তাদের অবস্থানের লাগাতার আপডেট দিয়ে দিচ্ছে। বড়রাও এমন করেন। কেউ যদি কাউকে টার্গেট করতে চায়, তার জন্য কিন্তু তা সহজ করে দেওয়া হচ্ছে।

ধরুন, আমি আমার কাজের কোনো কিছু শেয়ার করলাম। আজকের ছবিটা যদি এক মাস পর দিই, তাহলেও কি নিরাপত্তার বিষয় চলে আসে?
জিনাত রেজা খান: ছবি যখন দিচ্ছেন, তখন দেখতে হবে ছবিতে কী আছে? এই যে আমরা বসে আছি, এখন যদি একটা সেলফি তুলি এখানেই—তবে আপনি যে নোট নিচ্ছেন, তা–ও কিন্তু সেলফিতে চলে আসতে পারে। যখন এটা আপলোড করবেন, তখন আপনার কোনো প্রতিদ্বন্দ্বী থাকলে সে তা দেখে ফেলবে। আপনি বুঝলেনও না, কিন্তু আপনার তথ্য চলে গেল। এ রকম কিন্তু অনেকে করে। ব্যাংকে হয়তো কোনো বন্ধু এল। ওই বন্ধু সেলফি তুলল, সেটায় কম্পিউটার মনিটর চলে এল। মনিটরে তখন হয়তো ব্যাংকের গোপন হিসাব বা তথ্য খোলা ছিল। তারা তো খেয়াল করেনি। কারণ, আমরা যখন সেলফি তুলি, আশপাশে কি নজর রাখি? কিন্তু চারপাশের অনেক তথ্য আমরা দিয়ে দিচ্ছি। এগুলো আমাদের খেয়াল রাখতে হবে।

অনেক সময় দেখা যায়, অফিসের বস বা মুরব্বিস্থানীয় কেউ ফেসবুকে ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠালেন। যাকে পাঠানো হলো, সে চায় না তাঁর সঙ্গে ফেসবুকে বন্ধু হতে। এদিকে কোনো সাড়া না পেয়ে বস বা মুরব্বি এসে বললেন, তুমি আমার ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট কেন নাও না? সে ক্ষেত্রে কী করণীয়?
জিনাত রেজা খান: সে ক্ষেত্রে তিনি এথিকসের বিপরীতে চলে গেলেন। যেহেতু ফেসবুক অফিস নয়, তিনি কিন্তু কোনোভাবেই কাউকে চাপ দিতে পারেন না। ফেসবুক কিন্তু পার্সোনাল। যেমন আমার মোবাইল ফোনে দুবাইতে কোনো ডেটা প্যাকেজ নেই। আমার ব্যক্তিগত একটা ফোন আছে, ওটায় ইন্টারনেট আছে। সেটা আমার পরিবারের জন্য। যে ফোনটার নম্বর সবার কাছে আছে, সেটায় হোয়াটসঅ্যাপও নেই। কারণ, অনেককেই আমি দেখি হোয়াটসঅ্যাপে অফিশিয়াল আলাপ চালায়। এর কিন্তু কোনো পেপার ট্রেইল নেই। আইনত বা প্রাতিষ্ঠানিক কাজে এটা গ্রহণযোগ্য নয়। ই-মেইল হলে আবার তা গ্রহণযোগ্য। কারণ, এটা লিখিত ডকুমেন্ট।
সোশ্যাল মিডিয়া কিন্তু পেশাদার মাধ্যম নয়। তবে আমার অফিস যদি চায় আমার একটা ফেসবুক অ্যাকাউন্ট থাকবে, তবে আমি দেব কখগ@এবিসিডি। এমনটা হতে পারে। সেটাতে আমি আমার বসকে অ্যাড করলাম। আমাদের অনেক প্রফেসর আছেন, যাঁদের দুটি অ্যাকাউন্ট। একটায় সব পরিবারের সদস্য, আরেকটা পুরোপুরি প্রফেশনাল।

ফেসবুকের ফ্রেন্ডলিস্টে কত বন্ধু রাখা উচিত?
জিনাত রেজা খান: অনেকের দেখা যায় চার-পাঁচ হাজার বন্ধু নিয়ে হচপচ অবস্থা। তারকা ছাড়া এত বেশি ফ্রেন্ড থাকা ঠিক নয়। দেখা যায় যে আপনাকে চিনি বা চিনি না, ছবি দেখেই আপনাকে ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠিয়ে দিলাম। আপনি অ্যাকসেপ্ট করলেন। এভাবে সংখ্যাটা বেড়ে যায়। নাম্বারস আর নাথিং।

এই যুগে শিশুর বিকাশে আসলে কতটুকু ইন্টারনেটে ব্যবহার করা দরকার?
জিনাত রেজা খান: একটা পর্যায় পর্যন্ত শিশুদের ইন্টারনেটের আসলে কোনো দরকারই নেই। আমরা বলব যে ক্লাস ফোর-ফাইভ, তা-ও কথা আছে। আমার মেয়ের কথাই বলি। তার আট বছর বয়স। এ বছর থেকে ওর স্কুলে বলেছে যে ট্যাবলেট বা ল্যাপটপ সপ্তাহে এক দিন করে স্কুলে নিয়ে যেতে হবে। আইসিটি শেখাবে। এর আগে ওর কোনো ট্যাবলেট ছিল না। তবে আমরা বলে দিলাম, প্রতিদিন ৩০ মিনিট করে সে ট্যাবলেট পাবে। তাকে কাজ করতে হবে বাবা বা মার পাশে বসে। পড়াশোনার কাজে যে সাইটগুলো লাগে, শুধু সেগুলোতেই সে যেতে পারবে। এভাবেই আমরা অভ্যাসটা করিয়ে ফেলেছি।

আরেকটা ব্যাপার আছে, অনেক বাচ্চা খেতে চায় না, তখন বাবা-মা আইপ্যাড বা ট্যাবলেট দিয়ে দেন। আর মা-বাবাও বলে যে ‘ও তো একা একাই সব শিখে যাচ্ছে। ওকে তো কালার শেখাতে হচ্ছে না, ওকে তো ইংরেজি শেখাতে হচ্ছে না বা ওকে খাওয়ানোর সময় না দিলে তো খাচ্ছে না।’ এটা কীভাবে ঠিক করবে?
জিনাত রেজা খান: বাচ্চা খাচ্ছে না, কারণ তাকে এভাবে কিছু একটা দেখে দেখে খাওয়ানো অভ্যাস করানো হয়েছে। আমি যদি না করি, তার শেখার কোনো সুযোগ নেই। মা-বাবারা কিন্তু নিজেদের কাজ সহজ করার জন্য প্রযুক্তিকে শিশুদের কাছে নিয়ে যাচ্ছে। এমনকি স্টিভ জবস ট্যাবলেট কম্পিউটার তৈরি করেছেন এবং বলেছেন যে এটা দুই বছরের শিশুও চালাতে পারবে। কিন্তু আপনারা কি জানেন তাঁর ছেলেরা ছিল ‘দে ওয়্যার নেভার অ্যালাউড টু ইউজ ট্যাবলেট টিল দে গ্রোন আপ’ নিয়মের মধ্যে। কারণ, স্টিভ জানতেন, এর একটা নেতিবাচক প্রভাব রয়েছে।

প্রথম আলোর কর্মীদের সঙ্গে ইন্টারনেট নৈতিকতা নিয়ে কথা বলছেন জিনাত রেজা খান
প্রথম আলোর কর্মীদের সঙ্গে ইন্টারনেট নৈতিকতা নিয়ে কথা বলছেন জিনাত রেজা খান

সঙ্গী যখন ইন্টারনেটে আসক্ত হয়ে যায়, তখন কী করা যায়?
জিনাত রেজা খান: আপনার কাছের কেউ যদি মাদকাসক্ত হয়ে যায়, তবে কি আপনারা তাকে ফেলে দেবেন? আসলে চেষ্টা করবেন ফিরিয়ে আনার। এমনকি যুক্তরাষ্ট্রেও ইন্টারনেট-আসক্তি দূর করার কেন্দ্র রয়েছে। এ ক্ষেত্রে কাউন্সেলিং করতে হবে। কারণ, কেউ যদি আসক্ত হয়ে যায়, তবে সে কাজ ঠিকমতো করতে পারে না। আয় হয় না। সেখানে যদি একটা পরিবার থাকে, বাচ্চা থাকে, তারা তো সবাই ভুক্তভোগী।

অনেক শিশুর ক্ষতিকর গেম বা পর্নো সাইটের প্রতি আগ্রহ থাকে। এ থেকে তাদের মধ্যে বিকৃত মানসিকতা তৈরি হতে পারে। তাদের ফিরিয়ে আনার উপায় কী?
জিনাত রেজা খান: এর নিয়ন্ত্রণ মা-বাবার হাতেই। মা-বাবা যদি না দেন, তাহলে বাচ্চা পাবে না। অনলাইনে অনেক সফটওয়্যার আছে, যেগুলা ইনস্টল করলে দেখা যায় বাচ্চা কী দেখছে বা কোন ওয়েবসাইটে ঢুকছে। প্রতি আধা ঘণ্টার হিসাব মা-বাবা পাবেন। আরেকটা রয়েছে প্যারেন্টাল ব্লক। বাচ্চা যদি ক্ষতিকর সাইটে ঢুকতে চায়, সেটা আপনাআপনি আটকে দেবে। সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন হলো বাচ্চার সঙ্গে বসে কথা বলা, ‘তুমি কেন এই গেমটা খেলছ বা এটা দেখছ?’ আমাদের দেশে অনেকে বলবেন, মা-বাবাকে এখন এটা নিয়ে কেন কথা বলতে হবে? কিন্তু এটা একটা সমস্যা। এ নিয়ে কথা বলতে হবেই। পর্নোগ্রাফি আসলে দেখা উচিত নয়। কারণ, এতে এমন কিছু আছে, যা বোঝার জন্য তারা প্রস্তুত নয়। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ওই ভিডিওগুলোতে একজন মেয়েকে অনেক হেয় করে দেখা হয়। শিশুর মানসিকতা কিন্তু বদলে যেতে থাকে। একটা মেয়েকে কীভাবে ছোট করা যায়, এটাও তারা শিখে ফেলছে।

কোনো কারণে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে হয়রানির শিকার হলে তাৎক্ষণিক করণীয় কী?
জিনাত রেজা খান: এখন আপনি যদি বোঝেন যে কর্মস্থলের কেউ, তবে সঙ্গে সঙ্গে আপনার বসকে জানাবেন। এমন হতে পারে, আপনার বস জানেন না করণীয় কী, সে ক্ষেত্রে সাইবার আইন আছে। বাইরের কেউ হলেও সাইবার আইনের সহায়তা নিতে হবে। এটা আসলে সচেতনতা। আমাদের সীমা জানা দরকার। আর নিজেকে মানসিকভাবে শক্ত হতে হবে, যাতে এসব জিনিস আপনার কাছে এসে বাউন্স ব্যাক করে। যদি ফেসবুকে হয়, তবে আপনি সঙ্গে সঙ্গে ফেসবুকে জানিয়ে দিতে পারেন। আপনি রিপোর্ট করে দিন।

সাধারণত সাইবার জগতে কী কী প্রতারণার আশঙ্কা থাকে? একজন বিশেষজ্ঞ হিসেবে আপনি বলুন কীভাবে সেসব প্রতারণা এড়ানো যায় বা সেগুলো থেকে বের হয়ে আসা যায়?
জিনাত রেজা খান: প্রতারণার শীর্ষে আছে সাইবার বুলিং (মোবাইল ফোন, কম্পিউটার, ইন্টারনেট, ফেসবুক বা যোগাযোগের ইলেকট্রনিক মাধ্যমে কাউকে হুমকি দেওয়া, আতঙ্কিত করে তোলা)। এরপরই আছে প্রেডোফায়ারস, মানে পর্নোগ্রাফিক মুভি বানায়, ফটো তৈরি করে। এটা অনেক বড় একটা বাজার হয়ে উঠেছে। আরেকটা হলো পরিচিতি (আইডি) চুরি। আপনার তথ্য চুরি করে আপনার ক্রেডিট কার্ড বানিয়ে ফেলল বা একটা ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খুলে ফেলল। এরপর সেই অ্যাকাউন্ট দিয়ে অনেক কিছু কিনে ফেলল। সবশেষে সব আপনার ঘাড়ে এসে পড়বে। আর তখন অনেক দেরি হয়ে যাবে। তখন সেখান থেকে বের হয়ে আসা নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করতে অনেক সময় লেগে যায়। আর্থিক ব্যাপার তো আছেই, অনেক ধরনের সামাজিক সমস্যাও হতে পারে।

এই সব থেকে বের হওয়া যায় কীভাবে?
জিনাত রেজা খান: সচেতনতা। এখন এই দেশে কোনো ভবনে গ্রিল ছাড়া জানালা নেই। কেন? চোর ঢুকবে। বাংলাদেশে গ্রিল মাস্ট। কারণ আমরা জানি, চোর ঢুকতেই পারে। এখন আমি যদি জানি এটা হতে পারে, তবে তা মোকাবিলা করতে পারব। তাই আগে প্রযুক্তির ঝুঁকিটা জানতে হবে। জানলেই মোকাবিলা করা যাবে।

আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।
জিনাত রেজা খান: আপনাকেও ধন্যবাদ।