রসমঞ্জরীর রসের জাদু

ঘন লালচে দুধ। জমে যেন ক্ষীর। এর মাঝে ডুবে আছে ছোট গোল গোল নরম মিষ্টি। বাটি ধরে নাড়া দিলে জমে থাকা ক্ষীর থেকে উঁকি দেয় মিষ্টিগুলো। মুখে দিলেই রসে ভরে যায়। ক্ষীর আর মিষ্টি মিলে জিবে ছড়িয়ে পড়ে অদ্ভুত স্বাদ।

রসের এমন জাদুর জন্য এই মিষ্টির নাম রসমঞ্জরী। গাইবান্ধার ঐতিহ্যবাহী মিষ্টি এটি। দেখতে রসমালাইয়ের মতো হলেও প্রস্তুত প্রণালির কারণেই এর স্বাদ অনন্য।

গাইবান্ধা শহরে কমবেশি প্রায় সব মিষ্টির দোকানেই রসমঞ্জরী পাওয়া যায়। রমেশ ঘোষ, গাইবান্ধা মিষ্টান্ন ভান্ডার, নাড়ু মিষ্টান্ন ভান্ডার, জলযোগসহ সব দোকানেই মিলবে রসমঞ্জরী। তবে শুরুটা রমেশ ঘোষের হাত ধরে। দোকানের স্বত্বাধিকারী এখন রমেশ ঘোষের আত্মীয় বাদল চন্দ্র ঘোষ। দোকানের সঙ্গে যুক্ত আছেন রমেশ ঘোষের স্বজনেরাই। তাঁদেরই একজন স্বপন ঘোষ বলেন, ১৯৪৮ সালের জুন মাসে ওডিশার এক কারিগরকে নিয়ে রমেশ ঘোষ শুরু করেন রসমঞ্জরী বানানো। শুরুতে রসমঞ্জরীগুলো লম্বা আকারের বানানো হতো। তবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আকারে বদল এসেছে। এখন এটি গোল করেই বানানো হয়।

রসমঞ্জরীর শুরুটা ১৯৪৮ সালে রমেশ ঘোষের হাত ধরে। দোকানে গেলে প্রথমেই চোখে পড়ে প্রয়াত রমেশ ঘোষের ছবি। ছবি: প্রথম আলো
রসমঞ্জরীর শুরুটা ১৯৪৮ সালে রমেশ ঘোষের হাত ধরে। দোকানে গেলে প্রথমেই চোখে পড়ে প্রয়াত রমেশ ঘোষের ছবি। ছবি: প্রথম আলো

রসমঞ্জরীর বড় অংশজুড়ে থাকে দুধ ও ছানা। স্বপন ঘোষ বলেন, দুধ ঘন করে ক্ষীর বানানো হয়। এরপর ছানা আর ময়দা মিশিয়ে তৈরি হয় মিষ্টিগুলো। মিষ্টির বেশির ভাগটাই থাকে ছানা। রমেশ ঘোষের দোকানে মেশিনে গোল গোল মিষ্টিগুলো বানানো হয়। কোনো কোনো দোকানে এগুলো হাতেও বানানো হয়। মিষ্টিগুলো এরপর চিনির রসে সেদ্ধ করা হয়। এরপর নির্দিষ্ট তাপমাত্রায় এনে রসে ভেজানো মিষ্টি, ক্ষীরে মেশানো হয়।

রমেশ ঘোষের দোকান পথিকৃৎ হলেও রসমঞ্জরী বিক্রিতে খ্যাতি অর্জন করেছে গাইবান্ধা মিষ্টান্ন ভান্ডার। গাইবান্ধার বাইরেও একসময় মিষ্টি সরবরাহ করা হতো এই দোকান থেকে। স্বত্বাধিকারী কাজী হারুনুর রশিদ জানান, অনলাইনে প্রসিদ্ধ নামে একটি সংগঠন ঢাকায় রসমঞ্জরী সরবরাহের কাজ করত। ঢাকার মোহাম্মদপুরের ইকবাল রোডের একটি দোকানেও রসমঞ্জরী সরবরাহ করা হতো। তবে এটি কিছুদিন হলো বন্ধ আছে। ফরমাশ দিলে গাইবান্ধা মিষ্টান্ন ভান্ডার থেকে রসমঞ্জরী বানিয়ে হিমায়িত করে ঢাকায় পাঠানো হতো। মূলত গাইবান্ধা থেকে ঢাকাগামী বাসগুলোতেই রসমঞ্জরী পাঠানো হতো। খুব গরম না পড়লে ১২ থেকে ১৪ ঘণ্টা এভাবে রসমঞ্জরী ভালো থাকে। স্বাভাবিক তাপমাত্রায় রসমঞ্জরী খুব কম সময়ে নষ্ট হয়ে যায়। এ কারণে পাঠানো কঠিন হয়ে যায়। দিনে আনুমানিক ৮০ থেকে ১০০ কেজি রসমঞ্জরী বানান বলে জানান গাইবান্ধা মিষ্টান্ন ভান্ডারের পরিচালক পরিষদের সদস্য কাজী নাজমুল হাবিব।

গাইবান্ধা সরকারি বালক উচ্চবিদ্যালয়ের শিক্ষক মাইদুল ইসলাম বলেন, সকালে পরোটা দিয়ে রসমঞ্জরী খেলেই দিনের শুরুটা মিষ্টি মনে হয়। আট বছরের শিরোপার দারুণ পছন্দের রসমঞ্জরী। আর ঢাকা বা অন্য কোনো জায়গা থেকে কেউ এলে তাদের রসমঞ্জরী দিয়ে আপ্যায়ন করা চাইই চাই গাইবান্ধাবাসীর। এভাবেই আত্মীয়ের বাড়ি গেলে, শ্বশুরবাড়িতে, উৎসবে বা উৎসব ছাড়াও গাইবান্ধাবাসীর প্রতিদিনের জীবনের অনুষঙ্গ রসমঞ্জরী।