নতুন নকশায় খাদি

‘খদ্দর পরে ভদ্দরনোক’ কথাটা মিনতি রানি ছোটবেলায় শিখেছিলেন। জানালেন, ছোটবেলায় মা-কাকিমারা এটা বলতেন। সবাই যাতে খাদি কাপড় পরে, তাই এই কথা বলে উৎসাহিত করা হতো।

নকশার এই প্রতিবেদনের ছবি তোলার জন্য কুমিল্লার চান্দিনায় যাওয়া হয়েছিল। সেখানে তাঁতিবাড়ি খুঁজতে গিয়ে পরিচয় ষাটোর্ধ্ব মিনতি রানির সঙ্গে। একসময় তাঁদের বাড়িতে ১০টি তাঁত ছিল, এখন একটাও নেই। কয়েক মাস ধরে বন্ধ আছে বাংলাদেশে খাদির সবচেয়ে বড় বিজ্ঞাপন কুমিল্লার শৈলেন্দ্রনাথ গুহ প্রতিষ্ঠিত গ্রামীণ খাদি। শৈলেন্দ্রনাথের মৃত্যুর পর এই প্রতিষ্ঠানের হাল ধরেন তাঁর ছেলে অরুণ গুহ। গত বছরে তিনি মারা যান।

একটুকরো কাপড়ের সঙ্গে দেশপ্রেমের যে নজির ভারতবর্ষে শুরু হয়েছিল ১৯২০ সালের দিকে, তা কি একেবারেই মৃত এখন! সেটার উত্তর খানিকটা আশাব্যঞ্জক। কুমিল্লার চান্দিনার সজল খদ্দর বস্ত্র বিতানের স্বত্বাধিকারী শংকর চন্দ্র দেবনাথ জানালেন, ‘দেশে হাত তাঁতের (হ্যান্ডলুম) সংখ্যা কমতে কমতে এখন তলানিতে গিয়ে ঠেকেছে। তবে নতুন করে আশা জাগাচ্ছে খাদি কাপড়। খাদির এখনো চাহিদা আছে। কিন্তু তাঁতিরা যোগ্য মজুরি না পাওয়ায় এবং উৎপাদন খরচ বেড়ে যাওয়ায় বন্ধ হয়ে যাচ্ছে তাঁত। এখন অনেক ফ্যাশন হাউসের কাছ থেকে কাপড়ের অর্ডার পাচ্ছি।’

২০১৫ সাল থেকে খাদি কাপড়ের জনপ্রিয়তা বাড়াতে ফ্যাশন ডিজাইন কাউন্সিল অব বাংলাদেশ (এফডিসিবি) আয়োজন করছে খাদি উৎসবের। ‘খাদি, দ্য ফিউচার ফ্যাব্রিক শো’ স্লোগানে অনুষ্ঠিত হচ্ছে প্রদর্শনী ও ফ্যাশন শো। এ আয়োজনে বাংলাদেশের তো বটেই, বিদেশি ডিজাইনাররা খাদি কাপড়ের পোশাক নিয়ে হাজির হন। শোয়ের পর নির্দিষ্ট দিনে প্রদর্শনীর মাধ্যমে বিক্রিও করা হয়।

এফডিসিবির সভাপতি ফ্যাশন ডিজাইনার মাহিন খান বলেন, ‘গত বছর শোয়ের পর প্রায় সব পোশাক বিক্রি হয়ে যায়। অনেক ডিজাইনার নতুন ফরমাশ নিয়ে আবার পোশাক তৈরি করে দিয়েছেন ক্রেতাদের।’

সব ঋতুতে খাদি
একটা সময় শুধু শীতকালে খাদি পরার চল থাকলেও এখন সারা বছর পরা যায়। বিয়ে বাড়ি বা দাওয়াতে পরে যাওয়ার মতো খাদির শাড়ি, পাঞ্জাবি, শেরওয়ানি, কামিজ, টপ, কেইপ, স্কার্ট—সবই তৈরি হচ্ছে। আজিজ সুপার মার্কেট থেকে বিভিন্ন ফ্যাশন হাউস—সবখানেই খাদির পোশাক চোখে পড়ে কমবেশি। ডিজাইনার রুপো শামস্ এবারই প্রথম কাজ করেছেন খাদি কাপড় নিয়ে। তাঁর মতে, ‘খাদি তরুণদের কাছে জনপ্রিয় করার অন্যতম উপায় হচ্ছে খাদি কাপড়ে তাদের পছন্দের পোশাক তৈরি করা। সেভাবেই নকশা করার চেষ্টা করছি খাদিতে।’

একই ভাবনা ডিজাইনার সারাহ্ করিমেরও। তিনি দেশের বাইরেও খাদি জনপ্রিয় করতে চান। তাই ডিজাইনে পশ্চিমা ধারার মিশ্রণ ঘটাচ্ছেন। বাঙালি নারীর পছন্দের শাড়ির আঁচল ও কুঁচিতে সেলাই দিয়ে বিদেশিদের পরার উপযোগী করেছেন। সারাহ্ করিমের ভাবনা—‘আমার অনেক বিদেশি ক্রেতাই শাড়ি পরতে চান, কিন্তু সামলাতে পারেন না বলে ভয় পান। খাদি কাপড়ে তৈরি দেশি শাড়ির নকশা করার সময় আমি বিদেশিদের কথাও ভেবেছি। খাদি কাপড়ে এমনিতেই আলাদা একটা “স্ট্রাকচার” আছে। যে কারণে খুব বেশি নকশা করার দরকার পড়ে না।’

খাদিতে নতুনত্ব
খাদিতে নতুনত্ব

নতুন ডিজাইনারদের হাতে যেন নতুন প্রাণ পাচ্ছে খাদি। শাল, পাঞ্জাবি বা মোটা এক খণ্ড বস্ত্রের বাইরে এসে খাদি কাপড়ে তৈরি হচ্ছে সব ধরনের পোশাক। নানা ধরনের নিরীক্ষা করে পাতলা করে সব সময়ে ব্যবহার করার উপযোগী বানানো হয়েছে খাদি কাপড়। তাই শুধু দেখার জন্য তৈরি হচ্ছে তেমনটা নয়, নতুন প্রজন্ম লুফে নিচ্ছে নতুন নকশার খাদি পোশাক। ডিজাইনারদের ভাবনায় এখন তাই খাদির পুনর্জাগরণ। এফডিসিবির সহসভাপতি ফ্যাশন ডিজাইনার এমদাদ হক বলেন, ‘সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে মিলে কয়েক বছর ধরে আমরা যে উদ্দেশ্যে খাদি নিয়ে আয়োজনটা করছি, সেটা সফল হবে ক্রেতাদের এই সাড়া অব্যাহত থাকলেই। আর ক্রেতাদের ধরে রাখতেই ইন্দো-ওয়েস্টার্ন নকশার পোশাক হচ্ছে। সরকারিভাবে কুমিল্লায় নতুন প্রকল্প হাতে নেওয়া হচ্ছে তাঁতিদের জন্য। সব মিলে খাদির সুদিন ফিরছে বলেই মনে হচ্ছে।’

কুমিল্লার চান্দিনা ও দেবীদ্বার উপজেলাজুড়ে একসময় অনেক বাড়িতে খাদি তৈরি হলেও এখন তা কম। তবে এরই মধ্যে যাঁরা টিকে আছেন, স্বপ্ন দেখছেন নতুন করে। চান্দিনার বড়কামতা গ্রামের চিন্তা হরণ দেবনাথের কথাই ধরা যাক। তাঁর বাড়িতে এখন একটা তাঁতে কাজ চালালেও কাপড়ের চাহিদা বেড়েছে মনে করছেন। নতুন করে দুইটা তাঁত চালুর কথা ভাবছে মিনতি রানির পরিবারও। জানালেন, ‘অহন বাড়িতে তাঁত নাই, তয় খদ্দরের চাহিদা বাড়ায় ছেলেরা তাঁত চালাব কইতেছে।’

আবার খাদি উৎসব
ফ্যাশন ডিজাইন কাউন্সিল অব বাংলাদেশের (এফডিসিবি) আয়োজনে আবার শুরু হচ্ছে ‘ট্রেসেমে খাদি, দ্য ফিউচার ফ্যাব্রিক শো ২০১৭।’ এর আগে ২০১৫ ও ২০১৬ সালেও হয়েছিল এই উৎসব।

আগামী ৩ ও ৪ নভেম্বর এই ফ্যাশন শোর আয়োজন করা হয়েছে রাজধানীর বসুন্ধরা কনভেনশন সেন্টারের ৩ নম্বর মিলনায়তনে। প্রতিদিন সন্ধ্যা ছয়টায় শুরু হবে অনুষ্ঠান। বাংলাদেশের ১৯ জন ডিজাইনার ছাড়াও ভারত, নেপাল, ভুটান ও মালয়েশিয়ার ছয়জন ডিজাইনার অংশ নেবেন এবার। অনুষ্ঠানটির সহযোগিতা করছে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় ও বেঙ্গল গ্রুপ লিমিটেড। সহযোগিতা করছে আইপিএবি, সেনোরা, মাইক্রোসফট ও বার্জার।