খাতির কতটা খাঁটি

খাতির থেকে যেন অহেতুক ভুল বোঝাবুঝি না হয় সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। মডেল: মুয়িদ, বাপ্পা ও অন্তু। ছবি: সুমন ইউসুফ
খাতির থেকে যেন অহেতুক ভুল বোঝাবুঝি না হয় সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। মডেল: মুয়িদ, বাপ্পা ও অন্তু। ছবি: সুমন ইউসুফ

খাতির বিষয়টা বহুমুখী। খাতির অনেক ধরনের হয়। মনে করেন, বিমানবন্দরের ইমিগ্রেশন লাইনে দাঁড়িয়ে আছি। ইমিগ্রেশন পুলিশ প্রত্যেক যাত্রীর কাছে তাঁদের এবং তাঁদের পূর্বপুরুষের তথ্য জেনে নিচ্ছে। ইমিগ্রেশন লাইন নড়ছে একটি খোঁড়া শামুকের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে। তখন পেছনের একজন বললেন, ‘ইশ্‌, বাংলাদেশের সেকেন্ড ইনিংসটা দেখতে পারলাম না।’

আমি বললাম, ‘জি ভাই! কোনো মানে হয় বলেন? তবে এই ইমিগ্রেশন অফিসারের মতো যদি আমাদের ওপেনাররা একটু ধরে ধরে খেলত, তাহলে কিন্তু মন্দ হতো না।’

‘আমি তো তা-ই বলি! আর দেখেন সাব্বির কিন্তু নিজের টেকনিকটা আরেকটু অ্যাডজাস্ট করতে পারে’—ব্যস জমে গেল খাতির। ইমিগ্রেশন পুলিশের ডাক পেতে পেতে বিডি টাইগার্সের সব সমস্যার সমাধান করে ফেললাম আমরা। ডাক পাওয়ামাত্র আমি আর আমার টাইগার্সের সহ-ত্রাণকর্তা একজন আরেকজনের কথা বেমালুম ভুলে গেলাম। নামও জানা হলো না। দুজনার দুটি পথ দুটি দিকে গেল বেঁকে।

খাতিরের আরেকটি উদাহরণ দিই। কিছুদিন আগে ময়মনসিংহে একটা টেলিভিশন নাটকে অভিনয় করতে গিয়েছিলাম। আমার সঙ্গে পার্শ্বচরিত্রে অভিনয় করছিলেন যিনি, সেই মানুষটি জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ে নাট্যকলায় মাস্টার্স করছেন। তিন দিন শুটিং করলাম একসঙ্গে। ছোট পরিসরের চরিত্র হলেও অসাধারণ অভিনয় করলেন তিনি। তাঁর সম্ভাব্য মাস্টার্স থিসিস নিয়ে অনেক আলাপ-আলোচনা হলো। তিন দিনের জন্য নাটকের সম্পর্কের মতোই, বাস্তব জীবনে আমাদের মধ্যে একটা ছোট ভাই-বড় ভাইসুলভ সম্পর্ক তৈরি হলো। সেই রকম খাতির। শুটিং শেষ হলো। আমি ঢাকায় চলে এলাম, তিনি থেকে গেলেন ময়মনসিংহে। তিন মাস হয়ে গেছে, তাঁর সঙ্গে আর যোগাযোগ হয়নি।

কিছুদিন আগে সিঙ্গাপুরে ছিলাম বাবার চিকিৎসার জন্য। আমি মানুষটা কিঞ্চিৎ ভোলাভালা। যত না দায়িত্বহীন মনে হয় ততটা না হলেও, আমার ব্র্যান্ড ইমেজ আত্মীয়স্বজনের কাছে এমন হয়ে গেছে যে গুরুত্বপূর্ণ পারিবারিক বিষয়ে তাঁরা আমার ওপর বিশেষ ভরসা রাখে না। স্বভাবতই আমার চাচা যখন শুনলেন, বাবাকে নিয়ে আমি একা সিঙ্গাপুরে যাচ্ছি, তখন একধরনের প্যানিক সৃষ্টি হলো। তিনি মোটামুটি সিঙ্গাপুরবাসী যত বাংলাদেশি আছেন, সবার সঙ্গে যোগাযোগ করে ফেললেন। প্রায় পৌনে দুই শ জন ব্যাকআপ তৈরি হয়ে গেল, যদি বাবার যত্নে আমি গুবলেট করে ফেলি সে জন্য। পরম করুণাময় আল্লাহর দয়ায় কোনো গুবলেট হলো না। কঠিন চিকিৎসার মধ্যে যতটুকু আরামদায়ক সময় কাটানো যায়, আমি আর বাবা সেটা কাটাতে থাকলাম। কিন্তু ওদিকে চাচার প্যানিক পুরোটা ক্ষান্ত হলো না। ২০০ জন না হলে উনি গোঁ ধরে বসলেন যে অন্তত একজন আমাদের দেখে যাক। চাচার বয়স কম নয়, ওনাকে প্যানিক করিয়ে বাবা-চাচা দুজনের শরীর খারাপ করে লাভ নেই। তাই আমরা আমাদের শুশ্রূষাকারীর সঙ্গে দেখা করার পরিকল্পনা করলাম।

বাবা আর আমি দুজনই কিঞ্চিৎ বিরক্ত। এমনিতেই হাসপাতাল, তারপরও বাইরের মানুষের সঙ্গে দশটা আলাপ করা একটা চাপের বিষয়ই বটে। ভদ্রলোক এলেন। পাঁচ মিনিট প্যাঁচার মতো মুখ বানিয়ে কথা বললাম। কথা বলতে বলতে বাবা আর আমার প্যাঁচামুখ মধু নয়নে পরিণত হলো। আধা ঘণ্টার মধ্যে মনে হলো, এই ভদ্রলোকের সঙ্গে আমাদের বহু বছরের পরিচয়, আজীবনের সখ্য। লেখার প্রসঙ্গে বলতেই হয়, গভীর খাতির। প্রথম দেখার পর বাবা অনেকবার সিঙ্গাপুরে গেছেন চিকিৎসার জন্য। প্রায় প্রতিবারই ওনার সঙ্গে দেখা হয়েছে। কয়েক দিন দেখা না হলে আমরা একজন আরেকজনের সঙ্গে যোগাযোগ করি।

মানুষ সামাজিক জীব। আমাদের মধ্যে বেশির ভাগ মানুষই চায় না একা থাকতে। সে কারণেই জীবনে বিভিন্ন পরিস্থিতিতে আমরা একে অন্যের সঙ্গে খাতির জমাই। তবে সব খাতিরের গভীরতা এক নয়। যেমন আমার ইমিগ্রেশন লাইনে যাঁর সঙ্গে খাতির হলো, তিনি যদি হুট করে ফোন করে আমার কাছে একটা কিছু চেয়ে বসেন, আমি বিরক্ত হব। ময়মনসিংহের সহ-অভিনেতা বা সিঙ্গাপুরের বড় ভাই যদি করেন আমি খুশিমনে তাঁদের সাহায্য করার চেষ্টা করব। এটাই স্বাভাবিক।

খাতির হবেই। খাতির হওয়াটা মধুর অভিজ্ঞতা। তবে খাতির কতটা গভীর এবং সেই খাতিরের ভিত্তিতে একজন আরেকজনের ওপর কতটা দাবি করা যায়, সেটাও বুঝতে হবে। তাহলে খাতির তার নির্মল সৌন্দর্যের জায়গায় থাকবে। খাতিরের কারণেই জটিলতা, ভুল-বোঝাবুঝি আর অহেতুক বেদনার সৃষ্টি হবে না।

আপনাদের সবার সঙ্গে খাতির করার অপেক্ষায় রইলাম।

লেখক: অভিনেতা