নারীর জন্য

এই ছবির মডেল কুমকুম হাসান ও সোনিয়ার মতো সুস্থ হাসিখুশি থাকুক সব নারী। সেজন্য নিজের যত্ন নিতে হবে, সচেতন থাকতে হবে। ছবি: অধুনা
এই ছবির মডেল কুমকুম হাসান ও সোনিয়ার মতো সুস্থ হাসিখুশি থাকুক সব নারী। সেজন্য নিজের যত্ন নিতে হবে, সচেতন থাকতে হবে। ছবি: অধুনা

ডায়াবেটিসের মতো রোগ জেন্ডার যাচাই-বাছাই করে না, নারী-পুরুষনির্বিশেষে যে কেউ এর শিকার হন। কিন্তু নারীদের ক্ষেত্রে এর পরিণতি ও ফলাফল হয় ভিন্ন। রোগ নির্ণয়, সঠিক চিকিৎসার সুযোগ, নিয়মিত পরীক্ষা-নিরীক্ষার সুবিধা পেতে এবং জটিলতা আগেভাগে প্রতিরোধের ব্যবস্থা করতে নারীরা সারা দুনিয়ায় পুরুষদের চেয়ে পেছনে পড়ে যান। তাই দেখা যায়, নারীদের ডায়াবেটিস কম নিয়ন্ত্রিত, বেশি জটিল। ডায়াবেটিসের কারণে নারীদের মৃত্যুর হারও পুরুষদের তুলনায় বেশি। তার ওপর নারীদের জন্য রয়ে গেছে এক বিশেষ ধরনের ডায়াবেটিস—গর্ভকালীন ডায়াবেটিস বা জিডিএম। সব মিলে ডায়াবেটিসে আক্রান্তের সংখ্যা যেমন সারা পৃথিবীতে হু হু করে বাড়ছে, তেমনি বাড়ছে নারীদের ঝুঁকি। আগামী ১৪ নভেম্বর বিশ্ব ডায়াবেটিস দিবস। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এবারের বিশ্ব ডায়াবেটিস দিবসের প্রতিপাদ্য করেছে ‘নারী ও ডায়াবেটিস: সুন্দর আগামীর অধিকার’।
এই মুহূর্তে বিশ্বে প্রতি ১০ জন নারীর মধ্যে একজন ডায়াবেটিসে আক্রান্ত। তাঁদের অর্ধেকই আবার এ বিষয়ে ওয়াকিবহাল নন। তাঁদের একটা বিরাট অংশ হৃদ্রোগ, কিডনি বিকল, অন্ধত্ব, স্ট্রোক ইত্যাদি জটিলতায় আক্রান্ত হবেন। ৪৫ বছর বয়সের পর নারী-পুরুষনির্বিশেষে সবারই মাঝে মাঝে রক্তে শর্করা পরীক্ষা করা উচিত। কিন্তু নারীদের এর অনেক আগেই, অল্প বয়সে, ডায়াবেটিসের ঝুঁকি দেখা দিতে পারে। গর্ভধারণকালে রক্তে হরমোনের উচ্চমাত্রা এই ডায়াবেটিসের জন্য দায়ী। ওজনাধিক্য, বেশি বয়সে সন্তান নেওয়া, কায়িক শ্রমহীনতা, ডায়াবেটিসের পারিবারিক ইতিহাস এই ঝুঁকি বাড়িয়ে দেয়। যাঁদের আগে গর্ভপাত হয়েছে বা সন্তান গর্ভেই মারা গেছে কিংবা যাঁরা আগে অতি ওজনের শিশু জন্ম দিয়েছেন, তাঁরা গর্ভকালীন ডায়াবেটিসের ঝুঁকিতে আছেন। গর্ভকালীন ডায়াবেটিসের সমস্যাগুলোও জটিল। প্রথমত, এটি অন্তঃসত্ত্বা মা ও গর্ভস্থ শিশু দুজনের জীবনকেই ঝুঁকির মধ্যে ফেলে দেয়; দ্বিতীয়ত, শুধু ইনসুলিনই এই সময় নিরাপদ চিকিৎসা হিসেবে বিবেচিত; তৃতীয়ত, এর চিকিৎসার জন্য ঘন ঘন পরীক্ষা-নিরীক্ষা, বিশেষায়িত চিকিৎসাব্যবস্থা ও হাসপাতাল ডেলিভারি আবশ্যক। গর্ভকালে নিখুঁতভাবে রক্তে শর্করা নিয়ন্ত্রণ না করতে পারলে নানা রকম বিপদের আশঙ্কা আছে। প্রতিটি নারীকে সন্তান ধারণের ২৪ সপ্তাহ থেকে ২৮ সপ্তাহের মধ্যে ডায়াবেটিসের গ্লুকোজ টলারেন্স টেস্ট করাতে হবে। যাঁদের ঝুঁকি আছে, তাঁদের আরও আগেই করিয়ে ফেলা ভালো। বাড়িতে রক্তে শর্করা পরীক্ষা করা এবং সে অনুযায়ী ইনসুলিনের মাত্রা ঠিক করা, সঠিক পুষ্টিমানসম্পন্ন খাবারদাবার এবং হালকা ব্যায়াম ও হাঁটাহাঁটির মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে এই ডায়াবেটিস। সন্তান প্রসবের পর অধিকাংশ ক্ষেত্রে শর্করা নেমে যায়, কিন্তু ভবিষ্যৎ ডায়াবেটিসের ঝুঁকি রয়ে যায় আজীবন। তাই সন্তান জন্মের পরও সুষম খাদ্যাভ্যাস, নিয়মিত ব্যায়াম, ওজন নিয়ন্ত্রণের উপদেশগুলো মেনে চলতে হবে।
নারীর জীবনের নানা পর্যায়ে নানা হরমোনের ওঠানামা তাঁর শর্করা বিপাকক্রিয়াকে মুশকিলে ফেলে দেয়। এমনই এক সময় কৈশোর। কিশোরীদের পলিসিস্টি ওভারি সিনড্রোম নামের সমস্যার সঙ্গে ডায়াবেটিস ও প্রি-ডায়াবেটিসের সম্পর্ক গূঢ়। কৈশোরে হঠাৎ ওজন বৃদ্ধি, ব্রণের সমস্যা, অনিয়মিত মাসিক এবং রক্তে শর্করা বেড়ে যাওয়ার প্রবণতা এই পলিসিস্টিক ওভারি সিনড্রোমের প্রধান লক্ষণ। এই কিশোরীরাও ভবিষ্যৎ ডায়াবেটিসের ঝুঁকিতে রয়ে যায়। এখানেও ওজন কমানো, সুষম খাবার ও নিয়মিত ব্যায়ামই সমস্যার মূল সমাধান।
ডায়াবেটিসের সাধারণ জটিলতার সঙ্গে নারীর জন্য আছে বাড়তি কিছু সমস্যা। বন্ধ্যাত্ব বা বারবার গর্ভপাত, প্রস্রাবের সংক্রমণ, যোনিপথের ছত্রাক প্রদাহ ইত্যাদি সমস্যা ডায়াবেটিস আক্রান্ত নারীর জীবন দুর্বিষহ করে তুলতে পারে। তার ওপর একজন ডায়াবেটিসে আক্রান্ত নারী সন্তান ধারণ করতে গিয়ে নিজের বিপদ ডেকে আনতে পারেন; তাঁর চোখ বা কিডনির সমস্যা এ কারণে মারাত্মক হয়ে উঠতে পারে।
ডায়াবেটিস একটি জীবনব্যাপী রোগ। এর চিকিৎসাও চলে আজীবন। অর্থনৈতিক পরনির্ভরতা এ ক্ষেত্রে অনেক সময় নারীকে নাজুক পরিস্থিতিতে ফেলে দেয়। যথাসময়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা না করা এবং ওষুধ বা ইনসুলিন ঠিকমতো ব্যবহার না করতে পারার জন্য এই অর্থনৈতিক ও সামাজিক প্রতিবন্ধকতা অনেকাংশে দায়ী। এর বাইরে আরও নানা বাধা আছে নারীর ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণের। পরিবারে সুষম খাবারের ভাগ না পাওয়া বা বাইরে হাঁটা বা ব্যায়ামের বেলায় সময়ের অভাব বা নিরাপত্তাহীনতায় ভোগার বিষয়টিও সামনে আনা দরকার। যে নারী পরিবারের সবার সুস্বাস্থ্য ও পুষ্টির বিষয়ে সচেতন, তাঁকেই দেখা যায় ঠিক সময়ে খাচ্ছেন না, ব্যায়ামের সময় বের করা তাঁর জন্য অসম্ভব বা ওষুধ-ইনসুলিন শেষ হয়ে গেলে অন্যের কাছে ধরনা দিতে হচ্ছে।
বিশ্বজুড়ে নারীদের মধ্যে ডায়াবেটিস বাড়ছে। এই রোগের সঙ্গে লড়াই করার রসদপ্রাপ্তি নারীদের অধিকার। এ বিষয়ে কেবল নারী নন, সচেতন হতে হবে সবাইকে। নজর দিতে হবে আপনার বাড়ির নারীটির দিকে।
লেখক: চিকিৎসক