শীতের আওয়াজ পাওয়া যায়

পথের ধারে গরম-গরম ভাপা পিঠা—শীত আসছে। মডেল: আবরার, লাকি ও সোহাশ, ছবি: সুমন ইউসুফ
পথের ধারে গরম-গরম ভাপা পিঠা—শীত আসছে। মডেল: আবরার, লাকি ও সোহাশ, ছবি: সুমন ইউসুফ

শীত বড় আদবকেতা জানা ঋতু! হুড়মুড় করে ঘরে ঢুকে পড়ে না।
অগ্রবর্তী দল হিসেবে প্রথমে হাজির হয় ভোরের কুয়াশা, শিশিরে ভেজা ঘাস। দরজায় টোকা দেয় ঠান্ডা বাতাস। তারপর ধীরেসুস্থে হাজির হন ‘মহাশয়’। বর্ষপঞ্জি বলছে, মহাসমারোহে মহাশয়ের আসার সময় এখনো হয়নি। তবে ওই যে বললাম, অগ্রবর্তী দল চলে এসেছে। দরজায় টোকা পড়েছে। শহুরে বাসিন্দাদের গায়ে পুরোদমে শীত লাগেনি। তবে শীত শীত লাগছে।
টিভিতে পেট্রোলিয়াম জেলি, বডি লোশন আর ময়েশ্চারাইজার ক্রিমের বিজ্ঞাপন প্রচার শুরু হয়ে গেছে এরই মধ্যে। দুপুরে শার্টের হাতা গুটিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস করছেন যে তরুণ, সন্ধ্যায় বাড়ি ফেরার সময় তাঁকে কবজির কাছে বোতাম লাগাতে হচ্ছে। আপাতত ফ্রিজে পানি রাখা বন্ধ হয়েছে অনেক বাসায়। দীর্ঘদিন ‘আত্মগোপনে থাকা’ সোয়েটার, মাফলারগুলোকে বারান্দায় ঝুলতে দেখা যাচ্ছে। ফেসবুকের হোমপেজ ভরে গেছে জনপ্রিয় টিভি সিরিজ গেম অব থ্রোনসের বিখ্যাত সংলাপে—উইন্টার ইজ কামিং। বাংলায় কেউ কেউ লিখছেন, ‘শীত আসছে’। আর কদিন পর নিশ্চয়ই সুকুমার রায়ের ছড়া থেকে ধার করে স্ট্যাটাস লেখার সুযোগ হবে—বায়ু শনশন/শীতে কনকন/কাশি খনখন...।

শীতের ‘গ্ল্যামারাস’ সবজির বেশ দাপট
শীতের ‘গ্ল্যামারাস’ সবজির বেশ দাপট


‘ঘোরে বনবন’ সিলিং ফ্যানগুলো শীত এলেই প্রায় দুই মাসের লম্বা ছুটি পায়। কম্বলের হলো শুরু, ফ্যানের হলো সারা! মুশকিল হলো, সিলিং ফ্যানটা ছুটি পেলেও স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় আর অফিসে ছুটি নেই। ভোরবেলা বিছানা ছাড়তে কী যে কষ্ট! কম্বলের নিচে তো কম ঘুমে মন ভরে না। লেপের সঙ্গে লেপটে থাকতে ইচ্ছে করে অনেকক্ষণ। এরই মধ্যে দু-একদিনের ছুটি বের করে তরুণেরা ঘুরতে বের হন দল বেঁধে। বান্দরবান, কক্সবাজার, রাজশাহী, রাঙামাটি...। হাতমোজা, পায়ের মোজা, কানটুপি, জ্যাকেটের ভেতর ঢুকে পড়ে হইহই করতে করতে ছুটে চলা, চলতি পথে মহাসড়কের পাশে একটা অচেনা চায়ের দোকানে নেমে এক কাপ চা...আহা! চায়ের দাম ৫ টাকা। তবে চায়ের কাপ দুই হাতে ধরে রাখলে যে ওমটুকু পাওয়া যায়, সেটা ফ্রি। অমূল্যও বলা যায়!

ভ্যানগাড়িতে উঠে বসেছে শীতের পোশাক, দেখে শুনে বেছে নিন
ভ্যানগাড়িতে উঠে বসেছে শীতের পোশাক, দেখে শুনে বেছে নিন


দামদর নিয়ে কথা বলতে গিয়ে সবজির বাজারের কথা মনে পড়ল। এই প্রতিবেদনের জন্য ছবি তুলতে আমরা গিয়েছিলাম হাতিরপুল কাঁচাবাজারে। বেছে বেছে ‘গ্ল্যামারাস’ একটা ফুলকপি হাতে নিতেই বিক্রেতা বললেন, ‘এক দাম ৫০ টাকা।’ একটু ঘাবড়েই গিয়েছিলাম। না জানি ছুঁয়ে দেখার দামও দিতে হয়! হাফ দামে ফুলকপি পাওয়া যাবে কবে? জানতে চেয়েছিলাম বিক্রেতার কাছে। মুখ ফিরিয়ে নিয়ে বললেন, ‘সেই দিন আর নাই...’
কারওয়ান বাজারের পিঠা বিক্রেতা রবিউলের অবশ্য এখনই দিন। বিকেল থেকে রাত পর্যন্ত জ্বলতে থাকে তাঁর আটটা চুলা। সাত পদের ভর্তা, চিতই আর ভাপা পিঠা নিয়ে বসেন তিনি। রবিউলের পিঠা খেতে তো বটেই, তাঁর সঙ্গে কথা বলতে হলেও অপেক্ষা করতে হয়। চালের গুঁড়োর সঙ্গে গুড় মেশাচ্ছেন, চুলা থেকে গরম চিতই ওঠাচ্ছেন, টাকা নিচ্ছেন...আলাপের ফুরসত নেই। এক ফাঁকে বললেন, ‘এখন ১০টা-১১টা পর্যন্ত দোকান চলে। শীত বাড়লে রাত দুইটা-তিনটা পর্যন্তও থাকি।’

চায়ের সঙ্গে ওম ফ্রি...। মডেল: বাপ্পি ও পৃথা
চায়ের সঙ্গে ওম ফ্রি...। মডেল: বাপ্পি ও পৃথা

রবিউলের মতো ব্যস্ত সময় কাটছে ফ্যাশন হাউসগুলোরও। ‘আরলি উইন্টার সেল’ ঘোষণা দিয়ে অনেকে নানা অঙ্কের ছাড়ে পুরোনো ডিজাইনের শীতের কাপড়গুলো বিদায় করেছেন। এবার নতুন নকশায়, নতুন কোনো ফ্যাশন হাজির করার পালা। ‘দেইখা লন, বাইছা লন’ হাঁক দিয়ে যাঁরা পথচারীর দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চেষ্টা করেন, তাঁদের পণ্যেও পরিবর্তন এসেছে। টি-শার্ট, স্যান্ডো গেঞ্জির জায়গা দখল করেছে সোয়েটার, মাফলার, কানটুপি। কিছুদিনের মধ্যে নিশ্চয়ই শীতের কাপড় কেনার ধুম পড়বে। সামর্থ্য অনুযায়ী কেউ যাবেন শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত শপিং মলে, কেউবা ফুটপাতের দোকানে খুঁজবেন পছন্দসই শীতপোশাক। তরুণদের কানে গোঁজা হেডফোনের অপর প্রান্তে হয়তো বাজবে অর্ণবের গান—
শীতের সন্ধ্যায়
আমার তোমার কি কোথাও হারিয়ে যাওয়ার কথা...
তারার নিচে
বাতাস বয়ে যায়
আমার তোমার কি কোথাও লুকিয়ে থাকার কথা...