আবার হোক শুরু

পড়ালেখায় একবার বিরতি পড়ে গেলে আবার শুরু করা যাবে না, এমন তো নয়। মনের জোর, ইচ্ছা আর জেদ থাকলে আপনি পারবেন
পিছিয়ে পড়া মানেই থেমে যাওয়া নয়। স্বপ্ন নিয়ে’র আয়োজনে মডেল হয়েছেন  প্রীতম, অনি, কান্তা, জামান ও সাদমান। ছবি: সুমন ইউসুফ
পিছিয়ে পড়া মানেই থেমে যাওয়া নয়। স্বপ্ন নিয়ে’র আয়োজনে মডেল হয়েছেন প্রীতম, অনি, কান্তা, জামান ও সাদমান। ছবি: সুমন ইউসুফ

ড্রপআউট, স্টাডি ব্রেক, স্কুল পালানো—শব্দগুলো এখন বেশ ‘ট্রেন্ডি’। মার্ক জাকারবার্গ, বিল গেটসরা আমাদের সামনে উদাহরণ তৈরি করেছেন। আমরা জানি, ডিগ্রি না থাকলেও সফল হওয়া যায়। কিন্তু মুদ্রার ওপিঠের গল্পটাও তো জানা থাকা দরকার। বিখ্যাত চলচ্চিত্রকার স্টিভেন স্পিলবার্গ খারাপ রেজাল্টের কারণে সাউদার্ন ক্যালিফোর্নিয়া ইউনিভার্সিটি থেকে পালিয়েছিলেন। ৩৫ বছর পর, সেই স্পিলবার্গই ক্যালিফোর্নিয়া স্টেট ইউনিভার্সিটিতে ইংরেজি বিষয়ে ব্যাচেলর কোর্সে ভর্তি হন। গায়িকা শাকিরা ২০০৭ সালে গানের ভুবন থেকে বিরতি নিয়ে ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়ায় পড়ালেখা শুরু করেছিলেন। ‘প্রাচীন ইতিহাস’ বিষয়ে একটা স্বল্পমেয়াদি কোর্স করেছেন তিনি। পড়ালেখার আনন্দ পেতেই আবার তাঁরা ক্লাসরুমে ফিরেছেন। একবার দলছুট হয়ে যাওয়ার পরও যে ইচ্ছা থাকলে আবার পড়ালেখা শুরু করা যায়, এমন অসংখ্য উদাহরণ আমাদের চারপাশে আছে।

আবার শুরুর আনন্দ
স্পিলবার্গ, শাকিরাদের কথা থাক। আপনার আশপাশে খোঁজ করলে হয়তো এমন কয়েকজন পেয়ে যাবেন, যারা দীর্ঘ বিরতি দিয়ে আবার ‘ছাত্র’ হয়েছেন। জিজ্ঞেস করে দেখুন, পড়ালেখায় ফেরার আনন্দটা তাঁরা জানেন।

আমরা যেমন কথা বলেছিলাম তানভীর আহমেদ খানের সঙ্গে। একটি মোবাইল ফোন নির্মাতা প্রতিষ্ঠানে চাকরি করছেন তিনি। উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার পরপরই পেশাজীবন শুরু করেছিলেন, স্নাতক করা হয়নি। কয়েক বছর চাকরি করে নিজেকে গুছিয়ে নিয়ে তারপর বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন তিনি। এখন একটা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে বিবিএ পড়ছেন। বলছিলেন, ‘আমার তো বেশ বড় একটা বিরতি ছিল, তাই আবার পড়াশোনা শুরু করার আগে অনেক খোঁজখবর নিতে হয়েছে। সব জায়গায় তো এই সুযোগ নেই। এখন যে নিয়মিত ক্লাস করতে পারছি, এটাই আনন্দ।’

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরকৌশল বিভাগে ২০০৯ সালে ভর্তি হয়েছিলেন কামরুজ্জামান কামরুল। শুরুর দিকে অন্য সবার মতোই নিয়মিত ক্লাস করতেন। হুট করে একসময় পড়াশোনা থেকে দূরে সরে আসেন তিনি। কেন? ‘পড়ালেখার চাপ সহ্য করতে পারছিলাম না। পড়ার চেয়ে ঘোরাঘুরি আমাকে বেশি টানে। সুযোগ পেলেই পাহাড়ে চড়ার অজুহাতে ক্লাস বাদ দিয়ে দিতাম। বেশ কয়েকটা কোর্সে খারাপ করার পর পড়ার ওপর থেকে মন উঠে গিয়েছিল।’ বলেন তিনি। ২০১৪ সালে কামরুলের সহপাঠীরা যখন সমাবর্তনের টুপি ওড়াচ্ছিলেন, তাঁর পথ তখনো অনেকটা বাকি। তাই বলে কামরুল হাল ছাড়েননি। ২০১৬ সালে তাঁর স্নাতক শেষ হয়।

উচ্চমাধ্যমিকের পর কিংবা স্নাতকের মাঝামাঝি সময়েই শুধু নয়, দীর্ঘ বিরতি নিয়ে অনেকে স্নাতকোত্তরেও ভর্তি হন। তেমন একজন আবদুল হাকিম। ১৯৯৩ সালে রাজশাহী প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (রুয়েট) থেকে প্রকৌশল বিষয়ে পড়া শেষ করেছেন। এরপর চাকরি করেছেন, ২১তম বিসিএস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে কাস্টমস ও ভ্যাট ক্যাডারে যোগ দিয়েছেন। এর মধ্যে বেশ কয়েকবার আবার পড়া শুরু করার চেষ্টা করেছেন। হয়নি। অবশেষে সাহস করে ২০১৫ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব বিজনেস অ্যাডমিনিস্ট্রেশনে (আইবিএ) এক্সিকিউটিভ এমবিএ পড়তে ভর্তি হন তিনি। ১৫ বছর যাঁর পাঠ্যবইয়ের সঙ্গে যোগাযোগ ছিল না, সেই তিনিই এখন পড়ায় মন দিয়েছেন। বলছিলেন, ‘শুরুতে একটু জড়তা ছিল। বয়সে তরুণদের সঙ্গে কীভাবে ক্লাস করব, আবার কীভাবে পড়াশোনা করব, এসব নিয়ে দ্বিধা ছিল। “যা হওয়ার হবে” ভেবে ক্লাস করা শুরু করলাম। এরপর আস্তে আস্তে মানিয়ে নিয়েছি।’

 ‘পড়াশোনায় একবার বিরতি পড়লে আবার যুক্ত হওয়া একটা কঠিন কাজ।’ বললেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তথ্যপ্রযুক্তি ইনস্টিটিউটের (আইআইটি) সহকারী অধ্যাপক বি এম মইনুল হোসেন। কঠিন কাজটা কিন্তু তিনি নিজেও করেছেন। যুক্তরাষ্ট্র থেকে পিএইচডি করার আগে কর্মজীবনে প্রবেশ করেছিলেন। দুই বছর চাকরি করে বুঝেছেন, পড়ালেখাতেই তাঁর আগ্রহ বেশি।

২৭তম বিসিএস পরীক্ষায় প্রশাসন ক্যাডারে নিয়োগ পেলেও তিনি যোগ দেননি শুধু পড়াশোনা চালিয়ে নেওয়ার জন্য। মইনুল হোসেন বলেন, ‘আমেরিকা কিংবা ইউরোপে উচ্চশিক্ষায় বিরতি থাকলেও আবার পড়ার সুযোগ থাকে। বাংলাদেশে এই সুযোগ কম হলেও ইদানীং বিভিন্ন সান্ধ্যকালীন কোর্স ও মাস্টার্সে ভর্তির সুযোগ তৈরি হয়েছে। যাঁদের পড়াশোনায় বিরতি আছে, তাঁরা মনের জোরেই আবার শুরু করতে পারেন।’

মাধ্যমিক-উচ্চমাধ্যমিকেপর বিরতি যাঁদের

মাধ্যমিক বা উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার পর যাঁদের আর পড়ালেখা করা হয়নি, চাইলে বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ে (বাউবি) যোগাযোগ করতে পারেন। বাউবিতে আবেদনের ক্ষেত্রে বয়স কোনো বাঁধা নয়। বাউবির ওপেন স্কুলের মাধ্যমে এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষায়ও অংশ নেওয়া যায়।

অধিকাংশ সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে এখন দ্বিতীয়বার পরীক্ষা দেওয়ার সুযোগ নেই। তবে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে কয়েক বছর বিরতি থাকলেও স্নাতকে ভর্তি হওয়া যায়। উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের অনার্স কোর্সগুলোতেও ভর্তি হতে পারেন। এখানে বিবিএ, বিএ, বিএসসিসহ বিভিন্ন কোর্সে ভর্তির সুযোগ আছে।

বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময়ে

বিশ্ববিদ্যালয়ের মাঝামাঝি সময়ে অনেকে পড়ালেখায় হাল ছেড়ে দেন। কারও হয়তো পড়ার বিষয়টা পছন্দ নয়, কেউ পারিবারিক চাপে পড়া বাদ দিয়ে কাজে যোগ দেন...নানা সমস্যা থাকতে পারে। প্রথমত, আপনি আপনার বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগাযোগ করে দেখুন, আবার ফেরার সুযোগ আছে কি না। বিষয় পরিবর্তন করে বা ক্রেডিট ট্রান্সফার করেও অনেকে আবার পড়ালেখা শুরু করেন। জেদ আর ইচ্ছা, এ দুটো থাকলেই কোনো না কোনো উপায় আপনি বের করতে পারবেন।

স্নাতকের পর

স্নাতক শেষ করে অনেকে ভাবেন, ‘আপাতত একটা চাকরি শুরু করি, পরে সুযোগ বুঝে স্নাতকোত্তর করা যাবে।’ অনেক সময় ইচ্ছা থাকলেও সেই সুযোগ আর আসে না। আপনার সুযোগ আসলে আপনাকেই তৈরি করতে হবে। অধিকাংশ সরকারি-বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতকোত্তর পর্যায়ে পেশাদার ও সান্ধ্যকালীন কোর্স চালু আছে। চাকরিজীবীদের কথা মাথায় রেখে অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে শুধু শুক্র-শনিবারে স্নাতকোত্তরের ক্লাস হয়। আপনার কর্মস্থল থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের দূরত্ব, সময়, টিউশন ফি—সবকিছু বিবেচনা করে সিদ্ধান্ত নিন। নিজের কাছে নিজে প্রতিজ্ঞা করুন, ‘কোনোভাবেই ক্লাস মিস করব না।’ অন্য কাজগুলো আগে গুছিয়ে রাখুন, পড়ালেখাকে গুরুত্ব দিন। তাহলে পারবেন।

সুযোগ নিজেকে তৈরি করতে হবে

‘নানা কারণে পড়াশোনায় বিরতি আসতে পারে। হোঁচট খেলেই যে বসে থাকতে হবে, তা তো নয়। আপনার পড়াশোনায় বিরতি থাকলে নিজেই সমস্যার সমাধান খুঁজে বের করুন। আর্থিক কারণে হোক কিংবা খারাপ ফলাফলের কারণেই হোক, পড়াশোনাকে একেবারে বিদায় জানানো ঠিক হবে না।’ বললেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবসায় প্রশাসন ইনস্টিটিউটের (আইবিএ) বিবিএ প্রোগ্রামের চেয়ারম্যান মো. রিদওয়ানুল হক। তিনি বলেন, ‘এখন হয়তো আপনার দিন চলে যাচ্ছে। কিন্তু পরে যেন একটা ডিগ্রি নেই বলে আফসোস করতে না হয়। ডিগ্রির জন্য অনেক সময় চাকরির পদোন্নতি আটকে থাকে, ক্যারিয়ারের অনেক সুযোগ হাতছাড়া হয়ে যায়। তাই সময় থাকতে থাকতে শুরু করুন।’