বিজয়ের নতুন নিশান

রাজধানীর মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের সামনে শহীদ বুদ্ধিজীবী রাশীদুল হাসানের নাতনি অমিয়া হাসান, শহীদ বুদ্ধিজীবী সিরাজুদ্দীন হোসেনের নাতি শৌনক রেজা এবং শহীদ সাংবাদিক সেলিনা পারভীনের নাতি সুনন্দন জওহর। ছবি: সুমন ইউসুফ
রাজধানীর মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের সামনে শহীদ বুদ্ধিজীবী রাশীদুল হাসানের নাতনি অমিয়া হাসান, শহীদ বুদ্ধিজীবী সিরাজুদ্দীন হোসেনের নাতি শৌনক রেজা এবং শহীদ সাংবাদিক সেলিনা পারভীনের নাতি সুনন্দন জওহর। ছবি: সুমন ইউসুফ

মিরপুর স্টেডিয়ামে ভরা গ্যালারিতে বসে কখনো বাংলাদেশের ক্রিকেট ম্যাচ দেখেছেন?
ধরুন, খেলা শুরু হতে আর অল্প কিছুক্ষণ বাকি। সীমানার বাইরে দাঁড়িয়ে প্রস্তুতি নিচ্ছে মাশরাফি বাহিনী। গ্যালারিজুড়ে বিক্ষিপ্ত চিৎকার, হুল্লোড়, ড্রামের শব্দ...। হঠাৎ এক কোনা থেকে একদল ছেলেমেয়ে বলতে শুরু করল, ‘বাংলাদেশ, বাংলাদেশ...’ ব্যাস! কাউকে বলে দিতে হলো না। পুরো গ্যালারি এক হয়ে সমবেত কণ্ঠে গাইল এক কোরাস।
‘বাংলাদেশ! বাংলাদেশ!’
এই কোরাস যিনি না শুনেছেন, তাঁকে বলে বোঝানো অসম্ভব। সে এক অদ্ভুত গায়ে কাঁটা দেওয়া অনুভূতি।
১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবস এলে মনে হয়, পুরো দেশটাই এক ‘গ্যালারি’ হয়ে যায়। তরুণদের টি-শার্টের বুকে আঁকা দেশের পতাকা, তরুণীদের শাড়িতে লাল-সবুজ রং, এফএম রেডিওতে দিনভর দেশের গান-এ সবই তো এখন নতুন প্রজন্মের কাছে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার নিশান। গ্যালারির মতো ‘বাংলাদেশ, বাংলাদেশ’ রব হয়তো উচ্চ স্বরে শোনা যায় না, কিন্তু দেশপ্রেমে উজ্জ্বল তরুণদের বুকে কান পাতুন, ঠিকই শুনতে পাবেন।
ঘটনাটা স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্রের শিল্পী সুজেয় শ্যামের মুখ থেকে শোনা।
১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর, সকালে কলকাতার বালিগঞ্জের সার্কুলার রোডে স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্রের অফিসে খবর পৌঁছে গিয়েছিল-আজ পাকিস্তান বাহিনী আত্মসমর্পণ করবে। বিজয়ের দিনে একটা বিজয়ের গান তো চাই। কিন্তু তখনো তেমন গান তৈরি ছিল না। গীতিকার শহীদুল ইসলাম ঝটপট কথা লিখলেন। সুজেয় শ্যাম করলেন সুর। ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে জেনারেল নিয়াজি যখন আত্মসমর্পণের দলিলে সই করছেন, তখন স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্রে বেজে উঠল-‘বিজয় নিশান উড়ছে ওই/খুশির হাওয়া ওই উড়ছে/বাংলার ঘরে ঘরে/মুক্তির আলো ওই ঝরছে...’।
গত ৪৬ বছরে বদলে গেছে অনেক কিছু। ১৬ ডিসেম্বরে শহর ছেয়ে যাওয়া লাল-সবুজ বাতি, তরুণদের পতাকার টি-শার্ট, তরুণীদের লাল-সবুজ শাড়ি, বাবার হাত ধরে স্মৃতিসৌধে যাওয়া ছোট্ট শিশুটির গালে লেখা বিজয় দিবস-এ সবই তো এখন বিজয়ের নিশান।

পোশাকে, আয়োজনে, হৃদয়ে
বর্ষপঞ্জি যখন শেষের পাতায় পৌঁছে যায়, পুরো বাংলাদেশে একটা অন্য আমেজ চোখে পড়ে। নতুন বছর আসছে, কারণ শুধু এটাই নয়। শহরের সাজসজ্জা, পত্রিকার কলাম, টিভির অনুষ্ঠানগুলো আমাদের বারবার মনে করিয়ে দেয়, এই মাসেই আমরা একটা নতুন দেশ পেয়েছিলাম।
নতুন দিনের ছেলেমেয়েরা ১৬ ডিসেম্বর দিনটা কীভাবে কাটান, জানতে কয়েকজনের সঙ্গে কথা বললাম। চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার বিজ্ঞান ও প্রকৌশল বিভাগের ছাত্রী ইফ্ফাত হোসেন ফোনে জানালেন, এই দিনে সকালে ঘুম থেকে উঠেই তিনি টিভির সামনে বসেন। বললেন, ‘বিজয় দিবসে টিভি চ্যানেলগুলোতে সুন্দর সুন্দর অনুষ্ঠান হয়। সকালে দেশের গান শুনতে ভালো লাগে। দুপুরে বিশ্ববিদ্যালয়ে যাই। বিভিন্ন অনুষ্ঠান হয় সেখানে। বাসা থেকে বের হওয়ার সময় পোশাকে লাল-সবুজ রাখার চেষ্টা করি।’ ইফ্ফাতের এই কথা বোধ হয় অনেক তরুণের সঙ্গেই মিলে যাবে।
দুই দিন আগে ঢাকার বসুন্ধরা সিটি শপিং কমপ্লেক্সের ‘দেশি দশ’-এ গিয়েছিলাম। ভেতরে পা রেখে মন ভালো হয়ে গেল। যেদিকে তাকাই, শুধু লাল আর সবুজ। শাড়ি, পাঞ্জাবি, টি-শার্ট থেকে শুরু করে মাফলারেও জায়গা করে নিয়েছে পতাকার রং। একদিকে ফ্যাশন হাউসগুলো প্রস্তুত, অন্যদিকে তরুণেরা প্রস্তুতি নিচ্ছেন নিজেদের মতো করে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শান্তি ও সংঘর্ষ অধ্যয়ন বিভাগের ছাত্র পিটার জেভিয়ার রোজারিও বলছিলেন, তাঁদের বিজয় দিবসের আয়োজন শুরু হয়ে যায় আগের রাত থেকেই। ‘১৫ তারিখ সন্ধ্যায় আমরা প্রদীপ জ্বালাই। রাত যখন প্রায় ১২টা, তখন ওড়াই ফানুস। এরপর গভীর রাত পর্যন্ত ক্যাম্পাসে কনসার্ট হয়। টিএসসির সংগঠনগুলো মিলে এই আয়োজন করে। ১৬ ডিসেম্বরেও নানা আয়োজন থাকে। আমি যেমন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চলচ্চিত্র সংসদের সঙ্গে আছি। আমরা উন্মুক্ত চলচ্চিত্র প্রদর্শনী করি।’
মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর বিজয় দিবসে খোলা থাকে। এ দিন জাদুঘরে প্রবেশ করতে কোনো টিকিট লাগে না। মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের অন্যতম ট্রাস্টি মফিদুল হক বললেন, ‘বিজয় দিবসে এই জাদুঘর সবার জন্যই উন্মুক্ত থাকে। আমার অভিজ্ঞতায় দেখেছি, বিজয় দিবসে তরুণ প্রজন্মই বেশি আসে। এ ছাড়া অনেকেই পরিবারের সদস্যদের নিয়ে জাদুঘর দেখতে আসেন।’

পোশাকেও থাকে বিজয়ের চেতনা। টিশার্ট: নিত্য উপহার
পোশাকেও থাকে বিজয়ের চেতনা। টিশার্ট: নিত্য উপহার

তৃতীয় প্রজন্মের চোখে
‘আমাদের পরিবারে ১৬ ডিসেম্বর একটু অন্য রকম। ১৪ ডিসেম্বর নানাভাইয়ের মৃত্যুবার্ষিকী, এর দুই দিন পরেই বিজয়ের দিন। আনন্দ আর কষ্টের একটা মিশ্র অনুভূতি হয়।’ বলছিলেন শহীদ বুদ্ধিজীবী রাশীদুল হাসানের নাতনি অমিয়া হাসান। রোকাইয়া হাসিনার মেয়ে তিনি। অমিয়া ছায়ানটে গান শিখেছেন। তাঁর নানাভাই গান খুব ভালোবাসতেন। নানাভাইকে গান শোনানো হলো না বলে যে মাঝেমধ্যে আফসোস হয়, সে কথাও বললেন। ডিসেম্বরের ১৪, ১৫, ১৬ তারিখে তিনি পরিবারের সঙ্গে সময় কাটাতে চেষ্টা করেন। বিজয় দিবসে শাড়ি পরে বিকেলে বন্ধুদের সঙ্গে বেড়াতে বের হন। সঙ্গ দেন নানিকে। অমিয়া বলছিলেন, ‘নানুমণির সঙ্গে আমার সম্পর্কটা একটু বিশেষ ধরনের। একসঙ্গে থাকি, এক খাটে ঘুমাই। নানু সব সময় নানাভাইয়ের গল্প বলেন। বলেন, “তোর নানাভাই থাকলে হয়তো তিনিই তোকে ছায়ানটে নিয়ে যেতেন।”’
শহীদ বুদ্ধিজীবী সিরাজুদ্দীন হোসেনের নাতি শৌনক রেজার বক্তব্যটা ভাবাল। জাহীদ রেজা নূরের পুত্র শৌনক বলছিল, ‘ছোটবেলা থেকে দাদি-বাবা-চাচার কাছে মুক্তিযুদ্ধের গল্প এত শুনেছি, আমি আমাদের জীবন থেকে মুক্তিযুদ্ধকে আলাদা করতে পারি না। মনে হয় এটা তো আমাদেরই একটা অংশ।’ বিজয় দিবসের কথা বললে তার চোখে ভাসে মোহাম্মদপুরে, দাদির বাড়ির ছবি। ‘দাদি যখন বেঁচে ছিলেন, তখন বিজয় দিবসে সকালবেলা আমরা সেখানে যেতাম। বুদ্ধিজীবীদের সন্তানদের একটা সংগঠন আছে, প্রজন্ম ’৭১। এই সংগঠনের সবাই দাদির বাসায় আসতেন। তারপর সেখান থেকে বাসে করে আমরা একসঙ্গে জাতীয় স্মৃতিসৌধে যেতাম। লাইনে দাঁড়িয়ে ফুল দিতাম।’

নতুন প্রজন্ম দিনটি পার করে বিজয়ের চেতনার মধ্য দিয়েই
নতুন প্রজন্ম দিনটি পার করে বিজয়ের চেতনার মধ্য দিয়েই

শহীদ সাংবাদিক সেলিনা পারভীনের ছেলে সুমন জাহিদ মনে করেন, মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস বাঁচিয়ে রাখার দায়িত্ব তো এখন শৌনকদের হাতেই। প্রতিবছর ১৬ ডিসেম্বর তিনি তাঁর সন্তানদের নিয়ে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে যান। তারা যেন মুক্তিযুদ্ধের কথা শোনে, হৃদয় দিয়ে অনুধাবন করে, এটাই উদ্দেশ্য। সুমন জাহিদের ছোট ছেলে, ষষ্ঠ শ্রেণির ছাত্র সুনন্দন জওহর বলল, বাবার সঙ্গে এমনই একটা বিশেষ অনুষ্ঠানের স্মৃতি তার সব সময় মনে পড়ে। ‘২০১২ সালে দাদুকে নিয়ে একটা কবিতা লিখেছিলাম। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদে একটা অনুষ্ঠানে আবৃত্তি করেছি। পরে প্রথম আলোর গোল্লাছুট পাতায় কবিতাটা ছাপাও হয়েছিল।’
পুরোনো পত্রিকা ঘেঁটে সুনন্দনের লেখা সেই কবিতা খুঁজে পাওয়া গেল। ‘আমিও’ শিরোনামের কবিতায় সে সময় ক্লাস ওয়ানে পড়ুয়া সুনন্দন লিখেছিল:

মাটি, মাটি, মাটি
আমার দেশটি কত খাঁটি।
এই আমার দেশের জন্য
প্রাণ দিয়েছেন আমার দাদি।
দেশের জন্য প্রাণ দিতে

আমিও রাজি।
সুনন্দনদের লেখায়, আঁকায়, গানেই তো বেঁচে থাকবে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা। উড়বে বিজয়ের নতুন নিশান।