বিয়ে কেন গোপন করে?

চুপি চুপি বলো কেউ জেনে যাবে...। মডেল: নীল ও ফারিহা। ছবি: সুমন ইউসুফ
চুপি চুপি বলো কেউ জেনে যাবে...। মডেল: নীল ও ফারিহা। ছবি: সুমন ইউসুফ

প্রেম, প্রণয়, পরিণয় শব্দগুলোতে কেমন যেন গোপন গোপন গন্ধ মেশানো। পাত্রপাত্রীর মুখে লাজুক হাসি, পরিচিতদের মশকরার সঙ্গে একটা রসময়তার ইঙ্গিত। বিয়ে সবাইকে জানিয়ে করাটাই রেওয়াজ। সঙ্গে থাকবে ঝলমলে উৎসব, খাওয়াদাওয়া, মধুচন্দ্রিমা আর দুই পক্ষের মিঠেকড়া খুনসুটি। বিয়ের পরও অনেক দম্পতি চালিয়ে যান গোপনীয়তার ভণিতা। কাউকে যদি দেখি বিয়ে করেও ব্যাচেলর জীবন চালিয়ে যাচ্ছেন, তখন স্বভাবতই মনে হবে, ‘এর মধ্যে ঝামেলা আছে’। পেশা, সমাজে স্বীকৃতির সংকট, অসম প্রণয়, বহু প্রণয় ইত্যাদি নানা কারণে কেউ কেউ বিয়েকে গোপন রাখতে চান।

 বিয়ে করেও না জানানোর প্রবণতা লক্ষ করা যায়?

* বিয়ে করে সে কথা লুকিয়ে রাখেন কেউ কেউ। তবে তারকা, বিশেষ করে শোবিজের তারকাদের মধ্যে এই প্রবণতা মাঝে মাঝেই দেখা যায়। অবশ্যই তা সব তারকার ক্ষেত্রে নয়।

* আঠারো বছর পেরোয়নি, তাই আইনি ঝামেলা এড়াতে বিয়ে করিয়ে গোপন রাখা হয়—এমন খবরও পাওয়া যায় মাঝেমধ্যে।

* পাশের বাড়ির লোকজন বা ‘কুটিল’ আত্মীয়স্বজন বিয়ে ভেঙে দিতে পারেন, এই ভয়েও গোপনীয়তার আশ্রয় নেন অনেকে।

* প্রেমের বিয়ে মা-বাবা বা পরিবার যদি মেনে না নেয়, সে আশঙ্কায় গোপন রাখা হয়।

* চাকরি করতে অনেকে দেশ-বিদেশে যান। সাময়িকভাবে অনেকে লুকিয়ে সংসার পাতেন।

* অনেক দিন বিয়ে হয়েছে, বাচ্চা হয় না বা পরপর তিন-চারটা মেয়ে হয়েছে বা প্রথম স্ত্রী মত দিচ্ছেন না। তখন আর কী করা? গোপনে আরেকটি বিয়ে।

* কিছু কিছু পেশা আছে, যাঁরা নির্দিষ্ট সময়ের আগে বিয়ে করতে পারেন না। সে ক্ষেত্রে বিয়ে গোপনের কাহিনি শোনা যায়।

 কিছু ঘটনা, কিছু রটনা

নিজেদের ‘ইমেজ’ ধরে রাখতে অনেক নায়ক–নায়িকা নিজেকে অবিবাহিত পরিচয়ে পরিচিত রাখতে চান ভক্তদের কথা ভেবে। তারকাখ্যাতির ধস নামবে, ব্যবসা ধ্বংস হবে, ভক্তরা অটোগ্রাফ বা সেলফির জন্য হুমড়ি খেয়ে পড়বেন না—বিয়ে গোপন করার এমন বিচিত্র সব উদ্বেগের কারণ দেখান অনেকে।

আইনের হাতকড়া পড়ার আগ্রহ না থাকলে সন্তানের বিয়ের ব্যাপারটা লুকানো স্বাভাবিক। ছেলের পরিবারের বিত্তবৈভব, সামাজিক অবস্থান বা ছেলে বাইরে চলে যাবে, তাই চুপচাপ বিয়ের কাজ সম্পন্ন করে পরিবার।

‘বিয়েভাঙানি’ শব্দটি আমাদের দেশে প্রচলিত। ছেলে অথবা মেয়ের হয়তো কয়েকটি বিয়ে পরপর ভেঙে গেছে, বাবা-মা সবাই মনঃকষ্টে আছেন। পরে জানা গেল, পাশের বাড়ির বা আত্মীয়দের কারও ওই পাত্র বা পাত্রীকে নিজেদের পরিবারে আনার খুবই ইচ্ছা ছিল। তখন তাদের এড়িয়ে বিয়ে করানোর জন্য অনেকে দূরে গিয়ে দূর আত্মীয়ের বাসায় বিয়ের আয়োজন করেন।

প্রেমের বিয়ে যতই ভালো হোক না কেন, তা পরিবারের অহংবোধে আঘাতের শামিল। তাই বিবাহিত দম্পতিরা নিজেদের পরিবারের মানসম্মান ধরে রাখার প্রয়াসে নিজেদের পায়ের তলার মাটি শক্ত করতে ব্যস্ত থাকেন। তারপর রয়ে–সয়ে জানান।

সুন্দরের প্রতি আকর্ষণ মানুষের জন্মগত। আর তার সঙ্গে যদি যৌনতাযুক্ত হয়, তাহলে তো কথাই নেই। দেশ-বিদেশে চাকরির সুবাদে অনেকে বাইরে থাকেন। সেখানে প্রতিপত্তি বাড়ানোর জন্য অনেকে জায়গায় জায়গায় বিয়ে করে থাকেন। তাই লুকিয়ে করতে হয় বিয়েটি।

 এতে কারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়?

পরিবার, সামাজিক মূল্যবোধগুলো দুর্বল হয়ে পড়ে। পারস্পরিক আস্থার জায়গাটা নড়বড়ে হয়ে যায়। সন্তানেরা নিজেদের সামনে কতগুলো স্বার্থপর লোকদের আনাগোনা দেখে বড় হয়। ফলে তারা ভবিষ্যতে কী ভূমিকা পালন করবে, নিজেরাও তা জানে না। পরিবারে সবাই কমবেশি সামাজিক ও আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

 বিপত্তি এড়াতে যা করণীয়

* বিয়ে নিয়ে গোপনীয়তা কোনো আইনি অধিকার নয়, বরং বিয়ে প্রকাশ্যে সবাইকে জানিয়ে করাই উত্তম।

* যে বিবাহ নিয়ে আইনগত সংকটের আশঙ্কা রয়েছে; তা বর্জন শ্রেয়।

* বিয়ের গোপনীয়তা অনিবার্যভাবে কিছু মারাত্মক পার্শ্বসংকট ও নেতিবাচক প্রতিক্রিয়ার জন্ম দেয়। সেসব এড়াতে সময়ের স্বীকৃতি সময়েই কল্যাণের।

* গোপন বিয়ের সন্তান হলে তাদের মানসিক বিকাশ বাধাগ্রস্ত হয়। সেটা মনে রাখতে হবে।

 সুলতানা আলগিন
সহযোগী অধ্যাপক, মনোরোগবিদ্যা বিভাগ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা