শুভ‍ + ইচ্ছা = ২০১৮

সূর্য ডোবে আবার নতুন সূর্য উঠবে বলেই। মডেল: তাজনুভা জাবীন, ছবি: কবির হোসেন
সূর্য ডোবে আবার নতুন সূর্য উঠবে বলেই। মডেল: তাজনুভা জাবীন, ছবি: কবির হোসেন

কবছর আগের কথা। পরিবারের সঙ্গে ঘুরতে গেছি নেপাল। বছরের প্রথম দিন ছিলাম পোখারায়। নতুন বছরের প্রথম সূর্যোদয় দেখার জন্য ভোর রাতেই তোড়জোড় শুরু। নানা দেশের নানা ভাষার পর্যটকেরা গায়ে এক গাদা গরম কাপড় চাপিয়ে হাতের চেয়েও লম্বা লেন্সের ক্যামেরা কাঁধে ঝুলিয়ে ছুটছেন হিমালয়ের চুড়ো দেখার নির্দিষ্ট পয়েন্টে। আমার পরিবারের সদস্যরাও বাদ পড়েনি। তবে আমি পারিনি শারীরিক কারণে। সকালের নাশতার টেবিলে শুনলাম সেই দৃশ্য নাকি অবর্ণনীয়, অপরূপ। মনটা দমে গেল। মনে হলো বছরের প্রথম দিনই না দেখা, না পাওয়ার স্বাদ পেলাম! এগিয়ে এলেন রিসোর্টের একজন কর্মী। বললেন, সূর্যোদয়ের চেয়েও সূর্যাস্তের সময়ের দৃশ্য আরও চমৎকার। চললাম, সেই দৃশ্য দেখার আশায়। ভাগ্যিস গিয়েছিলাম।

দুটি দৃশ্য আমাদের মুগ্ধ করে দিয়েছিল। এক. সরণকোটের ওই পয়েন্ট থেকে দাঁড়িয়ে মুখোমুখি দেখলাম সূর্য ডোবার আলো কী করে তার কিরণ রং মাখিয়ে দেয় হিমালয়ের চূড়ায়, অসাধারণ! দুই. দেখা হলো হল্যান্ড থেকে আসা এক ভদ্রমহিলার সঙ্গে। প্রতিবছর তিনি আসেন এই দৃশ্য দেখার জন্য। এবার তার পা ভেঙে গেছে। তবুও দমে যাননি। ক্রাচে ভর দিয়ে খাড়া সিঁড়ি ভেঙে তিনি উঠে এসেছেন এই পাহাড়ে। বছরের প্রথম দিনের সূর্য ডোবার এই অপরূপ দৃশ্যটি দেখার জন্য। আজও সেই অচেনা-অজানা মধ্যবয়সী নারীর মনোবল এবং ইচ্ছাশক্তি মনে দাগ কেটে আছে।

তাই তো, কত অল্পতেই আমরা দমে যাই। কিন্তু মন যদি সত্যিই চায় তবে কি মানুষ সহজেই দমে যায়? কী আর এমন হতো এক বছর নেপালে এসে হিমালয়কে সাক্ষী রেখে বছরের প্রথম সূর্য না দেখতে পেলে? কিন্তু প্রকৃতির কাছে যেন তার অঙ্গীকার, তাই এই ভাঙা পা নিয়েও এতটা উঁচুতে উঠে এলেন তিনি। প্রকৃতির শক্তি বোধ হয় এমনই। জীবনের চলতি পথে সিঙ্গাপুরের আরেকজন নারীকে দেখেছিলাম একবার মিয়ানমারের ইনলে লেকের ওপর রিসোর্টে বসে খালি গলায় বেসুরে গান গাইছেন। চোখে চোখ পড়তেই কৈফিয়ত দেওয়ার ভঙ্গিতে বললেন, ‘প্রকৃতি হচ্ছে আমার কাছে স্পঞ্জের মতো। ভেজা স্পঞ্জ চাপ দিলে যেমন পানি বেরিয়ে যায়, প্রকৃতির কাছে এসে ভেতরের কষ্ট স্পঞ্জের মতো চাপ দিয়ে বের করি। পরিবারের কাছের মানুষ দূরের হয়ে যাওয়া, সূক্ষ্ম অনুভূতিকে পাশে সরিয়ে রেখে কঠিনহৃদয়ে দায়িত্ব পালন করে যাওয়া, অসুস্থ মায়ের মৃত্যুর জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুত হওয়া একি কম কষ্টের! এই প্রকৃতিই সেই কষ্ট বের করে নেয়। নয়তো আমি চলব কী করে? আমি ওকে কী দিই বলো? একটা গানই জানি তাই দিই প্রকৃতিকে প্রতিবছর। হোক তা বেসুরও। ও আমাকে বোঝে।’

প্রত্যেক রাতের পরই একটা ভোর হয়। তবুও কেন মানুষ বছর শেষের ভোর কিংবা সূর্য দেখার জন্য এত উদ্‌গ্রীব থাকে? রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সেই সতর্ক বাণী—

ওরে নতুন যুগের ভোরে

দিসনে সময় কাটিয়ে বৃথা

সময় বিচার করে...

মানুষ কি নিজেই নিজের মনের সঙ্গে একবার কথাবার্তা সেরে নিতে চায়! কী হলো আর কী হলো না? কী পেলাম আর কী পেলাম না? সেই হিসাব মেলাতে চায়?

আবার ফিরে যাই নেপালে দেখা সেই অচেনা নারীর কাছে। বলেছিলেন, সবাই এখানে সকালে ছুটে আসে প্রথম দিনের প্রথম সূর্যোদয় দেখার জন্য। কী যে ভিড় হয়। অচেনা পর্যটকের কাঁধের ফাঁক দিয়ে হিমালয় দেখা, ভাবুন একবার। আমি আসি এই গোধূলির আগে। প্রথম দিনের সূর্য ডোবা দেখতে। ভিড় নেই, আপন মনে বসে থাকা যায়। মন ভরে উপভোগ করা যায়।...প্রথম দিনের সূর্য হয়তো এই শিক্ষা দেয়, তোমার অন্তর যেন তোমাকে চালায়। গড্ডলিকাপ্রবাহ নয়। তবে ঠিক তুমি ক্রাচে ভর দিয়ে হলেও উঠে যাবে খাড়া সিঁড়ি বেয়ে উঁচু পাহাড়ে।

অধুনার পাঠকদের আগাম নতুন বছরের শুভেচ্ছা। ভেঙে বলি, শুভ+ইচ্ছা = ২০১৮...।