চট করে চটে যাওয়া!

দুই বন্ধু হাসছিলেন, খাচ্ছিলেন
দুই বন্ধু হাসছিলেন, খাচ্ছিলেন

ধরা যাক জনপ্রিয় সেই অভিনেতার নাম শমিক। রাস্তাঘাটে তাঁর ভক্তরা অদ্ভুত সব আচরণ করে তাঁকে দেখলে। কেউ কেউ অটোগ্রাফ নিতে আসে, কেউ কেউ ছবি তোলে, কেউবা কিছু তির্যক মন্তব্যও ছুড়ে দেয়। একদিন শুটিং সেরে ফেরার পথে কেনাকাটা করতে একটি বিপণিবিতানে ঢুকতেই এক কিশোর শমিককে উদ্দেশ করে একটি ব্যঙ্গাত্মক কথা বলে উঠল। শমিক আর সহ্য করতে পারলেন না, উঠে গিয়ে ছেলেটির শার্টের কলার চেপে ধরলেন, দিলেন দু-এক ঘা লাগিয়ে। চারদিকে ভিড় জমে গেল। অনেকে এই ছবি তুলে ফেললেন। মুহূর্তেই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম আর অনলাইন পত্রিকাগুলোতে সেই ছবি ছড়িয়ে পড়ল।

কেবল জনপ্রিয় ব্যক্তিত্বরাই নন। যে কেউ যেকোনো মুহূর্তে রাগ করে ফেলতে পারেন। বন্ধুর জন্য অপেক্ষা করছেন, খুবই জরুরি দরকার। তিনি এলেন পাক্কা দেড় ঘণ্টা পর। এতটা সময় একা বসে বসে নিজের আঙুল কামড়েছেন আর বন্ধু আসতেই যা নয় তাই বলে গালাগালির পালা শেষ করলেন; অথবা টেবিলের পেপারওয়েটটাই ছুড়ে দিলেন তাঁর দিকে।

চট করে রেগে যাওয়া কোনো মানসিক বৈকল্য কিংবা স্নায়ুতন্ত্রের কোনো রোগ নয়। বরং প্রকৃত সুস্থ মানুষের স্বাভাবিক একটি আবেগ বা ইমোশন। সুস্থ মনের স্বাভাবিক উপাদান এই রাগ। কোনো উসকানির কারণে সামান্য বিরক্তি থেকে শুরু করে প্রবল উত্তেজনা, রাগে আগুন হয়ে হিতাহিত জ্ঞান হারানো পর্যন্ত এই আবেগের বিস্তৃতি। মানুষের ষড়রিপুর মধ্যে দ্বিতীয় স্থানে এই আবেগকে রাখা হলেও মনোবিজ্ঞানের ব্যাখ্যায় এবং শারীরবৃত্তীয় কার্যকলাপে এটি একটি সাধারণ স্বাভাবিক আবেগ।

কিন্তু যদি এই আবেগ নিয়ন্ত্রণ করা না যায়, যদি এই আবেগ অপরিমিত পরিমাণে প্রকাশ পায় বা যৌক্তিক কারণ ছাড়াই মানুষ রাগ করে, তখন দেখা দেয় নানা সমস্যা। মনোসামাজিক সমস্যা থেকে শুরু করে কোনো কোনো ক্ষেত্রে আইনি জটিলতায় পড়ার আশঙ্কাও রয়েছে।

চট করে চটে গেলেন এক বন্ধু। মডেল: নীল ও রাতুল, ছবি: কবির হোসেন
চট করে চটে গেলেন এক বন্ধু। মডেল: নীল ও রাতুল, ছবি: কবির হোসেন

মানুষের অন্যান্য আবেগের মতো রাগের কারণে শরীরে কিছু পরিবর্তন দেখা যায়—হৃৎপিণ্ডের গতি ও রক্তচাপ বেড়ে যায়, এড্রিনালিন ও নরএড্রিনালিন নামক হরমোনের নিঃসরণ বেড়ে যায়, এর সঙ্গে সক্রিয় হয় মস্তিষ্কের আবেগ নিয়ন্ত্রণের কিছু কেন্দ্র (লিম্বিক সিস্টেম, অটোনমিক নার্ভাস সিস্টেম)। শরীরের বাইরের কোনো ঘটনা যেমন আশপাশের মানুষের আচরণ, রাস্তায় যানজট বা পরিবারের কোনো সদস্যের অনাকাঙ্ক্ষিত আচরণ এবং শরীরের ভেতরের কোনো পরিবর্তন যেমন ব্যক্তিগত কোনো সমস্যা নিয়ে দুশ্চিন্তা বা অতীতের কোনো অপ্রাপ্তির বেদনা থেকেও রাগের প্রকাশ হতে পারে। নিয়ন্ত্রিত রাগ যেহেতু মানুষের স্বাভাবিক আবেগ, তাই এর কিছু ভালো দিকও ব্যাখ্যা করেছেন বিজ্ঞানীরা। বলা হয়, যেকোনো ধরনের পারিপার্শ্বিক হুমকির (শারীরিক, মানসিক) সঙ্গে অভিযোজিত হওয়ার জন্য আমাদের দেহ ও মনের স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া এই রাগ। প্রতিকূল পরিবেশে রাগের মাধ্যমে শুরু হওয়া আমাদের আচরণগত পরিবর্তন সেই প্রতিকূল পরিস্থিতিকে অতিক্রম করতে পারে। তাই নিয়ন্ত্রিত রাগ সব সময় খারাপ নয়।

সবাই কিন্তু সমানভাবে রাগে না, কেউ রাগ করে কাপ-পিরিচ ভাঙে, কেউ উচ্চ স্বরে চিৎকার করে, কোনো কারণে কেউ ধুম করে রেগে ওঠে, কেউ অন্যকে আঘাত করতে এগিয়ে যায়—যাদের আমরা বলি মাথা গরম। আবার কেউবা তার চাইতে বেশি রাগের কারণেও খুব বেশি বহিঃপ্রকাশ ঘটায় না, তবে পারিপার্শ্বিকতা থেকে নিজেকে শামুকের মতো গুটিয়ে নেয়। এই যে একেকজনের রাগের প্রকাশ যে একেক রকম, তার মূলে রয়েছে জেনেটিক, পারিবারিক ও সামাজিক প্রভাব। জটিলতাপূর্ণ পরিবার ও বাবা-মায়ের মধ্যে অশান্তিময় দাম্পত্য সম্পর্ক সন্তানকে সহজেই রেগে যেতে সহায়তা করে। সংঘাতময় রাষ্ট্র, রাজনৈতিক অস্থিরতা, বর্ণবৈষম্য, সামাজিক ন্যায়বিচারের অভাব, প্রতিষ্ঠান পরিচালনায় দ্বৈতনীতি ইত্যাদি সামাজিক কারণেও ব্যক্তির রাগের প্রকাশ ভিন্নতর হতে পারে।

যাঁরা জনপ্রিয় ব্যক্তিত্ব যেমন খেলোয়াড়, অভিনেতা, শিল্পী, সাহিত্যিক বা বিশিষ্ট কোনো পদধারী মানুষ, তাঁরা সব সময় একটা সামাজিক চাপে থাকেন! এই চাপ অনেক সময় তাঁদের রাগের বহিঃপ্রকাশকে অনিয়ন্ত্রিত করে ফেলতে পারে, যা তাঁদের ক্যারিয়ারের জন্য অনেক সময় ক্ষতিকর হয়ে যায়। রাগ প্রকাশের ক্ষেত্রে তাঁদের আরও বেশি দায়িত্ববান হতে হবে। তাঁরা যেন কখনোই মনে না করেন যে ‘জনপ্রিয়তা’ তাঁদের সব ধরনের আবেগের অনিয়ন্ত্রিত বহিঃপ্রকাশের অনুমোদন দিয়েছে।

রাগের মতো সাধারণ আবেগটি যাতে অনিয়ন্ত্রিতভাবে প্রকাশ না পায়, সে জন্য মার্কিন বিজ্ঞানী গার্লস স্পিয়েলবারগার রাগের নিয়ন্ত্রিত প্রকাশভঙ্গির কথা উল্লেখ করেছেন। তাঁর গবেষণায় তিনি বলেছেন, রাগকে পুরোপুরি চেপে রাখা যাবে না, একবারে দমন করা যাবে না; কারণ অবদমিত রাগ থেকে হতে পারে নানাবিধ মানসিক ও শারীরিক সমস্যা; হতে পারে বিষণ্নতা, উচ্চরক্তচাপ, খিটখিটে মেজাজ, বিশ্বনিন্দুক চরিত্রের মালিক।

অবদমিত রাগের কারণে হতে পারে ব্যক্তিত্বের সমস্যা। রাগের প্রকাশ হতে হবে গঠনমূলক, দৃঢ় কিন্তু মোটেই আক্রমণাত্মক নয়। যা কিছু চাওয়ার, তা চাইতে হবে অন্যকে আঘাত না করে আর যা কিছু না চাওয়ার, তা বর্জন করতে হবে অন্যের প্রতি সম্মান রেখে। যে বিষয়টি নিয়ে রাগ হচ্ছে, সেটিকে কেবল নিজের দিক থেকে না দেখে প্রায় ৩৬০ ডিগ্রি ঘুরিয়ে আনতে হবে দৃষ্টিভঙ্গি, আর তাতেই বিষয়টি উপস্থাপিত হতে পারে ভিন্নমাত্রায়, বদলে যেতে পারে আপনার রাগের প্রকাশভঙ্গি, বদলে যেতে পারে আচরণ। সেই সঙ্গে নিজের ভেতরে নিয়ে আসতে হবে স্থিরতা, যুক্তিগ্রাহ্য, যা কেবল মানসিক প্রশান্তিই আনবে না বরং উৎকণ্ঠা, উচ্চরক্তচাপ বা বিষণ্নতার মতো জটিল রোগ থেকে রক্ষা করবে।

হুট করে রাগ নয়

কিছু পদ্ধতির মাধ্যমে রাগকে নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়, নিজেদের ব্যক্তিগত জীবনে যার চর্চা করলে আমরা চট করে রেগে যাওয়াকে নিয়ন্ত্রণে আনতে পারব—

*    বলা হয়, ‘যুক্তি রাগকে পরাজিত করে’। তাই রাগের লাগাম হিসেবে যুক্তির বিকল্প নেই, কারও ওপর বা কোনো ঘটনার ওপর রাগ করলে ভেবে দেখুন ঘটনাটি কেন ঘটেছে। আপনার রাগ করার যথার্থ কারণ থাকলেও যুক্তির প্রয়োগে আপনি সেই কারণটিকে একপাশে সরিয়ে রাখতে পারেন।

*    রাগের কারণ ঘটলে নিজের শরীরকে যতটা সম্ভব শিথিল করে ফেলুন—বড় করে শ্বাস নিন, কোনো গঠনমূলক ছোট বাক্য যেমন ‘ঠিক আছে’ ‘শান্ত হও’ বারবার উচ্চারণ করতে পারেন। ভালো কোনো সুন্দর দৃশ্য, আপনার প্রিয়জনের মুখচ্ছবি মনে করতে পারেন।

*   প্রতিদিন অক্সিজেনযুক্ত মুক্ত বাতাসে হাঁটুন, বড় করে শ্বাস নিন। প্রিয়জনদের সঙ্গে সময় কাটান এবং তাদের নিয়ে অবসরে বেড়িয়ে আসুন।

*   অভিভাবকেরা কখনোই শিশুদের সামনে রাগ করবেন না। আপনাদের এই আচরণের প্রভাবে শিশুরা পরিণত বয়সে রাগ নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে না।

*    আলাপচারিতার সময় ‘কখনোই না’ ‘সব সময়ই’ ‘অবশ্যই’ এ-জাতীয় শব্দচয়ন পরিহার করতে পারেন। কর্মক্ষেত্রে সহকর্মী বা অধস্তনদের সঙ্গে কথোপকথনে আদেশজাতীয় বাক্যের পরিবর্তে অনুরোধের সুরে কথা বলুন। এভাবে ইতিবাচক ভঙ্গিতে কথা বলা অভ্যাস করলে কেবল নিজের রাগকে যে নিয়ন্ত্রণ করা যায় তা-ই নয়, বরং আশপাশের মানুষও রাগ করার কারণ খুঁজে পায় না।

*   প্রতিদিনের ব্যস্ততার মধ্যে কিছু না কিছু সময় নিজেকে দিন। নিজেকে নিয়ে ভাবুন, সারা দিনে কী করলেন বা কী করবেন সেটা মনের মধ্যে সাজিয়ে নিন।

*    নাটক সিনেমা চলচ্চিত্রে রাগী ব্যক্তিত্বের নায়কের অনুকরণে দর্শকদের মধ্যে রাগের বহিঃপ্রকাশ ঘটতে পারে। তাই নির্মাতাদের প্রয়োজনে দায়িত্বশীল হতে হবে।

*    কোনো কিছু মুখ দিয়ে উচ্চারণ করার আগে বা কিছু করার আগে একটু ভাবুন, আপনার এই কথা বা আচরণে আরেকজনের প্রতিক্রিয়া কী হতে পারে। নিজেকে প্রশ্ন করুন, আপনি যা বলতে যাচ্ছেন বা করতে যাচ্ছেন, তা আরেকজনের মুখ থেকে শুনলে বা আরেকজন করলে আপনার প্রতিক্রিয়া কী হতো।

*    বিকল্প চিন্তা করার ক্ষমতা অর্জন করুন। যেমন কারও একটি খণ্ডিত আচরণে তার ওপর রাগ করে কোনো সিদ্ধান্ত নেবেন না। তার আচরণের পেছনের কারণগুলো বুঝতে চেষ্টা করুন।

*    হাসার অভ্যাস করুন। হাসলে আপনি খেলো হয়ে যাবেন, আপনার ব্যক্তিত্ব হালকা হয়ে যাবে, তা কখনোই ভাববেন না। ব্যক্তিগত জীবনে আর কর্মক্ষেত্রে নির্মল হাস্যরসের চর্চা করুন।

*    যেকোনো ধরনের মাদক গ্রহণ করা থেকে বিরত থাকুন। কারণ মাদক গ্রহণ করলে আবেগ নিয়ন্ত্রণের সক্ষমতা কমে যায়। তখন মানুষ মাদক গ্রহণ না করা অবস্থাতেও হুট করে রেগে যায়।

*    রাগের মাথায় কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া থেকে বিরত থাকুন। পরে ভেবেচিন্তে কারও সঙ্গে পরামর্শ করে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করুন।

*          বিষণ্নতা, অবসেশন, ব্যক্তিত্বের সমস্যা, শিশু-কিশোরদের কনডাক্ট ডিসঅর্ডার ইত্যাদি মানসিক সমস্যার কারণে রাগের অনিয়ন্ত্রিত বহিঃপ্রকাশ হতে পারে। তাই ক্রমাগত রাগ নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে প্রয়োজনে মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞের পরামর্শ গ্রহণ করতে পারেন।

আহমেদ হেলাল

সহযোগী অধ্যাপক, জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট, ঢাকা।