সময় বড় নাকি জীবন?

গাড়ির অনিয়ন্ত্রিত গতি টেনে আনতে পারে করুণ পরিণতি। ছবি: খালেদ সরকার
গাড়ির অনিয়ন্ত্রিত গতি টেনে আনতে পারে করুণ পরিণতি। ছবি: খালেদ সরকার

দুটি ঘটনা। প্রথমটা নিজের। দিন কয়েক আগে রাতের বাসে উত্তরাঞ্চলে গিয়েছিলাম। কুয়াশাচ্ছন্ন রাত। দীর্ঘ যানজটে গাড়ির মোটামুটি অনড় অবস্থা। স্বাভাবিকভাবেই যাত্রীদের মধ্যে বিরক্তি চরমে। এমন সময় জানা গেল, যানজটের উৎস যমুনা সেতু। তীব্র কুয়াশায় নিরাপত্তার জন্য সেতুর ওপরে যান চলাচল নিয়ন্ত্রিত। এই খবর বেশ কাজে দিল। মুখগুলোর কঠিন রেখা নরম হতে থাকল। সবাই বলতে শুরু করলেন, সময় বড়, তবে জীবনের চেয়ে নয়।

দ্বিতীয় ঘটনা এক কলেজ শিক্ষার্থীর। ঢাকায় সপরিবার থাকতেন। স্বজনদের সঙ্গে বেড়াতে গিয়েছিলেন ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক ধরে। বাহন ছিল মাইক্রোবাস। ফেরার পথে বেশ রাত হয়েছিল। কুয়াশা ছিল। কুমিল্লার দেবীদ্বার উপজেলার চরবাকর এলাকায় গত মঙ্গলবার রাত তিনটায় ঘন কুয়াশায় মাইক্রোবাসের নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে দুঃখজনক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারান তিনি।

ঘন কুয়াশায় সড়ক দুর্ঘটনার খবর এবার প্রায়ই আসছে। কারণ সাম্প্রতিক বছরগুলোর তুলনায় এবার শীতের প্রকোপ যেমন বেশি, কুয়াশাও তাই। দুর্ঘটনা বেশি ঘটছে রাতে। তাই বলে তো রাতে চলাচল বন্ধ রাখা যায় না। এর চেয়ে বরং সতর্কতা অবলম্বন করে দুর্ঘটনার সম্ভাবনা কমিয়ে আনা যেতে পারে বলে মনে করেন মো. বেলাল হোসেন। দুই যুগের বেশি সময় ধরে তিনি গাড়ি চালনার সঙ্গে যুক্ত। প্রথমে বাসচালক হিসেবে কাজ করেছেন। ১৫ বছর হলো মাইক্রোবাস চালাচ্ছেন।

মার্কার দেখে চলতে হবে

বেলাল হোসেন বলেন, কুয়াশায় সড়ক দুর্ঘটনার বেশির ভাগ হয় নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে রাস্তা থেকে সরে গিয়ে। এ জন্য রাস্তায় থাকা মার্কার ও রিফ্লেকটর দেখে চলতে হবে। বিশেষ করে সাদা দাগের বাইরে যাওয়া যাবে না। তবে চট্টগ্রাম ও সিলেটে যাওয়ার হাইওয়ে বাদ দিলে অধিকাংশ রাস্তায় এই মার্কার হয় মুছে যাচ্ছে, না-হয় মুছে গেছে। এটা বড় একটা সমস্যা।

জরুরি বাতি জ্বালিয়ে রাখতে হবে

কুয়াশায় ইমারজেন্সি ও ফগ বাতি জ্বালিয়ে গাড়ি চালনার কথা বলেন বেলাল হোসেন। এতে একই রাস্তায় থাকা অন্যান্য গাড়িচালকেরা আপনার গাড়ির অবস্থান সম্পর্কে জানতে পারবেন। এতে তাঁরাও সতর্ক হওয়ার সুযোগ পাবেন।

মাঝে মাঝে বিরতি দিতে হবে

সহজাত অভ্যাসে রাতে ঝিমুনি আসতে পারে। সে ক্ষেত্রে করণীয় কী? বেলাল হোসেন বলেন, ‘আমরা যেমন দু-তিন ঘণ্টা পর পর গাড়ি চালনায় বিরতি দিই, চোখেমুখে ঠান্ডা পানির ঝাপটা দিই, চা-কফি পান করি। আর রাতে গাড়ি চালানোর সময় আমি প্রচুর পান খাই। সেই অভ্যাস না থাকলে চুইংগাম চিবানো যেতে পারে। মোদ্দা কথা, একটা কাজের মধ্যে থাকা, ঝিমুনি যেন নিজেকে কাবু না করতে পারে।’

সামনের গাড়ি থেকে নিরাপদ দূরত্ব

কুয়াশায় চালানোর সময় গাড়ির গতি কম রাখতে হবে। আর সামনের গাড়ি থেকে নিরাপদ দূরত্ব বজায় রাখতে হবে। যেন সামনের গাড়ি হঠাৎ ব্রেক কষলে গাড়ি থামানোর পর্যাপ্ত সময় পাওয়া যায়।

চালকের জন্য বিশেষ প্রশিক্ষণ

গ্রিন লাইন পরিবহনের মহাব্যবস্থাপক মোহাম্মাদ আবদুস সাত্তার বলেন, ‘আমাদের দেশের সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো চালকদের কোনো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা থাকে না। আমরা যেমন অনেক বাছাই করে নিয়োগ দিয়ে থাকি, নিয়োগের পরে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করি, বেশির ভাগ পরিবহনেই তা মানা হয় না। আমাদের দেশে ঘন কুয়াশায় চালকেরা গাড়ি চালান রাস্তার পাশের গাছ দেখে। এতে দুর্ঘটনার ঝুঁকি বাড়ে। আমরা বাসে ফগ লাইট লাগিয়েছি। কুয়াশা যদি খুব বেশি হয়, তবে পার্কিং বাতি জ্বালিয়ে পেট্রলপাম্পে পার্ক করে রাখতে হবে। হাইওয়েতে পার্ক করা যাবে না।’

দূরের যাত্রায় দ্বিতীয় চালক

যাত্রা দূরের হলে সঙ্গে আরেকজন চালক থাকলে একজন বিশ্রাম নিতে পারেন। তবে আমাদের দেশে এমনটা মানা হয় না। সরকারিভাবেও কোনো নির্দেশনা নেই বলে উল্লেখ করেন আবদুস সাত্তার। তিনি বলেন, ‘আমাদের তো বটেই, অন্য কোনো বাসেও দ্বিতীয় চালক রাখা হয় না। বাসচালকদেরও এতে আপত্তি। এমনকি ফিরতি পথে অন্য চালককে দিলেও তাঁরা আন্দোলন করে বসেন।’

চালকের সুস্থতা

রাতের দীর্ঘ ভ্রমণের আগে চালকের শরীর সুস্থ কি না, দিনে পর্যাপ্ত ঘুমিয়েছেন কি না, সেটা খেয়াল রাখতে হবে। হালকা মাথাব্যথা, শরীর ব্যথা, ক্লান্ত থাকলে বা পেটের সমস্যা হলে গাড়ি চালানো যাবে না।