কাগজের কারিগর

কাগজের তৈরি এসব পণ্য দিয়ে নিজেকে ও পরিবারকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন এই নারীরা l ছবি: প্রথম আলো
কাগজের তৈরি এসব পণ্য দিয়ে নিজেকে ও পরিবারকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন এই নারীরা l ছবি: প্রথম আলো

২৩ বছর ধরে কাগজ দিয়ে নানা পণ্য তৈরি করে পরিবারকে একটু একটু করে এগিয়ে নিয়ে গেছেন রিনা দেউরী। ছেলে হয়েছেন দন্ত চিকিৎসক ও মেয়ে নার্সিং কোর্স সম্পন্ন করেছেন। আরেক নারী নিভা বৈদ্য। ২৪ বছর ধরে কাগজের পণ্য তৈরির পেশার সঙ্গে জড়িত। বড় মেয়ে স্নাতক শ্রেণিতে পড়ছেন, ছেলে নবম শ্রেণির ছাত্র। একই রকম গল্প কানন রায় ও তানিয়া বেগমের। ফুলশ্রী গ্রামের তানিয়া বেগম বললেন, ‘স্বামী শারীরিক সমস্যার জন্য কাজ করতে পারেন না। আমিই একমাত্র কর্মজীবী।’ 

ধানখেতে কচুরিপানা জমে আবাদ নষ্ট করে ফেলে। ফলে কচুরিপানা কখনো কখনো কৃষকের কাছে ‘অভিশাপ’ হয়ে দেখা দেয়। কিন্তু বরিশাল অঞ্চলে কচুরিপানা হয়েছে আশীর্বাদ। কচুরিপানা দিয়ে তৈরি হচ্ছে কাগজ ও কাগজের নানা পণ্য। হাতে তৈরি এই কাগজের দেশের চেয়ে বিদেশে কদর বেশি। তাই এসব পণ্য রপ্তানি হচ্ছে নানা দেশে। কচুরিপানার কাগজ ও পণ্য তৈরির কাজটা করছে বিবর্তন নামের একটি সংগঠন। রিনা দেউরী, কানন রায়, তানিয়া বেগমের মতো অনেক নারী এখানে কাজ করেন। মানে এই প্রতিষ্ঠানের অধিকাংশ কর্মী নারী।
বিবর্তনের হাতে তৈরি কাগজ প্রস্তুত প্রকল্পের সংস্কারক কিরণ শংকর প্রথম আলোকে বলেন, ‘সাধারণত এই কাগজ হালকা বাদামি রঙের হয়। গ্রাহকদের চাহিদা অনুযায়ী সাধারণ রং ব্যবহার করা হয়। পরিবেশবান্ধব রাখার জন্য ক্ষতিকারক কোনো রং এখানে ব্যবহার হয় না। ৩০ রকম ফটোফ্রেম, ৬০ ধরনের নকশার ফটো অ্যালবাম, ৫০ ধরনের বাক্স, ৩০০ ধরনের নোটবই, ৪০ ধরনের হাতব্যাগ, ৭০ রকম নকশার নিমন্ত্রণ কার্ডসহ ৪ হাজার নকশার পণ্য তৈরি করছি আমরা।’ বিবর্তনের এই প্রকল্পের নাম নেওয়া হয়েছে কর্ম সৃষ্টি প্রকল্প। মূলত নারীদের জন্য কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করাই প্রতিষ্ঠানের মূল উদ্দেশ্য। বিধবা, স্বামী পরিত্যক্তা এবং অসহায় নারীদের প্রতিষ্ঠান এটি। এখানে পণ্য উৎপাদন থেকে রপ্তানি প্রক্রিয়া—সব কাজে সম্পৃক্ত সবাই নারী।
একসময় এই প্রতিষ্ঠানে কাজ করতেন রেবা সরকার। পরে তিনি বরিশালের আগৈলঝারা উপজেলার গৈলা ইউনিয়নের ১ নম্বর ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য নির্বাচিত হন। তিনি বলেন, ‘২০০১ সালে নির্বাচনের পর আমার স্বামীকে মেরে হাত পা ভেঙে দেওয়া হয়। এ সময় আমাদের আয়ের পথ বন্ধ হয়ে যায়। তখন এই কাজে আশার আলো দেখি। কাজ করে সংসার চালিয়ে গেছি। ২০১১ সালে ইউপি নির্বাচনে অংশ নিই ও বিজয়ী হই।’
১৯৭০ সালের কথা। ম্যাননাইড সেন্ট্রাল কমিটি (এমসিসি) নামের আন্তর্জাতিক সংস্থা বাংলাদেশে আসে কর্মসৃষ্টি প্রকল্প নিয়ে। তারা সহজে এবং প্রকৃতিকে কাজে লাগিয়ে কর্মসংস্থান সৃষ্টির জন্য বাংলাদেশে বিভিন্ন অঞ্চলে গবেষণা পরিচালনা করে। ওই গবেষণার অংশ হিসেবে ফেলে দেওয়া বা পরিত্যক্ত ময়লা-আবর্জনা কাজে লাগানোর উদ্যোগ নেয় সংস্থাটি। ১৯৯০ সালে বরিশালের আগৈলঝারা অঞ্চলে কচুরিপানাকে কীভাবে কাজে লাগানো যায় তার ওপর গবেষণা শুরু করেন তাঁরা। ১৯৯৩ সালে বিবর্তন নামে একটি সংগঠন গড়ে তোলা হয়। বিবর্তনের কর্মীরা কচুরিপানা এবং ফেলে দেওয়া কাগজ, কাপড় দিয়ে পুনরায় হাতে কাগজ তৈরির উদ্যোগ নেন। সেই উদ্যোগ প্রগতির পথে চলছে আজও। ২০০৮ সাল থেকে বিবর্তন প্রকৃতি বাংলাদেশ নামে পরিচালিত হচ্ছে একটি পরিচালনা পরিষদের মাধ্যমে।

কাগজের মণ্ড তৈরি করছেন
কাগজের মণ্ড তৈরি করছেন

বিবর্তনের ব্যবস্থাপক সজল কৃষ্ণ দত্ত বলেন, ১৯৯৬ সালে এক বছরে ৮৫ হাজার টাকা আয় করে প্রতিষ্ঠানটি। ২০১১-১২ অর্থবছরে আয়ের পরিমাণ দাঁড়ায় ২ কোটি ৮০ লাখ টাকা। ২০১২-১৩ অর্থবছরে আন্তর্জাতিকভাবে অর্থনৈতিক মন্দার পরও ১ কোটি ১৫ লাখ টাকা আয় হয়। ১৬-১৭ অর্থবছরেও এক কোটি টাকার বেশি আয় হয়েছে। বর্তমানে আগৈলঝারার ৫টি ইউনিটে ৬০০ নারী কর্মী কাজ করেন।
সম্প্রতি আগৈলঝারা উপজেলার জোবাপাড় এলাকায় গিয়ে কচুরিপানা কাটতে দেখা গেল এক বয়স্ক নারীকে। তাঁর নাম কমলা বৈরাগী। তিনি জানান, দীর্ঘ ২৪ বছর ধরে কচুরিপানা কাটার কাজ করছেন। খাল-বিল থেকে তিনিসহ অনেক নারী কচুরিপানা কেটে নিয়ে যান বিবর্তন সংস্থায়। সেখানে তাঁদের হাতের ছোঁয়ায় কচুরিপানার সঙ্গে ফেলে দেওয়া কাগজ মিশিয়ে তৈরি হচ্ছে নতুন কাগজ। সব প্রক্রিয়া হাতে-কলমে সম্পন্ন হওয়ায় এটাকে হাতে তৈরি (হ্যান্ড মেইড পেপার) কাগজ বলে। এই প্রকল্পের সুপারভাইজার মিতালী হালদার জানালেন, হাতে তৈরি কাগজ দিয়ে লেখা, কম্পিউটার প্রিন্ট কাগজ ছাড়াও নোটবুক, ব্যাগ, অ্যালবাম, ফটো ফ্রেম, নিমন্ত্রণ কার্ড, কাগজের গয়না, ফাইল তৈরি হয়। সব মিলিয়ে প্রায় পাঁচ হাজার ডিজাইনের উপকরণ তৈরি হচ্ছে এখানে।
বাজার ও চাহিদা: বরিশালের আগৈলঝারার বিবর্তনের উৎপাদিত হাতে তৈরি কাগজ ও পণ্যর সবচেয়ে বেশি চাহিদা রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র, ইংল্যান্ড, জাপান, হংকং, নিউজিল্যান্ড, সুইজারল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া, জার্মানি, ইতালি, ফ্রান্স, স্পেন, সুইডেন, ডেনমার্ক, নেদারল্যান্ডস, দক্ষিণ কোরিয়া, তাইওয়ান ও ভারতে।
বাংলাদেশেও এর চাহিদা বাড়ছে। ঢাকার মোহাম্মদপুরে নিজস্ব বিপণনকেন্দ্র রয়েছে। ঢাকা ক্র্যাফট বাজার এবং হোটেল ওয়াশিংটনে প্রতি মাসে একটি প্রদর্শনী মেলার আয়োজন করা হয়।