চাঁদের আলোয় বর্ষবরণ

তাঁবু ফেলে চাঁদের আলোয় নতুন বছরকে স্বাগত জানানোর পর্ব। ছবি: ওয়াইল্ড অ্যাডভেঞ্চার
তাঁবু ফেলে চাঁদের আলোয় নতুন বছরকে স্বাগত জানানোর পর্ব। ছবি: ওয়াইল্ড অ্যাডভেঞ্চার

আকাশের দিকে তাকিয়েই মনটা উদাস হয়ে গেল। ধোঁয়া আর কুয়াশার ভেতর দিয়ে এত বড় চাঁদটাকে খুঁজেই পাওয়া যাচ্ছে না। তার ওপরে দুই দিন পরেই নতুন বছর। মাথায় ভূত চাপল চাঁদের আলোয় নতুন বছর উদ্যাপনের। যেখানে বিশাল এক লেক থাকবে, পাহাড় থাকবে, লেকে নৌকা থাকবে, ইচ্ছা হলেই মাঝরাতে ঝাঁপিয়ে পড়তে পারব চাঁদগলা রুপালি জলে। চূড়ান্ত ঠান্ডায় হি হি করে কাঁপতে কাঁপতে উঠে এসেই গনগনে ধোঁয়া ওঠা বারবিকিউতে কামড় বসাব! আহা, এই তো জীবন! চোখ বুঁজেই অসাধারণ দৃশ্যটা কল্পনা করে ফেললাম।

এই ধুলার শহরে চোখ না হয় বন্ধ করে রাখা যায়, কিন্তু নাক তো বন্ধ রাখার উপায় নেই! ধুলার ধাক্কায় কেশে উঠলাম! সুতরাং স্বপ্নটাকে বাস্তবে রূপ দেওয়ার জন্য খুঁজতে শুরু করলাম এমন জায়গা আছে কোথায়! শুধু ‘থার্টি ফার্স্ট নাইট’ থেকেই পরদিন ভোঁ দৌড় দিতে হবে, কারণ অফিসের শেকলে উড়ুক্কু মনটা বাঁধা। কথা হলো চট্টগ্রামের লিমন ও আরমান ভাইয়ের সঙ্গে! দুজনই এক পায়ে খাঁড়া, ‘ভাই চলে আসেন মিরসরাই। এখানে লেকের সঙ্গে, চাঁদের সঙ্গে আর এক আকাশভর্তি তারার সঙ্গে স্বাগত জানাব নতুন বছরকে।’

তাঁবু থেকে দেখা
তাঁবু থেকে দেখা


পরদিন সকালেই ব্যাগ তৈরি। গন্তব্য মিরসরাইয়ের বাউয়াছড়া হ্রদ।
ঢাকা থেকে মিরসরাই খুব বেশি দূরে নয়, দুপুরে রওনা দিয়ে শেষ বিকেলে পৌঁছে গেলাম লুকিয়ে থাকা নীল সবুজের রাজ্যে। মিরসরাইয়ের এই লেকটার চারপাশ পাহাড়ে ঘেরা। যে পাশে আমরা তাঁবু ফেলেছি, সেখানটা বাদে বাকি তিন দিকে ঘন অরণ্য। শেষ বিকেলের আলোয় চোখের সামনে নীলাভ এই লেক দেখে হতবিহ্বল অবস্থা আমাদের! জানতাম যে শীতকালে এই লেকের পানি অন্য চেহারা নেয়। ঝলমলে নীলে রাঙিয়ে দেয় তার পুরো শরীর আর সেখানে সবুজাভ ছায়া ফেলে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে মাথা না নোয়ানো গাছের সারি। এবার তার শীতের রূপ সামনাসামনি দেখে হতভম্ব আমরা। অদ্ভুত সেই নীল, অপূর্ব তার রূপ। মুহূর্তেই বিদেয় করে দিল ঢাকা টু মিরসরাই ভ্রমণের ধকল।

বার বি কিউর আয়োজন করতে করতেই ঘুটঘুটে রাত। লোকারণ্যের ঠিক পাশেই এমন অরণ্যের বিলাস এদিকে খুব একটা দেখা যায় না। এক পাহাড়ভর্তি জোনাকি জ্বলজ্বল করে মশাল জ্বালিয়ে দিল সুনসান লেকপাড়ে। সেখানে তখন চলছে আমাদের তাঁবুবাসের প্রস্তুতি। আলো ভাই তাঁর প্রিয় গিটার নিয়ে এসেছেন। তাঁকে ঘিরে বাকি সবার দোল দোল দুলুনি। এক পাশে গনগনে আগুনের কয়লা, অন্য পাশে ঝিরঝিরে ঝরনার মাদকতা সঙ্গী করে লিমন ভাই ধরলেন নতুন বছরের গান। সেই গানের আহ্বানে সাড়া দিয়ে পুব আকাশে ঝলমল করে উঠল পূর্ণিমার চাঁদ। হাজার বছরের সেই শান্ত সোনালি চাঁদ। তার রূপের জৌলুশের প্রথম ছটা পড়ল বাউয়াছড়া লেকের গায়ে। সেখান থেকে প্রতিফলিত হয়ে সবার চোখে-মুখে।

বারবিকিউর সব আয়োজন শেষ। বনের নেশা ধরানো বাতাসের সঙ্গে মিশেছে পোড়া মুরগির সুবাস। যেন বর্ষবরণের এক নতুন আহ্বান! রাতে লেকের পানিতে পা ডুবিয়ে চাঁদের চোখে চোখ রেখে গুনেছি প্রহর শুরুর ঘণ্টা।

নীল আর সবুজ লেকের পানিতে ঝলমলে মিরসরাইয়ের বাউয়াছড়া হ্রদ
নীল আর সবুজ লেকের পানিতে ঝলমলে মিরসরাইয়ের বাউয়াছড়া হ্রদ

একসময় গান শেষ হলো, খাওয়া শেষ হলো, রাত শেষ হলো, চাঁদের আলোও ফুরাল। তবু ফুরাল না আমাদের আনন্দ আয়োজন। সেই আয়োজনে ভোরবেলাতেই যোগ হলো লেকের পানিতে গোসল! ভোরের আলোয় তীব্র শীতে ধোঁয়া উঠছে বিশাল লেকজুড়ে। সেখানেই লাফিয়ে পড়ল না ঘুমানো ট্র্যাভেলারদের দল! এই লেকে এখন নৌকা রয়েছে, চাইলে বোটে করেই ঘুরে বেড়ানো যায় ঘণ্টার পর ঘণ্টা। রোদ একটু চড়তেই আমরা ছুট লাগালাম ঝরনা দেখার জন্য। এখানে বর্ষায়ও এসেছিলাম। একেক সময়ে এই লেকের রূপ একেক রকম। সব রূপেই সে সুন্দর।

এই লেক ঘিরে তিনটা ঝরনা আছে, তবে শীতে সেগুলো শুকিয়ে কাঠ! বন দেখতে যখন বের হয়েছি, তখন কাঠও দেখে আসব—এই নীতিতে হাপুস-হুপুস করে ঝাঁপিয়ে পড়লাম ‘হরিণমারা কুণ্ড’ ঝরনায়। এই মৌসুমে এখানের পানিও সুইমিংপুলের পানির মতো পরিষ্কার। হাড় কাঁপানো ঠান্ডায় পানি কাঁপানো লাফালাফিতে শেষ হয়েছিল আমাদের সেদিনের ঝরনাযাত্রা।

যেভাবে যাবেন
ঢাকা-চট্টগ্রাম রুটের গাড়িতে উঠে মিরসরাই নেমে যাবেন। সেখানে যে কাউকে বললেই বাউয়াছড়া লেক দেখিয়ে দেবে। রাস্তা থেকে হেঁটে ট্রেনলাইন পেরিয়ে ১৫ মিনিট গেলেই চোখে পড়বে পাহাড়ঘেরা জল-জঙ্গলের আশ্চর্য এই জায়গা।