উঠল বাই...

ব্যাগ গুছিয়েই বেরিয়ে পড়ুন চেনা-অচেনা কোথাও। মডেল: বাপ্পা ও পায়েল, কৃতজ্ঞতা: জিন্দা পার্ক, ছবি: কবির হোসেন
ব্যাগ গুছিয়েই বেরিয়ে পড়ুন চেনা-অচেনা কোথাও। মডেল: বাপ্পা ও পায়েল, কৃতজ্ঞতা: জিন্দা পার্ক, ছবি: কবির হোসেন

‘ড্রাইভার পাহাড় না সমতলের?’ নিজের দিকে তাকিয়ে বলি, ‘সমতলের।’

ফোনের ওপার থেকে প্রথম আলোর বান্দরবান প্রতিনিধি বুদ্ধজ্যোতি চাকমা একটু শঙ্কিত হয়েই বললেন, ‘আপনি নিজে গাড়ি চালিয়ে চিম্বুক-নীলগিরি যাবেন?’

‘খাগড়াছড়ির অভিজ্ঞতা আছে।’ আশ্বস্ত করার চেষ্টা।

‘তবুও...। এগুলো বেশি খাড়া পাহাড়।’ বুদ্ধজ্যোতি চাকমার মনে তখনো শঙ্কা।

রাঙামাটি থেকে তাঁর সঙ্গে কথা হচ্ছিল ৩১ ডিসেম্বর বিকেলে। কিছুক্ষণ আগেই চট্টগ্রাম থেকে কাপ্তাই হয়ে পৌঁছেছি রাঙামাটি। হঠাৎ করেই বাই উঠল বছরের প্রথম দিন বান্দরবান যাব। সেখান থেকে পরদিন চিম্বুক আর নীলগিরি। সঙ্গে পরিবার। বলার পর তাদের উৎসাহ আরও বেশি। বান্দরবান ফাইনাল।

৩১ ডিসেম্বর, বছরের শেষ দিন সকালে রওনা দিয়েছিলাম চট্টগ্রাম থেকে। রাউজান, রাঙ্গুনিয়া হয়ে কাপ্তাই। আগেই জানা ছিল ওয়াসার কাজ চলছে, রাঙ্গুনিয়া পর্যন্ত রাস্তা ভাঙাচোরা। তবে যা শোনা গিয়েছিল রাস্তা পাওয়া গেল তার থেকে অনেকটাই ভালো। রাঙ্গুনিয়া প্রতিনিধি আব্বাস হোসাইন আফতাব যোগ দিলেন আমাদের সঙ্গে। কাপ্তাই যাওয়ার পথে রাঙ্গুনিয়ার শেখ রাসেল এভিয়ারি অ্যান্ড ইকোপার্ক দেখার কথা বললেন। আমরা থামলাম। সুন্দর হ্রদ, পাহাড়ের ফাঁকে ফাঁকে পাখির বড় বড় খাঁচা। তবে এই পার্কের যেটা মূল আকর্ষণ সেই কেব্‌ল কার এখন বন্ধ। পাহাড়ধসে কেব্‌ল কারের খুঁটি ক্ষতিগ্রস্ত। ময়ূরসহ কিছু পাখির খাঁচা দেখা হলো, মনটা পুরোপুরি ভরল না।

কাপ্তাইয়ে কর্ণফুলী, ওপারে চা–বাগান। ছবি: লেখক
কাপ্তাইয়ে কর্ণফুলী, ওপারে চা–বাগান। ছবি: লেখক

ছুটলাম কাপ্তাইয়ের পথে। ছেলেমেয়ে উত্তেজিত কায়াকিং নিয়ে। আব্বাস বললেন, ‘কাপ্তাই হ্রদে কায়াকিং করবেন না কর্ণফুলী নদীতে।’ সাঁতার জানি না, কিন্তু নদী থাকতে হ্রদ কেন? ঠিক করলাম নদীতেই নামব। রাঙ্গুনিয়া ছাড়াতেই পাহাড়ি রাস্তা, দুপাশে বড় বড় গাছ। আমরা সোজা থামলাম কায়াক ক্লাবে।

কর্ণফুলী নদী এখানে তিন দিকে বয়ে গেছে। দূরে জলবিদ্যুৎ প্রকল্প। আর কায়াক ক্লাবের ওপারেই চা-বাগান। ফাইবারের তৈরি এই নৌকায় দুজন করে বসলাম। শুরু হলো বৈঠা বাওয়া। শার্টের ওপর পরা হয়েছে লাইফ জ্যাকেট। কায়াক নিয়ে এগোলাম তর তর করে। বেশ খানিকটা দূরত্বই হয়ে গেল, ফেরার সময় সেটা টের পাওয়া গেল। উল্টো স্রোতে বৈঠা বাওয়া বেশ কষ্টেরই। শীতল আবহাওয়াতেই ঝরল ঘাম। তখন দুপুর। খিদে জানান দিচ্ছে ভালোই। কাছেই ফ্লোটিং প্যারাডাইস। আসলেই যেন স্বর্গ। খাবার টেবিলের জানালা দিয়ে কর্ণফুলী নদী, চা-বাগান সবই উপভোগ্য। খাবার? সেটাও। আলুভর্তার কথা তো ভোলাই যাচ্ছে না।

কাপ্তাই থেকে রাঙামাটি। অসাধারণ এক রাস্তা। এক পাশে কাপ্তাই হ্রদ অন্য পাশে নানা রকম পাহাড়। উঁচু-নিচু ঢাল, আঁকাবাঁকা পথ। এ পথে পাওয়া গেল দুটি রেস্তোরাঁ। কায়াকিং, বোটিংয়ের সুবিধাও রয়েছে।

রাঙামাটির পর্যটন মোটেলে যখন পৌঁছালাম, তখন শেষ বিকেল। ব্যাগট্যাগ রেখেই কাছের ঝুলন্ত ব্রিজে একচক্কর। ‘থার্টি ফার্স্ট নাইট’—তাই আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা তৎপর। সন্ধ্যার পর বাইরে জটলা নয়। রাতের খাবার শহরের আইরিস রেস্তোরাঁয়। কারণ, এখানকার পাহাড়ি খাবার।

রাঙামাটি থেকে কাপ্তাই হয়ে চন্দ্রঘোনার ফেরি পার হয়ে বান্দরবান। ১ জানুয়ারি এই হলো যাত্রাপথ। কখনো সমতল, কখনো পাহাড়, কখনো ঢাল। সন্ধ্যা নাগাদ বান্দরবান। ঠিক হলো নীলাচলটা দেখা যাক। আসলে নীলগিরির আগে একটা ট্রায়াল আরকি। নীলাচল থেকে পুরো বান্দরবান শহরই দেখা যায়। সন্ধ্যায় ওপর থেকে বেশ আলোকিতই দেখা গেল বান্দরবান। নীলাচলে বনভোজন বা দলবেঁধে বেড়ানোর আয়োজন পুরোপুরিই রয়েছে। চাইলে কটেজে রাত কাটানো যায়। স্থানীয় লোকজনের বেশ কিছু দোকান আছে এখানটায়। বিভিন্ন চালের ভাপা পিঠা যেমন আছে, তেমনি আছে জুমচাষের ফল।

নীলগিরির ওপর থেকে
নীলগিরির ওপর থেকে

২ জানুয়ারি সকালে বের হলাম চিম্বুক-নীলগিরির পথে। বক্ষ দুরুদুরু থাকলে গাড়ি চালাতে সমস্যা, তাই ভয়ডর চেপে রাখতেই হলো। বছর সাতেক আগে বেড়ানো হয়েছিল বান্দরবান। তখন বর্ষাকাল। পাহাড় সবুজ ভেলভেট। শীতকালে কি অত সুন্দর থাকবে?

মিলনছড়ি পৌঁছাতেই পাহাড়ের সৌন্দর্য বোঝা গেল। ‘আই অ্যাম অ্যাট মিলনছড়ি’ কাঠের বড় ফ্রেমের মধ্য দিয়ে দূরে তাকাতেই নিচে বয়ে যাওয়া নদী। পাহাড়ের রং এখন নীল। সাদা মেঘ ভেসে ভেসে যায়। সূর্য নেই তাতেও অপার্থিব এক আবহ।

নীলগিরির আগেই চিম্বুক। অবধারিত বিরতি। এর মধ্যে পেরোচ্ছি ঝুঁকিপূর্ণ, অতিঝুঁকিপূর্ণ বাঁক, ঢালু, অতিঢালু রাস্তা। দুপাশে পাহাড়ের ছবি একটু পর পর পাল্টে যাচ্ছে। চিম্বুকের থেকেও উঁচুতে নীলগিরি। দূরে তাকিয়ে দেখা যায়, রাস্তা খাড়া উঠে গেছে। কোথাও কোথাও মনে হচ্ছে গাছে গাছে মেঘ ধরেছে।

শেষমেশ রাস্তা বেয়ে নীলগিরি। একেবারে যেন মেঘে ঢাকা। দূরের মেঘ চলে এল কাছে। ৩০ ফুট দূরত্বও মিলিয়ে যায় দৃষ্টিসীমা থেকে। ক্যানটিনে প্যাকেজ লাঞ্চ যখন খাচ্ছি তখন জানালার ওপারে মেঘ।

ফেরার সময় পাওয়া গেল সূর্যের আলো। নীল পাহাড়ের মাথাটা সাদা, উপত্যকা রোদের আলোয় সবুজ, এক-দুটি পাহাড়ি বাড়ি যেন রূপকথার রাজ্যে নিয়ে যায়। মনে যে কত গান গুন গুন করে...।