বন্ধু কেন বন্ধুর প্রতি নিষ্ঠুর?

বন্ধুত্ব হবে নির্ভরতার, িনষ্ঠুরতার নয়। ছবি: সুমন ইউসুফ
বন্ধুত্ব হবে নির্ভরতার, িনষ্ঠুরতার নয়। ছবি: সুমন ইউসুফ

‘উত্তরায় কিশোর খুন’; ‘বন্ধুর হাতে বন্ধু খুন’; ‘গ্যাং কালচারের নামে ভয়ংকর হয়ে উঠছে যে কিশোরেরা’; ‘চট্টগ্রামে কুকুর লেলিয়ে কিশোরকে হত্যা করেছে বন্ধুরা’, ‘চট্টগ্রামে বাসা থেকে ডেকে নিয়ে প্রকাশ্য রাস্তায় পিটিয়ে যুবক খুন’—এই শিরোনামগুলোর নিচে আদনান, সুদীপ্ত, হিমু, দিয়াজ আরও কত তরুণ-কিশোরের নাম ছাপা হয়েছে পত্রিকার পাতায়! তারা নির্মমভাবে খুন হয়েছে। গভীর পরিতাপের বিষয় তাদের বেশির ভাগই খুন হয়েছে বন্ধু বা চেনাজানা সমবয়সীদের হাতে।

গণমাধ্যমে আমরা জানতে পারি এক বন্ধু আরেক বন্ধুর বুকেই ছুরি চালায়, বন্ধুরাই ছাদ থেকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেয় আরেক বন্ধুকে অথবা কয়েকজন মিলে ধাওয়া করে মাটিতে ফেলে পিটিয়েই মেরে ফেলে সমবয়সী কিশোরকে। কখনো কুকুর লেলিয়ে দিয়ে মেরে ফেলা হয় কাছের বন্ধুটিকে! খবরের শিরোনাম হয়, অভিভাবকেরা আঁতকে ওঠেন, সংবেদনশীল পাঠকের দুই চোখ টলমল করে কিন্তু মৃত্যুর এ মিছিল যেন থামেই না।
কোথায় তবে সমস্যা? বন্ধু কেন বন্ধু থাকতে পারে না, কিসের এত রাগ-ক্ষোভ বা হিংসা যা একজন মানুষকে মুহূর্তেই দানবে পরিণত করে। বন্ধু কেন এত নিষ্ঠুর? স্কুল-কলেজে আমাদের সন্তানেরা যা পড়ছে তা কি তাদের হিংস্র করে তোলে? পারিবারিক শিক্ষাগুলো কী তাদের সহনশীল করতে পারে না, নাকি প্রযুক্তি আর প্রচারযন্ত্রগুলো তাদের অসহিষ্ণু আচরণের জন্য দায়ী? মনে করা ঠিক হবে না যে বিষয়টি কেবল আমাদের দেশের মধ্যেই সীমাবদ্ধ, বিশ্বজুড়েই এই অসহিষ্ণুতা। মানুষের মন আর সমাজ নিয়ে যাঁরা গবেষণা করেন তাঁরা এই নিষ্ঠুরতা, নৃশংসতার কারণ খুঁজে বের করার চেষ্টা করেছেন।
মানুষের মনের গঠনে তিনটি উপাদান রয়েছে। ইড, ইগো আর সুপার ইগো। আমাদের সব কামনাবাসনার চাহিদা নিয়ন্ত্রণ করে ইড। সে কেবলই আমাদের তৃপ্ত করতে চায় যেভাবেই হোক না কেন। আমাদের নৈতিকতার মধ্যে বেঁধে রাখতে চায় সুপার ইগো। এই দুই এর মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করে ইগো। এর ভারসাম্য রক্ষা করাকে বলা যেতে পারে ইগো ডিফেন্স মেকানিজম। মানুষ যখন ইড দ্বারা পরিচালিত হয় তখন তার মধ্যে পাশবিক প্রবৃত্তিগুলো মাথাচাড়া দেয়। নিষ্ঠুরতা আর হিংস্রতার পেছনে থাকে ইডের প্রভাব। ফলে একজন বন্ধু যখন আরেকজন বন্ধুকে আক্রমণ করে তখন তার সুপার ইগো পরাজিত হয়, এলোমেলো হয় ইগো ডিফেন্স ফলে সে মানবিক গুণাবলি হারাতে থাকে। এখন কে কীভাবে ইগোকে প্রতিহত (ডিফেন্স) করবে, কীভাবে ইডের প্রভাববলয় থেকে নিজেকে রক্ষা করবে তা নির্ভর করে তার শৈশবরে বিকাশ, পারিবারিক পরিবেশ, সামাজিক শিক্ষা, প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা এবং তার সমাজ ও সংস্কৃতির ভৌত কাঠামোর ওপর।
শিশুর জ্ঞানীয় বিকাশ (কগনিটিভ ডেভেলপমেন্ট) আর নৈতিকতার বিকাশের (মোরাল ডেভেলপমেন্ট) পর্যায়গুলো যদি অস্বাভাবিক হয় তখন তার মধ্যে হিংস্রতা আর নিষ্ঠুরতা দেখা দিতে পারে। মানুষের নৈতিকতার বিকাশের পর্যায় ব্যাখ্যা করতে গিয়ে মার্কিন গবেষক লরেন্স কোহলবার্গ তিনটি স্তরের বর্ণনা দেন। জন্ম থেকে প্রথম কয়েক বছর শাস্তি এড়াতে শিশুরা নিয়মকানুন মেনে চলে, এরপর বয়ঃসন্ধিতে নিজের কাজের স্বীকৃতির জন্য সামাজিক রীতিনীতির সঙ্গে একাত্ম হয় ‘ভালো ছেলে’ বা ‘ভালো মেয়ে’ অভিধায় তারা ভূষিত হতে চায়।
নৈতিকতার বিকাশের তৃতীয় স্তরে যা শুরু হয় ১৬-১৭ বছর বয়সের দিকে, সে নৈতিকতাকে নিজস্ব ধারণার জগতের সঙ্গে মিলিয়ে নিজের মতো করে ব্যাখ্যা দিতে থাকে। তার ধারণার জগতে যদি বিশ্বাস করে এই সমাজ, এই প্রচলিত রীতিনীতি ‘সঠিক নয়’, তখন সে তার চারপাশকে পরিবর্তন করতে চায়। পরিবর্তনের পন্থা হতে পারে প্রচলিত পদ্ধতিতে অথবা তার নিজস্ব বিশ্বাসের মতো করে। এই পরিবর্তনের যেকোনো পথকে সে নিজস্ব যুক্তি দিয়ে ব্যাখ্যা করে। একজন তরুণের মনস্তত্ত্ব এখানেই নিষ্ঠুরতা আর উগ্রতায় মোড় নেয়। সে উগ্রবাদ আর নিষ্ঠুরতাকে সে ন্যায্য বলে মনে করে। নিষ্ঠুরতা, নির্মমতা আর হিংস্রতা তার কাছে নিজের প্রাপ্তিটুকু বুঝে নেওয়ার উপায় মাত্র। সেখানে বন্ধু-প্রিয়জন নিতান্তই মূল্যহীন।
যেখানে সংস্কৃতি আর অর্থনীতি একটা বেসামাল সন্ধিক্ষণে মধ্যে দিয়ে যায় সেখানে এই নিষ্ঠুরতা অনেকটাই প্রকট। রঙিন বাতি, এলইডি বিজ্ঞাপন, আকাশছোঁয়া কাচের বাড়ির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে প্রসারিত হতে পারেনি তারুণ্যের মন। শিশুর মানবিক বিকাশ বারবার হোঁচট খেয়েছে সামাজিক অনৈতিক প্রথার কাছে। সবচেয়ে বড় কথা বিষয়গুলো আমরা স্বীকারই করি না; কখনো অজ্ঞানতার কারণে আবার কখনো জেনেবুঝে বিষয়গুলোকে অস্বীকার করছি।
অনেক সময় মনে হতে পারে ‘তুচ্ছ’ কারণে এতখানি নির্মমতা-বন্ধুকে খুন করে ফেলা! কিন্তু প্রকৃতপক্ষে যে এই কাজটি করছে তার কাছে কারণটি মোটেই ‘তুচ্ছ’ নয়। তার জ্ঞানীয় ধারণা (কগনিশন) সেই ‘তুচ্ছ’ বিষয়টিকে অনেক বড় করে দেখে তখন তার নৈতিক ধারণা (মোরালিটি) তাকে বাধ্য করে হিংস্র আচরণ করতে। হয়তো সামান্য কিছু টাকার জন্য, কখনো বা তার পছন্দের মেয়েটির জন্য বন্ধুকে হত্যা করতেও দ্বিধা করে না। কখনো কোনো শিশু যদি ছোটবেলায় শারীরিক বা মানসিক নির্যাতনের শিকার হয় তখন ভবিষ্যতে তার মধ্যে হিংস্রতা বা আগ্রাসী মনোভাব তৈরি হতে পারে।
কিশোর-তরুণদের আগ্রাসী আচরণের সঙ্গে দুটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় জড়িত। একটি হচ্ছে মাদক আরেকটি শিশু-কিশোরদের মানসিক সমস্যা। মাদক মাত্রই রাসায়নিক পদার্থ। যা গ্রহণ করলে একসময় মস্তিষ্কের স্বাভাবিক কার্যাবলি ব্যাহত হয়। আমরা বলি, মানবের মধ্যে দানব ঢুকে গেছে। এই মাদক নামক দানবের প্রভাবে একজন তরুণ ভুলে যায় তার নৈতিকতা, শিক্ষা আর সভ্যতা। নির্মমতা আর নৃশংসতা তখন তার মধ্যে কোনো অনুশোচনা আনে না।
পত্রিকার পাতায় প্রকাশ হওয়া এই কিশোর-তরুণদের প্রায় বেশির ভাগ অপরাধের সঙ্গে মাদকের সংশ্লিষ্টতার প্রমাণ পাওয়া গেছে। মাদক সেবনের সঙ্গে অবধারিতভাবে সংযুক্ত হয়ে যায় অপরাধ-চোরাই মোবাইল ফোন কেনাবেচার ব্যবসা, ছিনতাই, চাঁদাবাজি, উত্ত্যক্তকরণ, হুমকিসহ নানা অপরাধে জড়াতে জড়াতে একসময় নিজেদের মধ্যে শুরু হয় দ্বন্দ্ব আর সংঘাত—সেখান থেকে হত্যার মতো বড় অপরাধ। আর শিশু-কিশোরদের যে মানসিক সমস্যাটিকে বেশির ভাগ সময়ই গুরুত্ব দেওয়া হয় না তার নাম হচ্ছে কনডাক্ট ডিস-অর্ডার (আচরণের সমস্যা)। এই সমস্যায় আক্রান্ত শিশুকে আমরা মনে করি অবাধ্য বা বেয়াদব। তারা মিথ্যা কথা বলে, চুরি করে, অন্যের সঙ্গে সহজেই বিবাদে জড়ায়, উত্ত্যক্ত করে, সামাজিক নিয়মনীতি ভঙ্গ করে, সামাজিক অপরাধ করে, স্কুল পালায়, নেশা করে, অনেক সময় কিশোর গ্যাংয়ের জড়িয়ে যায়। পারিবারিক ও সামাজিকভাবে এই বিষয়গুলোকে রোগ হিসেবে ভাবা হয় না, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে এটি বিশ্বজুড়ে স্বীকৃত শিশু-কিশোরদের একটি মানসিক রোগ। এই কনডাক্ট ডিস-অর্ডার থেকে হত্যার মতো অপরাধও ঘটে থাকে।
প্রযুক্তি আর প্রচারমাধ্যমের প্রভাবেও হিংস্রতা দেখা দেয়। আমেরিকান সাইকোলজিক্যাল অ্যাসোসিয়েশন দুই বছর বয়সের নিচের শিশুদের টিভি না দেখার পরামর্শ দিয়েছে। কিছু গেম রয়েছে যেখানে আক্রমণ আর প্রতি-আক্রমণের কৌশলগুলো চর্চা করা হয়, এই গেমগুলো শিশু-কিশোরদের মধ্যে হিংস্রতা তৈরি করে বলেও গবেষণায় দেখা গেছে। উত্তেজক ওয়েবসাইট থেকেও কিশোরদের মধ্যে নৃশংসতা তৈরি হতে পারে। কখনো কোনো ভ্রান্ত বিশ্বাস যা তারা একধরনের আদর্শ বলে মনে করে যেমন উগ্রবাদ, জঙ্গিবাদ, ধর্মীয় উন্মত্ততা ইত্যাদি থেকেও কিন্তু তরুণদের মধ্যে হিংস্রতা দেখা দেয় এবং হিংস্র আচরণের জন্য তাদের কোনো অনুতাপবোধ হয় না।

* পরিবারে নৈতিকতার চর্চা করুন। শিশু বেশির ভাগ নৈতিকতাই রপ্ত করে পরিবার থেকে। তাই শিশুর সামনে কোনো অনৈতিক আচরণ করবেন না বা অনৈতিক আচরণকে উৎসাহিত করবেন না।
* শিশুর সামনে বা সরাসরি শিশুর সঙ্গে কোনো নিষ্ঠুর আচরণ করা যাবে না। নিষ্ঠুর আচরণের শিকার শিশুদের মনোবৃত্তি আগ্রাসী হয়ে যায়। শিশুর অবাধ্য আচরণকে সমর্থন না করে তাকে শৃঙ্খলা শেখান।
* টেলিভিশন, মোবাইল ফোন বা কম্পিউটারে আক্রমণাত্মক বা হত্যার দৃশ্য দেখা থেকে শিশুকে বিরত রাখুন। ছোট ছোট আগ্রাসী দৃশ্য শিশুর মনে বড় প্রভাব ফেলতে পারে। অনেক সময় হত্যার দৃশ্য দেখে সে আরেকজনকে হত্যা করতে উদ্বুদ্ধ হতে পারে। ভালো সিনেমা আর অনুষ্ঠান দেখতে তাদের উৎসাহিত করুন।
* সন্তান মাদক নিচ্ছে কি না, সেদিকে খেয়াল রাখুন, মাদক গ্রহণ শুরু করামাত্র তাকে চিকিৎসার আওতায় আনুন।
* সন্তানের মধ্যে অবাধ্য আচরণ বা কনডাক্ট ডিস-অর্ডারের লক্ষণ দেখলে দ্রুত মনোরোগ বিশেষজ্ঞের মাধ্যমে চিকিৎসার ব্যবস্থা করুন।
* বন্ধু কারা সে সম্পর্কে বাবা-মা যেন নির্বিকার না থাকেন। বন্ধুদের বাবা-মার সঙ্গে পরিচিত হন। তাদের বাসা চিনে রাখুন।
* সন্তানের মধ্যে হঠাৎ করে কোনো জঙ্গিবাদের লক্ষণ (উগ্রপন্থার সমর্থনে বই পড়া, আচরণের পরিবর্তন, কথাবার্তার পরিবর্তন ইত্যাদি) দেখা দিলে সতর্ক হন। তার সঙ্গে কথা বলুন ও প্রয়োজনে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পরামর্শ নিন।
* আপনার সন্তান কী বই পড়ছে, কোন ধরনের ওয়েবসাইটে ঢুঁ মারছে সেগুলো আপনিও জানুন। তবে গোপন নজরদারি নয়, সন্তানের সঙ্গে খোলামেলা সম্পর্ক বজায় রেখে তার কাছ থেকেই জানুন।
* সন্তানের হাতে হঠাৎ দামি মোবাইল ফোন দেখলে, তাকে আপনার দেওয়া হাতখরচের বাইরে বেশি বেশি টাকা খরচ করতে দেখলে সতর্ক হন। এগুলোর উৎস জানুন।
* তার সামনে পারিবারিক কলহ পরিহার করুন, পরিবারকে সুন্দর ও সুশৃঙ্খল রাখুন।
* ছোটবেলা থেকে সন্তানদের মধ্যে পরমতসহিষ্ণুতা শেখান, বিশেষত আরেকজনের ধর্মীয় মূল্যবোধ বা বিশ্বাসকে সম্মান করতে শেখান। সন্তানের সামনে তার বন্ধু, সহপাঠী, শিক্ষক বা আত্মীয়ের নিন্দা করবেন না।
* বিপরীত লিঙ্গের প্রতি শিশু-কিশোরদের আকর্ষণ স্বাভাবিক, প্রাকৃতিক প্রক্রিয়া। বিষয়টি বাবা-মাকে সহজভাবে নিতে হবে। সন্তানের সঙ্গে এ বিষয়ে
তার বয়সোপযোগী আলাপ-আলোচনা করুন, পাশাপাশি বিপরীত লিঙ্গের প্রতি তার সম্মানবোধ তৈরির চেষ্টা করুন।
* স্কুলের শিক্ষাক্রমগুলোকে আরও বেশি মানবিক করার চেষ্টা করুন। শিশু-কিশোরেরা একটা বড় সময় স্কুলে কাটায়, ফলে শিক্ষকের আচরণ অনেক সময় তাদের ওপর প্রভাব ফেলে। তাই সেখানে সব ধরনের নিষ্ঠুরতা, বিদ্রূপ বা তুলনা পরিহার করতে হবে।
* সন্তানদের বিশ্বসাহিত্যের আলোচিত বইগুলো পড়তে দিন। তাদের মধ্যে পাঠাভ্যাস গড়ে তুলুন।
* সফলতার মতো ব্যর্থতাও জীবনের একটি অনুষঙ্গ, সন্তানকে ব্যর্থতা মেনে নেওয়ার শিক্ষা দিন, এ জন্য বাবা-মাকেও ব্যর্থতা মেনে নেওয়ার চর্চা করতে হবে। তাকে ‘হতেই হবে,’ ‘পেতেই হবে’ এমন লক্ষ্য দেওয়া থেকে বিরত থাকুন।
* সন্তানের কোনো অপরাধের পক্ষেÿ সাফাই গাইবেন না। তার কোনো অপরাধ ঘটলে আপনি নিরপেক্ষ মতামত দিন। স্নেহের বশবর্তী হয়ে সন্তানকে আগ্রাসী আর হিংস্রতার দিকে ঠেলে দেবেন না।


সহযোগী অধ্যাপক, জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট, ঢাকা।