আমরা পারি, আমিই পারি

>৪ ফেব্রুয়ারি ছিল বিশ্ব ক্যানসার দিবস। সচেতনতাই পারে সময় থাকতে ক্যানসারকে চিহ্নিত করতে। ক্যানসারের বিরুদ্ধে যুদ্ধ রোগীর একার নয়, পরিবারেরও
ক্যানসারের বিরুদ্ধে যুদ্ধ রোগীর একার নয়, পরিবারেরও যুদ্ধ। সবাই মিলে লড়তে হবে। ছবি: সুমন ইউসুফ
ক্যানসারের বিরুদ্ধে যুদ্ধ রোগীর একার নয়, পরিবারেরও যুদ্ধ। সবাই মিলে লড়তে হবে। ছবি: সুমন ইউসুফ

 এক.
তিল একটা রোমান্টিক বিষয়।
পৃথিবীতে কত লাখ দিস্তা কাগজ যে খরচ হয়েছে প্রিয়ার গালের তিল নিয়ে কবিতা লেখায়। যিনি কবি তিনি লেখেন। যিনি কবি না, তিনি আরও বেশি লেখেন।

মধ্যযুগের মহাকবি আলাওল তাঁর পদ্মাবতী কাব্যে নায়িকার গালের একটা তিলের বর্ণনা দিতে গিয়ে লিখেছেন ঝাড়া দেড় পৃষ্ঠা। আর পারস্য সাহিত্যের মহাকবি হাফিজ তো তুর্কি এক নারীর এই তিলের বিনিময়ে বিলিয়ে দিতে চেয়েছিলেন সে সময়ের সবচেয়ে সমৃদ্ধিশালী দুই নগর সমরখন্দ আর বোখারা!

পত্রিকায় চোখ বোলাচ্ছিলেন জামিল সাহেব। ‘তিল’ শব্দটি কানে আসতেই টিভির দিকে তাকালেন। কথা বলছেন মধ্যবয়সী কেউ একজন। পর্দায় নাম দেখলেন। কথা বলছেন একজন চিকিৎসক—‘পৃথিবীর সব পুরুষের প্রতি আমার আহ্বান। প্রিয় মানুষের গালের তিলের দিকে অবশ্যই তাকাবেন, তবে খুঁতখুঁতে চোখে। দীর্ঘদিন ধরে যে তিলটি দেখছেন, তাঁর মধ্যে হঠাৎ কোনো পরিবর্তন এল কি না! দ্রুত বড় হয়ে যাওয়া, আকৃতি কিংবা রং পরিবর্তন, খসখসে হয়ে যাওয়া। চাপ দিলে বা আপনাআপনি রক্ত বা কষ বের হওয়া।

এমন কিছু হলে কবিতার খাতা রেখে প্রিয় মানুষকে হাসপাতালে বা কোনো চিকিৎসকের কাছে নিয়ে যান। এটুকু বলে নিঃশব্দ হাসলেন চিকিৎসক। বেশ রসিক মনে হলো তাঁকে জামিল সাহেবের।

তিনিও হাসতে চাইলেন। কিন্তু পারলেন না। মাঝপথে আতঙ্ক এসে গ্রাস করল তাঁকে। উঠে প্রায় দৌড়ে চলে গেলেন রান্নাঘরে, যেখানে স্ত্রী রানু সকালবেলার ব্যস্ততা সামাল দিচ্ছেন। একরকম জোর করে তাঁকে আয়নার সামনে দাঁড় করালেন। তাঁর মনে পড়ে গেছে, রানুর ঘাড়ের বাঁ দিকটার একটা তিল বেশ বড় ও খসখসে হয়ে গেছে। একটুখানি রক্ত বের হয়েছিল একদিন।

সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললেন। কালই রানুকে ক্যানসার সার্জনের কাছে নিয়ে যাবেন। এক দিনও সময় নষ্ট করবেন না।

 দুই

কাশিটা কি বাড়ল? মানুষটা বেশ কষ্ট পাচ্ছে। আগেও হয়েছে অনেকবার। দু–চার দিনে সেরে যেত। এবার কী হলো? দিন দিন বেড়েই চলেছে। আদা-চা, লেবু-চা—কাজ হলো না। মোড়ের দোকান থেকে কাশির ওষুধও এনে খেল। শেষে গঞ্জের পরিচিত কম্পাউন্ডারের কাছ থেকে দুই পাতা ওষুধ। কিছুতেই কিছু হলো না। সারা দিনের খাটুনি শেষে রাত করে বাড়ি ফেরে ইয়াসিন। টানাটানির সংসারে কুলসুমের কি কম খাটনি যায়? তারপরেও তাদের সুখের কমতি নেই।

চাঁদনী পসর রাতে স্ত্রী কুলসুমকে উঠোনে বসিয়ে ভরাট গলায় একটার পর একটা গান শোনায় ইয়াসিন। উকিল মুন্সির গান তাঁর গলায় কী সুন্দর যে লাগে কুলসুমের! এই গানই তো তাদের কাছে টেনে এনেছে। হঠাৎ কুলসুমের কী হয়, হাত থেকে পড়ে যায় ভাতের হাঁড়ি। তাই তো! মানুষটার গলায় আগের ভরাট ভাবটা গেল কোথায়? বেশ কিছুদিন হলো, কণ্ঠস্বর কেমন বসে গেছে। না, কাল তাঁকে নিয়ে ময়মনসিংহে যাবই। কোনো না শুনব না।

কুলসুমের পীড়াপীড়িতে হাসপাতালের বড় ডাক্তার দেখানো হলো। অনেক পরীক্ষার পর পাওয়া গেল খারাপ খবর। ইয়াসিনের ফুসফুসে ক্যানসার। কী যেন একটা স্নায়ুর ওপর চাপ পড়েছে, তাই কণ্ঠের এই অবস্থা।

 তিন

কাজী নজরুল ইসলাম অ্যাভিনিউয়ে সার্ক ফোয়ারার কাছে বাসটা বেশ কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে আছে। শারমিন বারবার ঘড়ি দেখছে। আজ কি দেরি হয়ে যাবে অফিসে যেতে? মনে হচ্ছে একটা মিছিল আসছে বাংলামোটরের দিক থেকে। একটু বিরক্তই। দেখতে দেখতে বিরক্তি দূর হয়ে গেল তাঁর। কয়েকটি খোলা পিকআপে বিভিন্ন বয়সী নারী-পুরুষ দাঁড়িয়ে আছে। সবার পরনে গোলাপি পোশাক। এর মধ্যে কয়েকজন বর্ষীয়ান নারীও আছেন। একজন হ্যান্ডমাইকে কথা বলছেন। সামনের দিকটায় বড় ব্যানারে লেখা ‘গোলাপি সড়ক শোভাযাত্রা’। হাতে ধরা ফেস্টুনে লেখা ‘জেগে উঠুন, জেনে নিন। স্তন ক্যানসার এক নীরব ঘাতক। তবে...’।

শারমিন ফিরে গেল সেই আতঙ্কের দিনগুলোতে। কী ভয়াবহ দুঃস্বপ্নের মধ্য দিয়ে গেছে সেই সময়টা। একদিন অফিস থেকে ফিরে শাওয়ার নিতে গিয়ে হঠাৎ টের পেয়েছিল বাঁ স্তনে একটা ছোট পিণ্ডের অস্তিত্ব। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে বারবার দেখছিল। কিছুদিন আগেই জেনেছে স্তন ক্যানসারের লক্ষণগুলোর কথা। স্বামী শফিক তাঁকে সেই সন্ধ্যাতেই নিয়ে গেল পরিচিত এক ডাক্তারের কাছে। বেশ কিছু পরীক্ষা করা হলো। আলট্রাসনোগ্রাম, এফএনএসি।

শফিক সারাক্ষণ ওকে সাহস না জোগালে ও হয়তো ভয়ে পিছিয়ে যেত। প্রায় এক বছর চিকিৎসা চলল। সার্জারি, কেমোথেরাপি, রেডিওথেরাপি। নীরব ঘাতকের মতো নিঃশব্দে বেড়ে উঠেছিল ক্যানসার। সৃষ্টিকর্তার ইচ্ছা, পরিবারের সহমর্মিতা, চিকিৎসকদের আন্তরিকতা ও দক্ষতা ওকে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে এনেছে।

 চার

তিনতলার নিজের ঘর থেকে খুব একটা নিচে নামেন না নুরজাহান বেগম। নিচে দুই ছেলে থাকে নাতি-নাতনিদের নিয়ে। মেয়েরা নিজ নিজ সংসারে। স্বামী মারা যাওয়ার পর থেকে নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছেন তিনি। কিছুদিন যাবৎ আবার ব্লিডিং হচ্ছে তাঁর। এসব চুকেবুকে গেছে বেশ কয়েক বছর আগেই। আবার এমন হচ্ছে কেন? কাউকে বলতে পারছেন না। স্বামীর কথা বারবার মনে হচ্ছে তাঁর। ছেলেদের সঙ্গে তো এ কথা কোনোভাবেই বলা সম্ভব নয়। বউমাদের সঙ্গেও এ নিয়ে কথা বলতে লজ্জা পাচ্ছেন। আবার বিষয়টা গোপন করা ঠিক হবে না, এটা বুঝতে পারছেন। তিনি লেখাপড়া কিছুদূর করেছিলেন।

এরই মধ্যে একদিন টিভিতে দেখলেন একজন চিকিৎসক বলছিলেন জরায়ুমুখের ক্যানসারের কথা। কথাগুলো দাগ কেটে আছে মনে। সংকোচের বিহ্বলতা কাটাতে হবে। ‘জননীর কাছে আছে সবার জন্ম ঋণ। জরায়ুমুখের ক্যানসার সচেতনতায় অংশ নিন।’ একটা পদযাত্রা নাকি হবে। জননীর জন্য পদযাত্রা।

অল্প লেখাপড়া জানা ৬২ বছরের নুরজাহান বেগম সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললেন। ‘আপনা মাঝে শক্তি ধরো, নিজেরে করো জয়।’ বিহ্বলতা কাটাতে হবে। ছেলেমেয়ে ও বউমাদের ডেকে পাঠালেন। সবাইকে বলবেন সমস্যার কথা। চিকিৎসা নেবেন।

ক্যানসারের সাত বিপৎসংকেত

৪ ফেব্রুয়ারি বিশ্ব ক্যানসার দিবসে এবারের প্রতিপাদ্য ছিল আমরা পারি, আমি পারি। চিকিৎসকেরা ক্যানসারের সাতটি বিপৎসংকেতের কথা বলে থাকেন।

* খুসখুসে কাশি কিংবা ভাঙা কণ্ঠস্বর। 
* সহজে সারছে না এমন কোনো ক্ষত। 
* স্তনে বা শরীরের কোথাও চাকা কিংবা পিণ্ডের সৃষ্টি। 
* অস্বাভাবিক রক্তক্ষরণ। 
* মলমূত্র ত্যাগের অভ্যাসের পরিবর্তন। 
* ঢোঁক গিলতে অসুবিধা বা হজমের গন্ডগোল।
* তিল বা আঁচিলের সুস্পষ্ট পরিবর্তন। 

 এ ধরনের লক্ষণ দুই সপ্তাহের বেশি স্থায়ী হলে চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।

ক্যানসার থেকে সুরক্ষা পেতে কিছু জিনিস বা অভ্যাস বর্জন করতে হবে। কিছু ভালো অভ্যাস গ্রহণ করতে হবে। ক্যানসারকে নিয়ন্ত্রণের মধ্যে রাখতে ভূমিকা রাখতে পারি আমরা সবাই। আমিও পারি।

* প্রতিবেদনে ছদ্মনাম ব্যবহার করা হয়েছে

ডা. মো. হাবিবুল্লাহ তালুকদার
সহযোগী অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান
ক্যানসার ইপিডেমিওলজি বিভাগ
জাতীয় ক্যানসার গবেষণা ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল, ঢাকা