কোনো কাজেই মন বসাতে পারি না

>
মেহতাব খানম
মেহতাব খানম

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এডুকেশনাল অ্যান্ড কাউন্সেলিং সাইকোলজি বিভাগের অধ্যাপক মেহতাব খানম। তিনি আপনার মানসিক বিভিন্ন সমস্যার সম্ভাব্য সমাধান দেবেন। অল্প কথায় আপনার সমস্যা তুলে ধরুন।—বি. স.

সমস্যা

আমার বয়স ১৭ বছর। ছোটবেলা থেকে একধরনের সমস্যায় ভুগছি। চারপাশে অগোছালো, অপরিষ্কার কিছু দেখলে আমার মাথা ঠিক থাকে না। আমি খুব পরিপাটি থাকতে পছন্দ করি। কেউ নোংরা করলে তার সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করি। এ নিয়ে অনেকে রাগ করে, কটু কথা বলে। এরপর কোনো কাজেই মন বসাতে পারি না।

অনেক সময় হাত পরিষ্কার থাকলেও মনে হয় পরিষ্কার হয়নি। এ জন্য বারবার হাত ধুতে থাকি। বারবার বইয়ের পাতা ওল্টাই। মনে হয় কোনো দরকারি জিনিস ভেতরে রয়ে গেছে। বারবার টেবিলের বই-খাতা গোছাই। এ ধরনের আরও অসংখ্য সমস্যায় আমি ভুগছি। যার কারণে আমার পড়াশোনার একেবারে বিপর্যস্ত অবস্থা। আমার সমস্যা নিয়ে পরিবারের কারও বিশেষ মাথাব্যথা নেই। আমি নিজেও এসব সমস্যা নিয়ে কাউকে বলি না। এ থেকে বের হওয়ার কি কোনো উপায় আছে?

নাম ও ঠিকানা প্রকাশে অনিচ্ছুক

পরামর্শ

তুমি একই সঙ্গে দুশ্চিন্তা ও বিষণ্নতায় ভুগছ। হয়তোবা শৈশবে তোমাকে প্রতিটি জিনিস খুব গুছিয়ে করতে বলা হতো। কোনো ভুল করলে সমালোচনা করা হতো। অথবা এটিও হতে পারে, কোনো কিছু সুচারুভাবে না করলে তা নিয়ে পরিবারের কোনো সদস্যকে চিন্তিত হতে বা রাগ করতে দেখেছ। এ ছাড়া বাবা বা মায়ের পরিবারের কেউ যদি বিষণ্নতায় ভুগে থাকেন তাহলে বংশগতভাবেও আমাদের এ ধরনের প্রবণতা হতে পারে।

তোমার চিন্তার জগৎ কীভাবে প্রভাবিত হবে সেটা প্রাক্‌-শৈশব থেকেই ব্যক্তিত্বের অংশ হয়ে যায়। এ কারণে বড় হওয়ার পর, তুমি চেষ্টা করেও আচরণগুলো নিয়ন্ত্রণ করতে পারছ না। হয়তোবা তুমি একেবারে চাও না অন্যরা অপরিচ্ছন্ন থাকলে তাদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করতে, কিন্তু কোনোভাবেই নিজেকে মুক্ত রাখতে পারছ না।

তাঁরা যখন আবার এই নিয়ে সমালোচনা করছেন, তখন তোমার আত্মবিশ্বাস ও আত্মসম্মানবোধ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এসব মনঃকষ্ট থেকে বেরিয়ে আসার জন্য তুমি উপায়ান্তর না দেখে নিজেই অতিরিক্ত পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন ও পরিপাটি থাকছ এবং বারবার একই কাজ করছ। কিন্তু তাতে তোমার কোনো নিষ্কৃতি তো ঘটছেই না বরং আরও বেশি এই দুষ্টচক্রের মধ্যে আবর্তিত হচ্ছ।

এই অসুস্থতাকে ‘অবসেসিভ কম্পালসিভ ডিসঅর্ডার’ বলা হয়। এটি অত্যন্ত পীড়াদায়ক একটি মানসিক অবস্থা। দুর্ভাগ্যবশত, পরিবারের অন্য সদস্যরা বেশির ভাগ সময়ই একেবারেই অনুধাবন করতে পারে না।

তুমি যেহেতু ইচ্ছে করে ও সচেতনভাবে এমন আচরণ করছ না, তাই নিজেকে অন্তত দোষারোপ কোরো না। জোর করে হয়তো পড়তে চেষ্টা করছ, কিন্তু মনের ভেতরটি এত অশান্ত থাকলে তো পড়ালেখা ঠিকভাবে করাও সম্ভব হয় না। এই অসুস্থতায় অবসেশনের অংশটিতে যে ভাবনাগুলো কাজ করে সেগুলো হচ্ছে, রোগজীবাণু সংক্রমণের ভয়, কাউকে আক্রমণ করার প্রবণতা, কাছের ও প্রিয় মানুষদের কষ্ট দেওয়ার প্রবল ইচ্ছে, নিজের কোনো ক্ষতি হবে বলে ভাবতে থাকা ইত্যাদি। এরপর যেসব কম্পালসিভ আচরণ ঘটে, সেগুলো হচ্ছে, বারবার কোনো কিছু পরখ করতে থাকা, গণনা করতে থাকা, নিজেকে অতিরিক্ত পরিষ্কার করতে থাকা, অপ্রয়োজনীয় জিনিস জমিয়ে রাখা, আশপাশের মানুষদেরও পরিষ্কার থাকার জন্য চাপ দেওয়া, সবকিছু প্রয়োজনের চেয়ে বেশি সুবিন্যস্ত করে সাজিয়ে রাখা, প্রিয় মানুষগুলো নিরাপদে আছেন কি না, সেটি বারবার জানতে চাওয়া ইত্যাদি।

নিজেকে সাহায্য করার জন্য তুমি যা করতে পারো তা হচ্ছে, তোমার যেসব ব্যাপার নিয়ে দুশ্চিন্তা হচ্ছে, সেটিকে বন্ধ করতে চেষ্টা না করা, প্রতিদিন শরীরচর্চা করা, হাঁটা ও দৌড়ানো, মানুষের সঙ্গে মেলামেশা করা, নিয়ম করে প্রতিদিন অন্তত ১৫ থেকে ৩০ মিনিট নিজের পছন্দের কিছু করা, কম্পালসিভ আচরণগুলোকে বিলম্বিত করা। যেমন, যদি মনে হয় ঘরের দরজাটি বন্ধ করা হয়নি, তাহলে বন্ধ করার পর দরজাটি দেখতে কেমন ছিল তা ভাবা, যে চিন্তাগুলো মাথায় আসছে সেগুলো লিখে ফেলা, অবসেসিভ চিন্তাগুলোকে আটকে না রেখে বরং অন্য একসময় এই চিন্তাগুলোকে সময় দেওয়ার পরিকল্পনা করা ইত্যাদি।

জোর করে কোনো ভাবনা থামাতে গেলে সেটি আরও বেশি করে আমাদের পেয়ে বসে বলে সেগুলোকে আসতে দিলেই বরং আমাদের অবচেতন মন সেটির ওপরে আকর্ষণ হারিয়ে ফেলে। তবে আমি বলব, তুমি এর জন্য কোনো সাইকোথেরাপিস্টের সাহায্য গ্রহণ করো। তিনি যদি তোমাকে কোনো মনোরোগ বিশেষজ্ঞের কাছে গিয়ে ওষুধের পরামর্শ নিতে বলেন, তাহলে সেটিও করো। পরিবারকে বলো, তাঁরা যেন এই বিষয়টিকে গুরুত্বের সঙ্গে নেন। শারীরিকভাবে অসুস্থ হলে কিন্তু অভিভাবকেরা ঠিকই সন্তানদের চিকিৎসকের কাছে নিয়ে যান, ঠিক একই রকমভাবে মানসিক অসুস্থতার ক্ষেত্রেও আমাদের পদক্ষেপ নিতে হবে।

তোমার বয়স অনেক কম, সামনে সম্পূর্ণ ভবিষ্যৎ পড়ে আছে। চিকিৎসা নিতে বিলম্ব হলে কিন্তু পরবর্তী সময়ে এটি নিরাময় হতে অনেক বেশি সময় লাগবে। এখন চিকিৎসা গ্রহণ করলে তোমার পক্ষে এটি কাটিয়ে ওঠা সহজ হবে।