সেই তো তোমার আলো

মা সন্‌জীদা খাতুনের সঙ্গে ছেলে পার্থ তানভীর নভেদ। ছবি: প্রথম আলো
মা সন্‌জীদা খাতুনের সঙ্গে ছেলে পার্থ তানভীর নভেদ। ছবি: প্রথম আলো

অন্ধকারের উৎস হতে উৎসারিত আলো
সেই তো তোমার আলো।
সকল দ্বন্দ্ব-বিরোধ-মাঝে জাগ্রত যে ভালো,
সেই তো তোমার ভালো।
পথের ধুলায় বক্ষ পেতে রয়েছে যেই গেহ
সেই তো তোমার গেহ।
ভাইবোনদের কাছে পেঁচী। বড়দের রাখঢাক নাই, ছোটরা বলে আড়ালে-আবডালে। অন্য নাম? বাড়ির সব বড়ই অবজ্ঞাভরে ডাকে মিনা। ছোটদের সমীহ মিনুতে। একগাদা ভাইবোনের ভিড়ে সবচেয়ে কেলেকিষ্টি। রঙে না মিলুক, নিশ্চই কোনো মিল ছিল প্যাঁচার সাথে। সাধে কি আর অমন নাম মেলে!

মোতাহারের (কাজী মোতাহার হোসেন) পরিবার বড়, আদর-যত্নের ভাগাভাগি-টানাটানি। তায় ছোট দুবোন মনকাড়া ফুটফুটে। ছোট দুভাই ছেলে-অন্তঃপ্রাণ সাজেদার প্রশ্রয়সিক্ত। এগারো ছেলেমেয়ের আব্বু বরাবরই জ্ঞান-বিজ্ঞানের ভাবুক, শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতিতে উদাস-ভৈরব। আম্মুর শৃঙ্খলার অনুশাসন আর কড়া মেজাজের চোখরাঙানিতে কাক-চিলেও ১১৩ সেগুন বাগানে বসতে সাহস পায় না। ভাগেজোগে মিনুর কপালে জুটলে জোটে মনোযোগের ভগ্নাবশেষ। ভাঙা যত্নআত্তি জোড়া দিয়ে দিয়ে খেয়ালের আড়ালে বেড়ে ওঠে স্বাবলম্বী-জেদি-নীতিবাদী মেয়ে।

চব্বিশ বসন্তে শতেক উজান বাওয়া। ওয়াহিদুলের (ওয়াহিদুল হক) হাত ধরে সংসার, জগৎসংসার। অবশেষে আপনসত্তা পাখা মেলতে না মেলতেই চোখ মটকায় নিঠুর বাস্তব। শ্বশুরবাড়ির ঘানিটানা। বছর চারেকের মধ্যে চলে এল অপালা-পার্থ-রুচিরা। অথচ মুকুল ফৌজ করা সংগ্রামীর সামনে কত্ত কাজ। ঘর-সংসার সামলানো, স্বাধিকারপিয়াসী সত্যেন সেন আর দেশকল্যাণে ঘরছাড়া বামপথিকের আশ্রয়ণ, কলেজপড়ুয়াদের মানুষ করা, সান্নিধ্যের সকলমনে মানুষকে ভালোবাসবার বীজ বোনা। সরকারি চাকরি করেও গোপন গানে-পাঠে-নাটকে জাগিয়ে তুলতে চায় নিজভূমে কোণঠাসা বাঙালিকে। বিস্তৃতি পায় কালোর ভেতরের আলো। আটপৌরে স্বভাব আর সাজপোশাকের গহিন থেকে বেরিয়ে আসে অফুরান ঝলমলে প্রাণ।

সমরঘাতে অমর করে রুদ্রনিঠুর স্নেহ
সেই তো তোমার স্নেহ।
সব ফুরালে বাকি রহে অদৃশ্য যেই দান
সেই তো তোমার দান।

জীবনের জোয়ার-ভাটা, প্রশান্তি-ঝঞ্ঝায় আধেক খুইয়েও অদম্য নিষ্ঠাবতী আদায় করেছে মুক্ত স্বদেশ, ঈপ্সিত সমাজ, আপন সংস্কৃতির সৌরভ। মন রাজি হয়নি, কী পায়নি তার হিসাব মেলাতে। বরং সব অর্জনের সঙ্গে সংবেদ-আবেগ-মমতা দ্রবীভূত করে এক পূর্ণ-মানব সন্‌জীদা।

শত্রুমুক্ত দেশ, আপন ঠিকানায় থিতু বাঙালি। কিন্তু থির থাকতে দিল কই স্বাধীনতা আর বাঙালিয়ানায় অবিশ্বাসীরা! বঙ্গবন্ধু হত্যা, গদি দখল, সামরিক শাসন। তিন ছেলেমেয়েকে নিয়ে ওয়াহিদুলবিহীন সংসার, সাহিত্য-সংস্কৃতিচর্চায় ডুব দেবার বদলে আবার বড় সংসার নিয়ে মাতলেন সচেতন দেশপ্রেমিক। শুরু হলো নবরূপে মানুষকে জাগিয়ে তোলার অধ্যায়। ছায়ানট, পরে জাতীয় রবীন্দ্রসংগীত সম্মিলন পরিষদ। একে একে যুক্ত কণ্ঠশীলন, ব্রতচারী। সার্থক শাশ্বত বাঙালি হয়ে সকলকে নিয়ে বিশ্বমানবতার অভিমুখী যাত্রা। যাকে আরও গতি দিয়েছে রমনার বটমূলের বোমা হামলা।

ইহজগতের বাস্তবতা কি আর পায়ে ঠেলা যায়? ছেলেমেয়েদের গানের পাশাপাশি পাঠিয়েছেন মার্শাল আর্ট শিখতে। সাইকেলে কলেজ-ভার্সিটি পড়তে যায় মেয়ে। সন্তানদের স্বাধীনতার ছোঁয়া দিয়েও আবার আঁচল দিয়ে সব দুর্যোগ থেকে আড়াল করে রাখেন মুক্তমনা। রক্ষা করতে পারেননি কেবল অপালাকে। কর্কট রোগ যখন মেয়েকে কেড়ে নেয়; আঁচল দিয়ে মুখ ঢাকেননি, চোখ মোছেননি মা। বাস্তবতা মেনে লৌহকঠিন মনে সাজিয়ে গেছেন, ঘরের বাইরের, অপরিহার্য কাজের অনুক্রম।

সন্‌জীদা খাতুন অর্থ রাশভারী নারী। গাম্ভীর্যের আগল ভেঙে পরিপূর্ণ এই নারী আজ সক্কলের নাগালের এক আনন্দের আধার। দ্রোহ-প্রতিবাদে নির্ভয়, মনুষ্যত্ব-মূল্যবোধ-নীতির প্রশ্নে আপসহীন, সমতা-একতায় বিশ্বাসী, ব্যক্তিপ্রচার-প্রসারে নির্লোভ, আমিত্বের স্বার্থ-অহং ভেঙে গোষ্ঠীবাদী, হিতকর আধুনিকতা আলিঙ্গনে উদারচিত্ত। বিরল বহুমাত্রিকতার গুণে মানব মঙ্গলাকাঙ্ক্ষী সকলের হৃদয়ের সিংহাসনে।

শিল্প-সাহিত্য, সংগীত-সংস্কৃতির নির্যাসাকীর্ণ গুনিন তাঁর সকল সঞ্চয় নিয়ে অনিঃশেষ মানবকল্যাণে ব্যাপ্ত। নিজেকে উজাড় করে দেওয়ায় অমিতসঞ্চারী। আপন আদর্শ ধরে জীবনসায়াহ্নেও নিজ কক্ষপথে। টেনে নিয়েছেন অস্তাচলের চোরা আলোর অত্যুজ্জ্বল দীপ্তি। নিখাদ ভালোবাসার দ্যুতিতে একাকার করে দিচ্ছেন মানবপ্রকৃতি-ঈশ্বরপ্রেম। স্ফটিকস্বচ্ছ উচ্চারণ, টনটনে আওয়াজ, শব্দ বুনটের অমৃত সুর-ছন্দ-বাণীতে অকাতরে বিলিয়ে চলেছেন অশেষ প্রেরণা, অতল আস্থা। সে স্নিগ্ধ আলোর ঝরনাতলায় অবগাহন যেন অনন্ত।

সন্‌জীদার আত্মজ-বন্ধু-শিষ্য জারিত তাঁর দর্শনে, দিব্য রোশনাইয়ে স্নাত। সকলকে আলোর পথযাত্রী করে তুলছেন পেঁচী-মিনা-মিনু-সন্‌জীদা নামের কেলেকিষ্টি মেয়েটি। সর্বকালে, সর্বলোকে, সর্বকাজে, সর্বক্ষেত্রের আদর্শ, প্রেরণার এক উৎস-সবার সন্‌জীদা। সন্‌জীদা খাতুন। আমার মা।

মৃত্যু আপন পাত্রে ভরি বহিছে যেই প্রাণ
সেই তো তোমার প্রাণ।
বিশ্বজনের পায়ের তলে ধূলিময় যে ভূমি
সেই তো স্বর্গভূমি।
সবায় নিয়ে সবার মাঝে লুকিয়ে আছ তুমি
সেই তো আমার তুমি।

লেখক: সাংবাদিক ও ছায়ানটের যুগ্ম সম্পাদক, সন্‌জীদা খাতুনের ছেলে