আম্মা ছিলেন সবার মনের বন্ধু

মা লুৎফুন নাহারের সঙ্গে শাহনেয়াজ কাকলী। গত ৯ মে লুৎফুন নাহার পৃথিবী ছেড়ে চলে গেছেন
মা লুৎফুন নাহারের সঙ্গে শাহনেয়াজ কাকলী। গত ৯ মে লুৎফুন নাহার পৃথিবী ছেড়ে চলে গেছেন

মা তো উপন্যাস লিখেও শেষ করা যায় না। মা মানে আমার শরীর, আমি মানে মায়ের শরীর। এক বিশাল পৃথিবী। মায়ের দেওয়া দুই চোখ দিয়ে যেমন পৃথিবী দেখা আবার আমার চোখের পৃথিবীটা মা।

আমার দেখা শ্রেষ্ঠ একজন জীবনযোদ্ধা আমার মা। ১৯৬০ সালে বৈবাহিক সূত্রে নোয়াখালী থেকে রংপুরে এসে নতুন ভিটেতে সংসার শুরু করার মধ্য দিয়েই তাঁর আধুনিক জীবনযাত্রা।

একে একে আমার মামা-চাচা, খালা-ফুপুসহ তাঁদের ভাগনা-ভাগনি, ভাতিজা-ভাতিজি থেকে অনেককেই স্কুল-কলেজে ভর্তি করে দেওয়া, আশ্রয় দেওয়া এবং বিবাহদান করাসহ কত অবদান তাঁর। ১৭ কক্ষবিশিষ্ট আমাদের বাড়ির ভাতের হাঁড়ি-কড়াইয়ে পরে ধান সেদ্ধ করা হতো।

আম্মার সব ইন্দ্রিয় ছিঁড়ে আমাদের সাত ভাইবোনের জন্ম সাত রকম ধারায়।

আমরা মাকে আম্মা বলেই ডাকি। আম্মাকে ঘিরে আমাদের দুর্দান্ত দুষ্ট-মিষ্ট শৈশব। আম্মার হুংকারে সারা বাড়ি যেমন কাঁপত, তেমনি তাঁর মমতা-ছায়ায় একে একে সবাই দলে দলে বড় হয়েছে।

গুছিয়ে শাড়ি পরে আঁটসাঁট চুল বেঁধে টারসেল, নানান ডিজাইনের (কৃত্রিম) খোঁপায়, গয়নায় ও প্রসাধনীতে নিজেকে সাজিয়ে রাখতেন। সুগন্ধি আম্মার প্রিয় জিনিস ছিল। জোভান সেন্টের বোতল, পাউডারদানি, একটা ন্যাচারাল লিপস্টিক, স্নো, কদুর তেল, চুলের কাঁটা ড্রেসিং টেবিলে সাজানো ছিল সত্তর দশকেও। প্রিয় শখের মধ্যে আম্মার সিনেমা দেখা ও বই পড়া।

দস্যু বনহুর, মাসুদ রানা, শরৎচন্দ্র, ফাল্গুনী, নিমাই, বুদ্ধদেব, সমরেশ মজুমদারসহ এমন কোনো লেখকের বই নেই, যেটা তিনি পড়েননি। বই এবং কাঁচা আম দেখলে আম্মা স্থির থাকতে পারতেন না। আম্মা যেমন অনেক শৌখিন মানুষ ছিলেন, তেমনি বহুগুণের অধিকারী।

আম্মার হাতের আচার খায়নি এমন মানুষ আমাদের পাড়ায় নেই। একটা সময় তাঁর হাতে বোনা সোয়েটারও পাড়ায় অনেকেই পরত। বিপুল আনন্দ নিয়ে তাঁকে উল-কাঁটার খেলায় মত্ত হয়ে উঠতে দেখেছি। নিজের সঙ্গে নিজের কী এক প্রতিযোগিতায় দ্রুত বিশাল বিশাল গায়ের চাদর, সোয়েটার, ফ্রক নানান প্যার্টানে বানিয়ে ফেলতেন। প্রশংসার কাঙাল ছিলেন আম্মা। কেউ একটু ভালো বললেই হলো, তাকে পিরিচে পিরিচে আচার, সোয়েটার-এসব বানিয়ে দিতেন।

আমার মা চিন্তায় ছিলেন আধুনিক, প্রচলিত প্রথায় বিশ্বাসী। কিন্তু আশি সালে আম্মার জীবনে এক বিশাল কালো অধ্যায় নেমে আসে। আব্বার মৃত্যু এবং অনুপস্থিতি তাঁর জীবনের সব শখ-আহ্লাদ কেড়ে তো নেয়ই, সঙ্গে বিশাল সম্পদের সমুদ্রে বালিতে বাঁধ দিতে দিতে তিনি ক্লান্ত হয়ে ওঠেন।

নিউ এরা কন্সট্রাকশন ফার্ম, ইটের ভাটা, ট্রাক, জিপ, কার, জমিজমা, চাষাবাদের হিসাব-নিকাশ তাঁকে মানুষের নানার প্রবঞ্চনায় ব্যর্থ করে দেয় যেমন, তেমনি জীবনযুদ্ধে জয়ী করেও তোলে। আম্মাই যে একা মা-বাবার ভূমিকা পালন শুরু করলেন।

সকাল-সন্ধ্যা আম্মাকে কষ্ট করতে দেখেছি পেছনে রিকশাযোগে পাহারা দিয়ে সামনের ঠেলাগাড়িতে ধান, পাট, শস্য ফসল বয়ে আনতেন বাড়িতে। লোক লাগিয়ে বাড়িতেই ধানমাড়াই, ধান সেদ্ধ করে মিলে পাঠিয়ে খাবারের ব্যবস্থা করতেন। চাল-ডাল, আটা-বাদাম যতখানি তাঁর দ্বারা সম্ভব হয়েছে। মিল থেকে শুরু করে কোট-কাচারি, অফিস-আদালত, ব্যাংক-সব খানে একাই ছুটতেন।

মা নিজের একটা অদ্ভুত জগৎ বানিয়ে নেন। সেই ঘরটা একটা জাদুঘর। সেখানে তাঁর উপস্থিত এমন কিছু নেই যে তা পাওয়া যায় না। চা-কফি, হরলিক্স থেকে শুরু করে ছুরি-চাকু, চার্জার, হেডফোন, মডেম, মোবাইল, ট্যাব, কেটলি, ওভেন অজস্র কৌটা বন্দী তাঁর হাতে বানানো নানান বাহারি আচার আরও কত-কী!
আম্মা শিশু থেকে বৃদ্ধ-সবার মনের বন্ধু ছিলেন। আম্মা স্থান-কাল পাত্রভেদে মিশতে পারতেন। আমি জীবনেও দেখিনি আম্মা কখনো কারও ব্যক্তিগত স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করেছেন। তাই কে কী পরল, কী করল, কারও শখে আঘাত করে কথা বলেননি। কিন্তু অন্যায় কিছু দেখলে তা বোঝানোর ছলে বকা দিয়েছেন। নিজেরও স্বাধীনতায় বিশ্বাসী স্বাধীনচেতা মানুষ, নিজ জগতেই পড়ে থাকতেন। সে কারণেই আম্মা আমাকে চারুকলায় পড়তে দেন। চারদিকের শত কথার বাধা উপেক্ষা করে আমার কান্না দেখে হরতালের রাতে আমাকে ইন্টারভিউ দিতে অসহযোগের মধ্যে রওনা দেন। এ ছাড়া ছোটবেলায় শিশু একাডেমির সব প্রতিযোগিতায় ঢাকায় নিয়ে আসা, পুরস্কার বিজয়ে খুশি হওয়া, নিজেই হাতের কাজ শিখিয়ে দেওয়াসহ উৎসাহ দিতেন। আম্মার আদর ও শাসন আমার জীবন চলার পাথেয়।

আম্মার সঙ্গে দুষ্টুমি করা যেত, সব ধরনের গল্প করা যেত, সবকিছু সবাই শেয়ার করতে পারত। আম্মা বংশের বড় বোন, বড় বাড়ির বউ হওয়ায় সবাই তাঁর কাছে বটগাছের মতো ছায়া নিতে আসত। আম্মার শেকড় এত এত শক্ত, আমি তাঁর মৃত্যুর পর দেখে স্তব্ধ। মনে মনে ভাবলাম, আমরা চাইলেই কখনোই আগের মায়েদের মতো হতে পারব না। তাঁদের আট-দশ ভাইবোন, ননদ, দেবর, বহু সন্তান থেকে এত শাখা-প্রশাখায় সমৃদ্ধ আর সম্মানিত, যা আধুনিক মায়েদের এমন পরিচিতি আর কখনোই ঘটবে না। দীর্ঘ ৩৮ বছরের নিঃসঙ্গ জীবনের অবসান ঘটিয়ে তাঁর প্রিয় মানুষ; আমার বাবার কাছে ফিরে গেলেন দীর্ঘ প্রার্থনা শেষে। একই কবরে দুজন শুয়ে সন্তানদের জন্য দোয়া করছেন এবার। আমি সেই দোয়ার সুর শুনতে পাই। আমার কানে এখন নতুন উত্তরের সুর।

আহ! আমার রংপুর, আমার শৈশব, আমার মা-বাবার কবরস্থান।

লেখক: জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারপ্রাপ্ত পরিচালক