রাজকীয় বিয়ে বলে কথা!

>ব্রিটিশ রাজবাড়িতে এমন আরেকটি রাজকীয় বিয়ে দেখতে হলে অপেক্ষা করতে হবে বেশ কিছু বছর। কারণ, রাজপরিবারের বিয়ের যোগ্য ছেলেমেয়ে এ মুহূর্তে কেউ নেই। তা ছাড়া এই বিয়ে ভেঙেছে রাজবাড়ির অনেক প্রথা। বন্ধন যুক্তরাজ্যের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের। বিলেতি রাজকুমারের সঙ্গে মার্কিন অভিনেত্রীর। তাই হয়তো আলোচনাটা একটু বেশি। দেখুন রাজবাড়ির বিয়ে নিয়ে অধুনার আয়োজন। লিখেছেন রয়া মুনতাসীর
রাজ পরিবারের প্রথা ভেঙে বাবার বদলে মায়ের সঙ্গে এলেন মেগান
রাজ পরিবারের প্রথা ভেঙে বাবার বদলে মায়ের সঙ্গে এলেন মেগান

নিয়মভাঙা এক বিয়ে

নারীবাদী হিসেবে মেগানের বেশ নামডাক আছে। তাই নিজের বিয়েতেও বহু বছর ধরে চলা রাজকীয় বিয়ের কিছু নিয়ম ভেঙেছেন মেগান মার্কেল। তারই একঝলক দেখে নেওয়া যাক—

১. মায়ের সঙ্গে এসেছিলেন বিয়েতে

বিয়ের নিয়ম অনুসারে কনের সঙ্গে তাঁর বাবা আসেন বিয়ের অনুষ্ঠানস্থলে। মা ডোরিয়া র‍্যাগলেন্ডকে সঙ্গে নিয়েই আসেন সেন্ট জর্জেস চ্যাপেলে। এই সিদ্ধান্ত বিয়ের কিছুদিন আগেই নির্ধারণ করে রাখা ছিল। মা ডোরিয়া র‍্যাগলেন্ডের সঙ্গে মেগানের সম্পর্ক অনেকটাই বন্ধুর মতো।

সাজের অনুকরণ ছাড়াও অড্রের মতো বোট নেক গাউন পরেছিলেন মেগান
সাজের অনুকরণ ছাড়াও অড্রের মতো বোট নেক গাউন পরেছিলেন মেগান

২. বিয়ের অধিকাংশ কাজে নারীর অংশগ্রহণ

রাজকীয় এই বিয়ের অধিকাংশ কাজের ভার দেওয়া হয়েছিল নারীদের ওপর। এক অর্থে নারীদের প্রতিভা ও দক্ষতার গুণকীর্তনই উদ্‌যাপন করা হয়েছে এই বিয়েতে। বিয়ের গাউন ডিজাইন করেছেন গিভেঞ্চির প্রথম নারী শিল্পী পরিচালক ক্লেয়ার ওয়েই কেলার। বিয়ের কেক বানিয়েছেন ক্লেরি পিটাক। বিয়ের ফুলের তোড়াটাও বানিয়েছেন রাজকীয় ফ্লোরিস্ট ফিলিপ্পা ক্রাডেক।

৩. বিবাহোত্তর অভ্যর্থনায় ভাষণ
বিবাহোত্তর অভ্যর্থনায় মেগান নিজেও বক্তৃতা দিয়েছেন। এত দিন সাধারণত পুরুষেরাই বিবাহোত্তর অভ্যর্থনায় বক্তৃতা দিতেন। চার্লস ও হ্যারির বক্তৃতায় অতিথিরা চোখের পানিও ফেলেছেন। কিন্তু নিজে যেন অতিথিদের উদ্দেশে কিছু বলতে পারেন, সেটাও মেগান নিশ্চিত করেছিলেন।

 ৪. কম নকশার বিয়ের পোশাক
নকশাবিহীন পোশাক পরাটাকেও বিশেষজ্ঞরা নারীবাদী হিসেবেই দেখছেন। সেই অবস্থান থেকে নারীদের বিয়ের দিন যেন জমকালো নকশার পোশাকই পরতে হবে—এই নিয়মই যেন তিনি ভাঙতে চেয়েছেন। অভিজাত, আধুনিক ও মার্জিত গাউনটি যেন অনেকটা তাঁর ব্যক্তিত্বেরই প্রতিফলন ঘটিয়েছে।

 

নিজের প্রথম বিয়ের প্রস্তুতি হিসেবে এই বোটনেক গাউন তৈরি করিয়েছিলেন অড্রে হেপবার্ন
নিজের প্রথম বিয়ের প্রস্তুতি হিসেবে এই বোটনেক গাউন তৈরি করিয়েছিলেন অড্রে হেপবার্ন

৫. একাই হেঁটেছেন বিয়ের করিডরে
 অসুস্থ থাকার কারণে মেগানের বাবা থমাস মার্কেল বিয়েতে উপস্থিত না থাকার সিদ্ধান্ত নেন। তাই মেগান মার্কেল সিদ্ধান্ত নিলেন, অর্ধেকটা করিডরে একাই হাঁটবেন। বিয়ের বাকি অর্ধেকটা করিডর হেঁটেছেন হবু শ্বশুর প্রিন্স চার্লসের সঙ্গে। কেনসিংটন প্যালেস থেকেও জানানো হয়, হবু শ্বশুর মেগানকে সঙ্গ দেবেন কন্যা দান করার বদলে। অর্থাৎ মেগান কোনো পুরস্কারের পণ্য নয়, তিনি জীবনসঙ্গিনী।

 ৬. অধীন না আমি
ডায়ানার মতো মার্কেলও বিয়ের প্রতিজ্ঞা থেকে ‘মান্য’ শব্দটি বাদ দিয়ে দিয়েছেন। তিনি জীবনসঙ্গিনী হিসেবেই নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন বিয়ের দিন। কিন্তু প্রিন্স হ্যারির কথামতো নিজের জীবন পরিচালনা করবেন—এ কথাটি বিয়ের প্রতিজ্ঞায় কোথাও বলেননি।

বিয়ের অনুষ্ঠানে প্রিন্সেস ডায়ানা
বিয়ের অনুষ্ঠানে প্রিন্সেস ডায়ানা

নকশাবিহীন বিয়ের পোশাকে

ক্লেয়ার ওয়েই কেলার ও মেগান মার্কেল তিন মাস ধরে সবার চোখের আড়ালে রেখেছিলেন বিয়ের পোশাকটি। সেন্ট জর্জেস চ্যাপেল উইন্ডসরে অনুষ্ঠিত বিয়ের দিনটিতেই সিল্ক কেডি কাপড় দিয়ে তৈরি সাদা গাউনটি মুগ্ধ করে সবাইকে। অভিজাত গাউনটি খালি চোখে দেখতে খুব সাধারণ নকশার মনে হলেও ঘটনা কিন্তু ভিন্ন। বোট গলার নেকে এর আগেও মেগান মার্কেলকে দেখা গেছে বেশ কয়েকবার। কমনওয়েলথভুক্ত ৫৩টি দেশের ফুল সাদা সুতা দিয়ে বোনা হয়েছিল সাড়ে ১৬ ফুট লম্বা ওড়নায়। ফ্রান্সের লাক্সারি ফ্যাশন ও সুগন্ধি ব্র্যান্ড গিভেঞ্চির শিল্পী পরিচালক ক্লেয়ার ওয়েই কেলার পোশাকটি নকশা করেন। শাশুড়ি ডায়ানার মতো মেগানও চেয়েছিলেন ব্রিটিশ ডিজাইনারের নকশাকে তুলে ধরতে। গাউনের নিচে সিল্ক অরগ্যাঞ্জার তিনটি লেয়ার দেওয়া স্কার্ট ছিল। থ্রি-কোয়ার্টার হাতাকে পরিমার্জিত কিন্তু আধুনিকতার উদাহরণ দেওয়া হয়েছে। মেগানের প্রথম বিয়ের পোশাকের সঙ্গে দ্বিতীয় বিয়ের পোশাকের আকাশ-পাতাল পার্থক্য।

মেগানের এই বিয়ের পোশাক তৈরি করার জন্য ওয়েই কেলার ইউরোপের প্রায় প্রতিটি কাপড়ের ফ্যাক্টরিতে ঢুঁ মেরেছেন। ডাবল-বন্ডেড সিল্ক কেডি কাপড়টিতে ম্যাট ফিনিশিং ছিল। ফিলিপ্পা ক্রাডেকের নকশা করা ফুলের তোড়ার ফুলগুলো প্রিন্স হ্যারি নিজ হাতে কেনসিংটন প্যালেসের বাগান থেকে তুলেছেন। মাথার সূক্ষ্ম পাতলা কাপড়ের ওড়নাটি আটকানো ছিল রানি ম্যারির হীরার টায়রা দিয়ে। রানি এলিজাবেথের কাছ থেকে ধার নিয়ে পরেছেন মেগান। এই টায়রা ১৯৩২ সালে বানানো। গয়না বলতে কার্টিয়ের প্রতিষ্ঠানের কানে এক জোড়া দুল আর হাতে একটি ব্রেসলেট পরেছিলেন। সিল্ক ডাচেস স্যাটিনের তৈরি সাদা রঙের পয়েন্টেড জুতা জোড়াও বানিয়েছিল গিভেঞ্চি প্রতিষ্ঠান। অসীম ও অভিজাত নান্দনিকতা, অনবদ্য সেলাই ও নিরুদ্বেগ ব্যবহারের কারণে মেগান ডিজাইনার ক্লেয়ারকে বেছে নিয়েছেন।

মেগানের ওড়নায় বাংলাদেশ!
মেগানের ওড়নার নকশায় ব্যবহার করা হয়েছে মোট ৫৩টি ফুল। প্রতিটি ফুল কমনওয়েলভুক্ত একেকটি দেশের প্রতীক। সেখানে আছে বাংলাদেশও। বাংলাদেশকে প্রতিনিধিত্ব করেছে হোয়াইট ওয়াটার লিলি অর্থাৎ সাদা শাপলা ফুল (সূত্র: এক্সপ্রেস)। সাদা এই ওড়নায় সুতার নকশা করার সময় ৩০ মিনিট পরপরই কারিগরদের হাত ধুতে হয়েছে। তবে নিজের পছন্দের দুটি ফুল উইন্টারসুইট ও ক্যালিফোর্নিয়া পপিকে ওড়নার ঠিক সামনের অংশেই রেখেছিলেন রাজবধূ।

সাজে অড্রে হেপবার্নের অনুপ্রেরণা
ডাচেস অব সাসেক্সের মেকআপ ও চুল বাঁধার প্রশংসাও চলছে চারদিকে। মেকআপ এতটাই হালকা ছিল যে চেহারার ছোট ছোট দাগও বোঝা যাচ্ছিল। তারকা হেয়ার স্টাইলার সার্জ নোরমান্ট মেগানের চুল বেঁধেছেন। তবে তিনি চুল সাজানোর জন্য মাত্র ৪৫ মিনিট সময় নিয়েছিলেন। গোছানো মেসি বানটি নিচু করেই বাঁধা ছিল। মেগানের সাজ শেষ হওয়ার পর থেকেই নিজেকে চিমটি কেটে যাচ্ছিলেন নোরমান্ট। কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারছিলেন না নিজ হাতে এই সময়ের মধ্যে বেঁধেছেন ডাচেসের চুল!
বিভিন্ন ছবিতে অভিনয় করার সময় অড্রে হেপবার্ন বোট নেকের পোশাক পরেছিলেন, সেটাও গিভেঞ্চি প্রতিষ্ঠানের তৈরি করা। এ কারণেই অনেকে মেগান মার্কেলের বিয়ের গাউনটিকে অড্রে হেপবার্নের স্টাইলের সঙ্গে তুলনা করছেন। পাশাপাশি অড্রে হেপবার্নের প্রথম বিয়ের সময় একটি গাউন বানিয়েছিলেন, যেটা কখনোই তাঁর পরা হয়নি, সেটার সঙ্গেও অল্পবিস্তর মিল আছে মেগানের বিয়ের পোশাকের। তবে রাজবধূর সাজটা যে (কিছুটা) অভিনেত্রী অড্রে হেপবার্ন দ্বারা অনুপ্রাণিত, এটা সার্জ নোরমান্ট নিজেই স্বীকার করেছেন।

শাশুড়ি ডায়ানারমতো মেগানও বেছে নিয়েছিলেন লম্বা ওড়না
শাশুড়ি ডায়ানারমতো মেগানও বেছে নিয়েছিলেন লম্বা ওড়না

শাশুড়ি বনাম বউ

ব্রিটিশ রাজপরিবারের নববধূদের প্রিন্সেস ডায়ানার সঙ্গে তুলনা করার একটা ধারা শুরু হয়েছে। তা শুরু হয়েছে ডায়ানার বড় ছেলে উইলিয়ামের বিয়ের সময় থেকেই। রাজবধূ কেট মিডলটনের বিয়ের পোশাক থেকে সাজ—সবটাতেই খোঁজা হয়েছে শাশুড়ির ছায়া।

এবারও তার ব্যতিক্রম হয়নি। ডাচেস অব সাসেক্স (মেগান) অবশ্য আগে থেকেই ডায়ানার ভক্ত। অনেকেই এ কারণে ভাবছিলেন মেগানের সাজপোশাকে থাকবে ডায়ানার প্রতিচ্ছবি। ডায়ানার বিয়ের গাউন এবং মেগানের বিয়ের গাউনে কনের গলার গঠনকে তুলে ধরা হয়েছে। লেইসের বদলে গলার কাছটায় সিল্কের কাপড়ই প্রাধান্য পেয়েছে। নতুন ডাচেস যে নিজেকে আর দশজন কনে থেকে ভালোভাবেই আলাদা করতে পেরেছেন, তা বলেছেন ডায়ানার বিয়ের গাউনের ডিজাইনার এলিজাবেথ ইমানুয়েলস। মেগানের পোশাকের শেষ অংশটি গোল না হয়ে চারকোনা আকারের। আধুনিক ও নিজের ব্যক্তিসত্তার প্রতিফলনই যেন ঘটেছে এখানে। ডায়ানার বিয়ের গাউনটি ছিল আইভরি রঙা। যেখানে মেগান নিজ থেকেই সাদা রংটি পছন্দ করেছেন। মেগানের গাউনটিকে গিভেঞ্চি আখ্যায়িত করেছে ওত কোতুয়ার ওয়েডিং গাউন হিসেবে। পোশাকের ওপর কোনো বাড়তি নকশা বা লেইসের ব্যবহার করা হয়নি।

তবে ডায়ানার পোশাক ছিল অনেক ফোলা। ওড়না ও পোশাকের বিভিন্ন জায়গায় ছোট সিকুইন ও ১০ হাজার মুক্তা বসানো ছিল। গাউনটি ফোলানোর জন্য নিচে নেট ব্যবহার করা হয়েছিল। গলায় ফ্রিলের ব্যবহার ছিল নজরকাড়া। হাতায় ফোলানো ভাব ছিল। হাতার শেষ প্রান্তে বো টাই ছিল। সবশেষে ছিল চওড়া লেইস। ডায়ানার পোশাকটির এই দুই জায়গাতেই মূলত কাজ ছিল। ডায়ানার ওড়না ছিল ২৫ ফুট লম্বা। এই একটি জায়গাতেই খানিকটা মিল আছে পুত্রবধূর বিয়ের পোশাকে। মেগানের ওড়নাও বেশ লম্বা ছিল। ১৬ ফুটের বেশি।

সূত্র: ভোগ, এলি, হ্যালো, ইন্ডিপেনডেন্ট, ভ্যানিটি ফেয়ার, এক্সপ্রেস ইউকে