ভাইয়াকে ছাড়া প্রথম ঈদ

রাজীব হোসেন
রাজীব হোসেন
>

দুই বাসের প্রতিযোগিতায় প্রথমে হাত হারালেন রাজীব, শেষে জীবনও। মা-বাবা হারানো পরিবারে বড় ভাই রাজীব হোসেনই ছিলেন ছোট দুই ভাইয়ের আশ্রয়। ভাইকে ছাড়া কীভাবে ঈদ করবে মেহেদী হাসান ও আবদুল্লাহ? বড় ভাইয়ের নানা স্মৃতি নিয়ে লিখেছেন মেহেদী হাসান

ঈদের ছুটিতে আমি আর ছোট ভাই আবদুল্লাহ গ্রামের বাড়ি যেতে চাইতাম। গ্রামের বাড়ি বলতে পটুয়াখালীর বাউফলে নানাবাড়ি। দাদাবাড়িতে আমাদের কেউ নেই, কিছুই নেই। আমরা তিন ভাই বড় হয়েছি এ বাড়িতেই। মা-বাবার কবর এখানেই। তাই ঈদের ছুটিতে বাড়িতে যাওয়ার ইচ্ছাটা তীব্র হতো। কিন্তু ভাইয়া (রাজীব হোসেন) চাইতেন ঢাকাতেই আমরা ঈদ করি, বাড়িতে যেতে হলেই তো বাড়তি খরচ। শেষমেশ আমাদের মুখের দিকে তাকিয়ে ভাইয়া ঠিকই একসময় টিকিট কাটতেন, তুলে দিতেন লঞ্চে। কিন্তু তিনি যেতেন না, এতে অন্তত কিছুটা খরচ তো বাঁচল!

আমার ভীষণ ইচ্ছা ছিল তিন ভাই মিলে কোনো এক ঈদের ছুটিতে বাড়ি যাব। যেতে যেতে অনেক আনন্দ করব। বাড়িতে গিয়ে মা-বাবার কবরের পাশে দাঁড়াব। আমাদের জীবনে সেই যাত্রা এল গত ১৭ এপ্রিল। তবে তা ছুটিতে নয়, তিন ভাই একসঙ্গে নয়—কাফনে মোড়ানো নিথর ভাইয়া অ্যাম্বুলেন্সে শোয়া, আমরা অন্য আরেকটা গাড়িতে। এমন যাত্রা আমরা চাইনি। মানুষের জীবনে এমন কেন হয়? ছোটবেলা থেকে না পাওয়া জীবন আমাদের। এই না পাওয়া জীবনে ভাইয়াই ছিলেন সবকিছু।

গত ঈদে বাড়ি যাইনি, বড় খালার বাসায় ছিলাম। প্রকৃতি মানুষকে অনেক কিছু শেখায়। আমরা শিখেছি—অনেক ইচ্ছা চেপে যেতে হয়। ভাইয়ার পরিশ্রমী জীবন আর নিজের পায়ে দাঁড়ানোর চেষ্টা আমরা বুঝতে শিখেছিলাম। পার্টটাইম চাকরি, টিউশনি, নিজের পড়াশোনা—প্রতিটা দিন এই চক্রেই কাটত তাঁর। তবু বন্ধুদের সঙ্গে হাসিমুখে মিশতেন, আর আমরা সেই হাসিমুখের আড়ালে দেখতে পেতাম জমে থাকা কষ্টের মেঘ।

বড় খালার দেওয়া এই পাঞ্জাবিতেই ঈদ করবে মেহেদী হাসান ও আবদুল্লাহ। ছবি: সুমন ইউসুফ
বড় খালার দেওয়া এই পাঞ্জাবিতেই ঈদ করবে মেহেদী হাসান ও আবদুল্লাহ। ছবি: সুমন ইউসুফ

এমন কষ্টের মধ্যেও আমাদের দুই ভাইয়ের মুখে হাসি ফোটাতে তাঁর চেষ্টা ছিল আপ্রাণ। প্রতি ঈদেই নতুন পোশাক পেতাম আমরা। নিজে হয়তো কিছুই নিতেন না, ঈদের কয়েক দিন আগেই নতুন পাঞ্জাবি-পায়জামা-জুতা নিয়ে হাজির হতেন। কিন্তু এবার? এই সব আর ভাবতে পারি না। আমাদের দুনিয়াটা এখন তো বদলে গেছে। এই পরিচয়হীন দুনিয়াটা আমাদের বড্ড অচেনা।

মায়ের সঙ্গে আমার কোনো স্মৃতি নেই। তাঁকে কখন হারিয়েছি, তা মনেও নেই। বাবাকে চিনেছি মায়ের শোকে একজন অপ্রকৃতিস্থ মানুষ হিসেবে। ২০১১ সালে মারা যাওয়ার তিন বছর আগে থেকেই অনেকটা নিরুদ্দেশ ছিলেন তিনি। সে সময় আমি গ্রামের স্কুলে ক্লাস থ্রিতে পড়ি—বাবার সঙ্গে উল্লেখ করার মতো স্মৃতিও তাই খুঁজে পাই না। আমার ছোট ভাই আবদুল্লাহ হৃদয় হোসেন তখন আরও ছোট, তার কাছেও এসব ঝাপসা স্মৃতি।

আমরা দুই ভাই বড় হতে হতে যার স্নেহ-মমতা-ভালোবাসা-শাসন পেয়েছি, তিনি হচ্ছেন ভাইয়া রাজীব হোসেন। আমাদের বটবৃক্ষের মতো আগলে রেখেছিলেন মা-বাবার ভালোবাসায়, ছায়ায়। তিনিই ছিলেন আমাদের পরিচয়। ছিলেন কেন বলছি, এখনো তা-ই। শুধু পরিচয়ের ধরন বদলেছে, আগে বলত ‘রাজীবের ভাই’, এখন বলে—‘দুই বাসের রেষারেষিতে নিহত রাজীবের ভাই।’ নিহত শব্দটা কলিজায় সুচের মতো বিঁধে। মা-বাবাকে হারানোর শোক আমাদের স্মৃতিতে নেই, কিন্তু ভাই হারানোর শোক আমাদের আচ্ছন্ন করে রেখেছে। পদে পদে আমরা তাঁকে অনুভব করি।

অনুভবটা আরও সজীব হয়েছে যাত্রাবাড়ী এলাকায়। এখানে আমাদের মাদ্রাসা (তামিরুল মিল্লাত কামিল মাদ্রাসা)। আমি এবার ক্লাস সেভেনে, আবদুল্লাহ সিক্সে। মাদ্রাসার পাশেই একটি মেসে থাকতেন ভাইয়া। পার্টটাইম কাজটা করতেন যাত্রাবাড়ীতেই। একসঙ্গে থাকার সংগতি ছিল না, তবে আমরা কাছাকাছি থাকতাম। একটু খারাপ লাগলেই তাঁর কাছে চলে যেতাম। তিন ভাই মিলে গল্প করতাম। মেসে রান্নার খুব একটা সুযোগ থাকত না, তবু ভাইয়া আমাদের জন্য ডিম ভাজতেন। তিনজনে ডিম দিয়ে ভাত খেতাম। ভাইয়া অবশ্য মাছের লেজ খেতে ভীষণ পছন্দ করতেন। মনে পড়ে, গত ঈদের দিনও বড় খালা ভাইয়াকে ইলিশ মাছের একটা লেজ ভেজে খাইয়েছেন।

রাজীবের ঠিকানায় আসা চাকরির নিয়োগ পরীক্ষার প্রবেশপত্রগুলো
রাজীবের ঠিকানায় আসা চাকরির নিয়োগ পরীক্ষার প্রবেশপত্রগুলো

পড়াশোনার জন্যও ভাইয়াই ছিলেন পাশে। ইংরেজি-আরবির মতো বিষয়গুলো আমি নিজে নিজেই পড়ি। গণিতে আমি একটু কাঁচা। প্রাইভেট পড়ার অর্থ নেই, তাই ভাইয়ার কাছে যেতাম। তাঁর কাছেই দেখিয়ে নিতাম।

মাদ্রাসা ছুটির দিনে সবাই যখন বাড়িতে যেত, আমরা যেতাম ভাইয়ার মেসে। ভাইয়া বলতেন, ‘আমার একটা চাকরি হলেই বাসা নেব। তিন ভাই একসঙ্গে থাকব। একটা নিশ্চিত জীবন পাব।’ আমি আবার রসিকতা করে বলতাম, ভাবি এসে তো আমাদের বের করে দেবে! এ কথা বলতেই তিন ভাই হো হো করে হেসে উঠতাম।

আমাদের স্বপ্নপূরণের যাত্রাটাও হয়তো শুরু হতো। গত দেড় মাসে ভাইয়ার নামে নিয়োগ পরীক্ষার ছয়টি চিঠি এসেছে। কোনোটা পরীক্ষার, কোনোটা সাক্ষাৎকারের। কে জানে, এর কোনো একটি চাকরি হয়তো হয়েই যেত। সেই চিঠিগুলো হাতে নিলে খুব কান্না পায়। ক্ষোভ হয় বাসচালক নামের খুনিদের ওপর, যাঁরা ভাইয়াকে আমাদের কাছ থেকে কেড়ে নিয়েছেন। হ্যাঁ, তাঁদের আমি খুনিই বলতে চাই। আমাদের এখন একটাই চাওয়া, এই অপরাধীদের যেন বিচার হয়।

রমজান মাসের প্রথম থেকেই মাদ্রাসা ছুটি হয়েছে। মাদ্রাসার আবাসিক ব্যবস্থা বন্ধ। কিছুদিন মেজ খালার বাসায় ছিলাম, এখন আছি বড় খালার বাসায়। আর তো কোথাও যাওয়ার নেই। বড় খালা আমাদের ঈদের পাঞ্জাবি কিনে দিয়েছেন। বাড়ি যাওয়ার জন্য দিন গুনছি। মা-বাবা-ভাইয়া—সবাই তো এখন বাড়িতেই। কথা না হোক, দেখা না হোক—তাঁদের কবরের পাশে তো দাঁড়াতে পারব।

অনুলিখিত