আমার মেয়ে আর সংসার করতে চায় না

মেহতাব খানম
মেহতাব খানম

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এডুকেশনাল অ্যান্ড কাউন্সেলিং সাইকোলজি বিভাগের অধ্যাপক মেহতাব খানম। তিনি আপনার মানসিক বিভিন্ন সমস্যার সম্ভাব্য সমাধান দেবেন। অল্প কথায় আপনার সমস্যা তুলে ধরুন।—বি. স.

সমস্যা

আমার মেয়ের বয়স ২৭ বছর। সে এক বছর আগে এমবিএ সম্পন্ন করেছে। তার পছন্দের আইনজীবী পাত্রের সঙ্গে তিন বছর আগে বিয়ে দিয়েছি। এক বছর বয়সী বাচ্চাও আছে তাদের। প্রথম বছর দুজনের সম্পর্ক বেশ ভালোই ছিল। এরপর তাদের মধ্যে টানাপোড়েন শুরু হয়, ক্রমাগত সম্পর্কের অবনতি হতে থাকে। ছেলেটি প্রায়ই দুর্ব্যবহার করে মেয়ের সঙ্গে। ইদানীং শুনছি সপ্তাহে দু-তিন দিন বাসাতেই ফেরে না। জিজ্ঞেস করলে কাজ ছিল বলে এড়িয়ে যায়। আবার বাসায় ফেরার পর অনেকটা সময় ঘুমিয়ে থাকে। আমার ধারণা, সে নেশা করে, যে কারণে বাসায় ফিরতে চায় না। দুজনের সম্পর্ক এখন নাজুক পর্যায়ে। আমার মেয়ে আর সংসার করতে চায় না। আমি প্রবাসী, সে আমার দেশে ফেরার অপেক্ষা করছে। এরপর চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবে। আমি তাকে কী বলব বুঝতে পারছি না। এখন আমার কী করা উচিত? তাদের দুজনকে কাউন্সেলিং করালে কেমন হয়? করালে কোথায় করাব?

নাম ও ঠিকানা প্রকাশে অনিচ্ছুক 

পরামর্শ

আপনার জামাইয়ের বর্তমান জীবনযাত্রার বর্ণনা শুনে মনে হচ্ছে কোনো কারণে তিনি পারিবারিক জীবনের প্রতি উৎসাহ হারিয়ে ফেলেছেন। তিনি পেশাগত কাজগুলো ঠিকমতো করছেন কি না বা সংসার চালানোর খরচ দিচ্ছেন কি না, তা জানতে পারলে ভালো হতো। মেয়েটি যেহেতু নিজের পছন্দে বিয়ে করেছেন, তিনি কি বুঝতে পেরেছিলেন তাঁর স্বামী আগে থেকেই কোনো মাদকদ্রব্যের প্রতি আসক্ত? সাধারণত মাদক যারা নেয়, বেশির ভাগ সময় তাদের একটি পূর্ব ইতিহাস থাকে। জানি না, বিয়ের আগে তাঁদের কত দিনের সম্পর্ক ছিল।

বিয়ের এক বছর পর এসে কী নিয়ে তাঁদের মধ্যে মনোমালিন্য হলো, তা কি জানা সম্ভব হয়েছে? এমনকি হতে পারে যে তাঁর স্বামী টাকাপয়সা দেওয়া নিয়ে ঝামেলা করতেন বা তাঁদের ব্যক্তিত্বের সংঘাত হচ্ছিল? মেয়েটি আপনার সঙ্গে কতটা অসংকোচে নিজের দুর্দশার কথাগুলো বলেন জানি না। অনেক সময় আমাদের দেশের মেয়েরা নিজেরা পছন্দ করে বিয়ে করলে মনে করেন তাঁর দাম্পত্য জীবনের কষ্টের কাহিনিগুলো অভিভাবকদের জানানোর মাধ্যমে তাঁদের এই অশান্তিতে জড়িয়ে লাভ নেই। নিজের কষ্ট কমানোর দায়িত্বটি শুধু তাঁকেই নিতে হবে। এখন তো মনে হচ্ছে, সম্পর্কটি বেশ সংকটে পড়ে গেছে। স্বামী সপ্তাহে দু-তিন দিন বাসায় না আসার অর্থ হচ্ছে তিনি এখন কোনো দায়বদ্ধতার মধ্যে থাকতে চাইছেন না। এমনকি তাঁর স্বামী কোথায় ছিলেন, তা-ও বলার প্রয়োজন বোধ করছেন না। তাঁর অন্য কারও সঙ্গে সম্পর্ক তৈরি হয়েছে কি না, সেটিও ভেবে দেখা প্রয়োজন।

মনে হচ্ছে, ছোট্ট সন্তানের প্রতি তেমন দায়িত্ববোধও তিনি অনুভব করছেন না। বাসায় ফিরেও তিনি যখন ঘুমিয়ে থাকছেন, তখন কিন্তু আপনার মেয়েটির সঙ্গে তাঁর সন্তানও কষ্ট পাচ্ছে। বাবার সাহচর্য থেকে সে ভীষণভাবে বঞ্চিত হচ্ছে। সন্তানের জন্ম দিয়ে এভাবে তাদের অবহেলা করার কোনো অধিকার অভিভাবকদের নেই।

কাউন্সেলিং সেবা গ্রহণ করলে অবশ্যই আমরা আবেগগুলোকে আয়ত্তে রেখে যুক্তির মনটিকে ব্যবহারের মাধ্যমে জীবনের গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তগুলো নিতে সক্ষম হই। তবে যাঁরা এই সেবার জন্য যান, তাঁদের অবশ্যই সেবাটি কীভাবে দেওয়া হয়, সে সম্পর্কে মোটামুটি ধারণা থাকা খুব প্রয়োজন। এই সেবা দেওয়ার সময় আমরা পরামর্শ গ্রহীতাকে কোনো রকম উপদেশ ও সিদ্ধান্ত দেওয়া থেকে বিরত থাকি। প্রত্যেক মানুষের যেহেতু জীবনের বাস্তবতাগুলো ভিন্ন, তাদেরই সেটি মাথায় রেখে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তগুলো নিতে হয়। পরামর্শক তাঁকে সহায়তা করেন মানুষটি যেন অনেক তীব্র আকারে হওয়া আবেগগুলোকে দক্ষতার সঙ্গে মোকাবিলা করতে সক্ষম হন।

আমরা পরামর্শ গ্রহীতার সঙ্গে খুব শ্রদ্ধাপূর্ণ ও বিশ্বাসের সম্পর্ক স্থাপন করার মাধ্যমে তাঁর মধ্যে মানসিক শক্তি তৈরি করার ক্ষেত্রে সহায়তা প্রদান করি। আপনার মেয়ের স্বামী যদি এ ধরনের সেবা গ্রহণে উৎসাহী না হন, তাহলে তাঁকে জোরপূর্বক কোথাও নিয়ে খুব একটা উপকার পাওয়া যাবে না। সে ক্ষেত্রে আপনার মেয়ে কোনো কাউন্সেলরের কাছে গিয়ে তাঁর জীবনের এই সংকটময় মুহূর্তেও কীভাবে নিজেকে ভালো রাখা যায়, সেটি নিশ্চিত করতে পারেন। যখন মনের কুয়াশা কিছুটা কেটে যাবে, তখন বিবাহবিচ্ছেদের মতো বড় একটি সিদ্ধান্ত তিনি কখন বা কীভাবে নেবেন, তা নিজেই ঠিক করতে সমর্থ হবেন। এতে পরবর্তী সময়ে তাঁর সিদ্ধান্তটিকে সম্মান করে চলতে পারবেন। যদি তিনি বিবাহবিচ্ছেদের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন, তাহলে তাঁকে একটি উপার্জনের উৎস খুঁজতে হবে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলাভবনের পাঁচতলা ও চারতলায় মনের চিকিৎসা দেওয়ার জন্য দুটি কেন্দ্র রয়েছে। এখানে ফোন (+ ৮৮-০১৯৬৭-৮৬৭-৯৩৩, +৮৮-০১৭৫৫-৬৫৪-৮৩৫) করে সময় নিতে হবে।