জামিন পাওয়ার পর

কোনো ফৌজদারি মামলায় অভিযুক্ত হলে অভিযুক্ত ব্যক্তির প্রথম কাজ হচ্ছে আদালতে জামিন চাওয়া। মামলার অভিযোগ ও মামলার ধারার ওপর ভিত্তি করে আদালত জামিন মঞ্জুর করেন। জামিন পাওয়ার পর তার ওপর কিছু বাধ্যবাধকতা থাকে। থাকে কিছু বিধিনিষেধ বা শর্ত। আর এ বিধিনিষেধগুলো না মানলে হতে পারে বিপদ। বাতিল হতে পারে জামিন।

জামিন সম্পর্কে ধারণা

ফৌজদারি মামলা হতে পারে থানায় এজাহারের মাধ্যমে। হতে পারে আদালতে সরাসরি আবেদনের মাধ্যমেও। জিডি থেকেও মামলা হতে পারে। যদি থানায় মামলা হয়, তাহলে আদালতে আত্মসমর্পণ করে জামিন চাওয়া যায়। কিছু ক্ষেত্রে সীমিত পরিসরে হাইকোর্ট বিভাগ থেকেও আগাম জামিন চাওয়া যায়। তবে সাধারণত আগাম জামিন মঞ্জুর হয় কয়েক সপ্তাহের জন্য। জামিনের মেয়াদ শেষ হওয়ার দিন নিম্ন আদালতে আত্মসমর্পণ করে জামিন চাইতে হবে। আদালতে সরাসরি মামলা হলে আদালত সমন বা গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করলেও আত্মসমর্পণ করে জামিন চাওয়ার সুযোগ আছে।

যদি পুলিশ গ্রেপ্তার করে, তাহলে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে আদালতে পাঠাবে। তখন আইনজীবীর মাধ্যমে জামিন চাইতে হবে। নিম্ন আদালতে কয়েক দিন পরপর জামিন চাওয়া যায়। যদি নিম্ন আদালত জামিন নামঞ্জুর করেন, তখন দায়রা আদালতে জামিন চাইতে হয়। দায়রা আদালত জামিন না দিলে হাইকোর্ট বিভাগে আসতে হয়।

তবে জামিন যেভাবেই হোক না কেন, মানতে হবে কিছু শর্ত। আইনে জামিনযোগ্য ও অজামিনযোগ্য অপরাধ ভাগ করা আছে।

যা মানতে হবে

জামিন আগাম, অন্তর্বর্তীকালীন কিংবা স্থায়ী হোক—জামিন পাওয়ার পর মেনে চলতে হবে নিয়ম। আদালত জামিন মঞ্জুর করেছেন মানে এই নয় যে মামলা থেকে মুক্তি মিলেছে। জামিন পাওয়ার পর বাধ্যবাধকতা হচ্ছে নির্ধারিত প্রতিটি তারিখে আদালতে হাজিরা দেওয়া। কোনোভাবেই হাজিরা থেকে বিরত থাকা যাবে না। যদি অসুস্থতা বা যৌক্তিক কারণে আদালতে হাজির না থাকা যায়, তাহলে নিযুক্ত আইনজীবীর মাধ্যমে সময় আবেদন করতে হবে। জামিন পাওয়ার পর কোনোভাবে প্রতিপক্ষকে হুমকি-ধমকি দেওয়া যাবে না। মামলার কোনো সাক্ষীকে প্রলোভন বা কোনো ভয়ভীতি দেখানো যাবে না।

প্রতিপক্ষ বা সাক্ষীকে হুমকি-ধমকি দিলে এবং প্রতিপক্ষরা আদালতে অবগত করলে জামিন বাতিল হতে পারে। অনেক ক্ষেত্রে বিশেষ করে টাকা আত্মসাতের মামলায় অভিযুক্ত ব্যক্তিকে টাকা ফেরত দেওয়ার জন্য আদালত বলতে পারেন। সে ক্ষেত্রে প্রতিপক্ষ যদি আসলেই টাকা পায়, টাকা ফেরত দেওয়া উচিত। যৌতুক-সংক্রান্ত মামলার ক্ষেত্রেও প্রায়ই দেখা যায় অভিযুক্ত পক্ষ আপস-মীমাংসার শর্তে জামিন চান। সে ক্ষেত্রে স্ত্রী যদি আপস-মীমাংসা কিংবা তাঁর দেনমোহর বা ভরণপোষণের টাকা পাওয়ার শর্তে রাজি থাকেন, তাহলে স্বামীকে জামিনে আপত্তি নাও করতে পারেন। তবে অভিযুক্তকে শর্তগুলো মানতে হবে।

যদিও আইনের চোখে এমন কোনো শর্তে জামিন দেওয়ার কোনো স্পষ্ট বিধান নেই। জামিনপ্রাপ্ত হলে বিদেশে যাওয়ার ক্ষেত্রে আদালতের পূর্বানুমতি নেওয়ার প্রয়োজন হতে পারে। অনেক মামলায় দেখা যায়, আদালত পাসপোর্ট জব্দ করেন, সে ক্ষেত্রে অবশ্যই আদালতের অনুমতি নিয়ে পাসপোর্ট নিজের জিম্মায় এনে বিদেশ যেতে হবে। বিদেশ গেলেও আদালতে ধার্য তারিখে আইনজীবীর মাধ্যমে পদক্ষেপ নিতে হবে।

আইনে কিছু শর্ত সাপেক্ষে ব্যক্তিগত হাজিরা থেকে মওকুফ চাওয়া যায় এবং আইনজীবীর মাধ্যমে হাজিরা দেওয়া যায়। বিশেষ করে গুরুতর অসুস্থ ব্যক্তির জন্য আবেদন করতে পারেন মামলার মূল বিচার শুরু হওয়ার আগে। এ ক্ষেত্রে আইনজীবী নিয়মিত হাজিরা দিচ্ছেন কি না, তা জেনে নিতে হবে। আইনজীবী যদি হাজিরা না দেন, তাহলেও জামিন বাতিল হতে পারে। মনে রাখা জরুরি, জামিন পাওয়ার পর বিচারের সব স্তরে আদালতে যেতে হবে এবং বিচারের সম্মুখীন হতে হবে। নিজে নির্দোষ হলে উপযুক্ত সাক্ষী দেওয়ার সুযোগ আছে। তবে জামিন পাওয়ার পর জামিন বাতিল হলে এতে বিপদ আরও বাড়তে পারে। আইনের চোখে পলাতক ব্যক্তির অধিকারকে নিরুৎসাহিত করা হয়েছে।

লেখক: আইনজীবী, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট।