ইলিশের গল্প

‘ইলিশ যেদিন কিনবা সেদিনই রান্না করবা; আর চেষ্টা করবা রান্না কইরাই খাইতে দিতে। দুইবার গরম করলে ইলিশের স্বাদ নষ্ট হয়। পদ্মার ইলিশ কিনতে চেষ্টা করবা।’ জাতীয় অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাক এক সাক্ষাৎকারে ইলিশ খাওয়া নিয়ে বলেছিলেন। প্রয়াত এই জ্ঞানতাপসের রান্নার হাত ছিল অসাধারণ। তাঁর আরেকটি বয়ানে জানা যায়, কাটার পর ইলিশ মাছ নাকি আর ধুতে হয় না। তাতে আসল স্বাদ নষ্ট হয়ে যায়। তাহলে রক্ত-টক্ত! মাছ কাটার পর সুতি কাপড় দিয়ে রক্ত ভালোভাবে মুছে নিতে হবে।

এই হচ্ছে ইলিশ। ইংরেজি ‘হিলশা’, বৈজ্ঞানিক নাম টেনুয়ালোসা ইলিসা। খান্দানি মাছ, বাংলাদেশের জাতীয় মাছ। তাই ইলিশ, ইলিশের রান্না, ইলিশ কেনা—সব বিষয়েই নানা তরিকা। হুমায়ূন আহমেদের সৃষ্টি মিসির আলির একটা রেসিপির কথা বলি। একা থাকেন। তাঁর কাছে এলেন এক অতিথি। মিসির আলি তাঁকে ইলিশ খাওয়াবেন। মিসির আলি মাছ কাটলেন, একটু মরিচ, একটু লবণ দিয়ে মাখিয়ে পাতলা গোল করে লেবু কেটে ওর ওপর দিয়ে রোদে ফেলে রাখলেন। অতিথি অবাক। মিসির আলি বললেন এই রোদের তাপেই ইলিশ রান্না হয়ে যাবে।

রোদের তাপে হোক না-হোক জলের ভাপে ইলিশ তো মজার এক খাবার। ইলিশ রান্না একদিকে সহজ, অন্যদিকে কঠিন। সরষে ইলিশ, ভাজা ইলিশ, ইলিশ পাতুরি, ইলিশ ঝোল, ইলিশ পোলাও, ইলিশ খিচুড়ি, ইলিশ ভুনা, কাঁচকলায় ইলিশ—রান্নার পদের শেষ নেই। কিন্তু শেষ কথা তো একটাই ইলিশের গন্ধ, ইলিশের স্বাদ পাওয়া যাচ্ছে তো! মাওয়া ঘাটের হোটেলগুলোর ইলিশ ভাজার স্বাদ যেমন আর কোথাও পাওয়া যায় না, তেমনি ঘরে অনেকের হাতে রান্না করা ইলিশের স্বাদও অতুলনীয়। একবার এক বাসায় ইলিশের ঝোল খেয়েছিলাম। তাতে দুটি লেবু পাতা দেওয়া ছিল, সে স্বাদ এখনও লেগে আছে যেন।

রান্নায় ঠিক ঠিক মানে অথেনটিক স্বাদ পেতে আপনাকেও কিনতে হবে অথেনটিক ইলিশ। ইলিশের বাস সাগরে। হাজার মাইল পাড়ি দিয়ে নদীতে আসে ডিম ছাড়তে। বাচ্চারা যখন একটু বড় হয় তখন আবার ফিরে যায় সাগরে। সব রকম তথ্য-উপাত্ত, গবেষণা, অভিজ্ঞতা এটাই বলছে যে পদ্মার ইলিশ সবচেয়ে সুস্বাদু। ইলিশটা কিনতে হবে পদ্মারই। আর কেনার জন্য চাঁদপুর ও মাওয়া ঘাট ভালো। অনেকেই বলেন চাঁদপুরে যেখানে পদ্মা, মেঘনা ও ডাকাতিয়া নদীর মোহনা সেখানকার ইলিশই সেরা। যাই হোক ঘুরেফির পদ্মার ইলিশই সেরা এটা বলতেই হয়। তাই তো পশ্চিমবঙ্গের মানুষ বাংলাদেশের পদ্মার ইলিশের জন্য মুখিয়ে থাকে। আসল কথা হলো, পদ্মার ইলিশের গুণগান।

ইলিশের দাম বাড়ে গ্রামে গ্রামে। ৫০০ থেকে ৬০০ গ্রাম হলেই দাম বেড়ে যায় খানিকটা। ৯০০ গ্রাম বা এক কেজি হলে তো হলোই। চোখ জুড়াবে, মন চাইবে, কিন্তু দাম শুনে উল্টো হাঁটা দিতে হবে। এর চেয়ে বড় ইলিশের কথা না হয় না-ই বললাম। পদ্মার ইলিশ যেমন আছে, তেমনি ইলিশ ধরা পড়ে বরিশাল, ভোলা, কুয়াকাটার নদী আর সাগরে। সেগুলো আকারে-প্রকারে বড় কিন্তু...। ওই স্বাদে গিয়ে পিছিয়ে পড়ে। বর্ষার পর স্বাদের ইলিশ আর থাকে না—এ হলো বাস্তবতা। কোল্ড স্টোরেজে রাখা ইলিশ আসে বাজারে। সেগুলোর স্বাদ সময়ের টাটকা ইলিশের মতো নয়। মিয়ানমার থেকেও হয় ইলিশের আমদানি। স্বাদ তথৈবচ।

ইলিশের সবকিছুই সুস্বাদু। পুরো মাছ, মাছের মাথা, ডিম তো বটেই লবণ দিয়ে রাখা নোনা ইলিশও কম যায় না। ডিমওয়ালা না ডিম ছাড়া কোন ইলিশের স্বাদ বেশি। অভিজ্ঞদের মতে ডিম ছাড়া ইলিশের স্বাদই বেশি।

রুপালি ইলিশের পেটের অংশে লালচে, সোনালি ছোপ—সেরা ইলিশ এটাই। পিঠ মোটা মাছটাই ভালো। কেনার সময় এমন নানা বিষয় বুঝতে হয়। তবেই তো মেলে পদ্মার ইলিশ। না হলে চন্দনা ইলিশ কিনে ফেলতে পারেন। আকারে বড়, কালো হলদে রং। আসল ইলিশ নয়। বাচ্চা ইলিশ মানে জাটকা ধরা, বিক্রি, কেনা—সবই বেআইনি। তাই যত সস্তাই হোক কখনো জাটকা কেনা ঠিক হবে না।

এখন বর্ষাকাল। পদ্মার ইলিশ ধরছেন মাঝিরা। ঠিক যেমনটি মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় লিখেছিলেন তাঁর পদ্মানদীর মাঝি উপন্যাসে—
‘বর্ষার মাঝামাঝি।
পদ্মায় ইলিশ মাছ ধরার মরশুম চলিয়াছে। দিবারাত্রি কোনো সময়েই মাছ ধরিবার কামাই নাই। সন্ধ্যার সময় জাহাজঘাটে দাঁড়াইলে দেখা যায় নদীর বুকে শত শত আলো অনির্বাণ জোনাকির মতো ঘুরিয়া বেড়াইতেছে।...শেষ রাত্রে ভাঙা ভাঙা মেঘে ঢাকা আকাশে ক্ষীণ চাঁদটি ওঠে। জেলে নৌকার আলোগুলি তখনও নেভে না। নৌকার খোল ভরিয়া জমিতে থাকে মৃত সাদা ইলিশ মাছ। লণ্ঠনের আলোয় মাছের আঁশ চকচক করে, মাছের নিষ্পলক চোখগুলিকে স্বচ্ছ নীলাভ মণির মতো দেখায়।
কুবের মাঝি আজ ধরিতেছিল...।’

পদ্মার পাড় থেকে আজকের কুবের মাঝিরা সেই একইভাবে ইলিশ ধরতে যান উত্তাল পদ্মায়। তাঁদের অনেকের নৌকায় এখন ইঞ্জিন লেগেছে, গতিও বেড়েছে—কিন্তু নির্ভরতা প্রকৃতির ওপর। কোনো রাতে বেশি, কোনো রাতে কম। এভাবেই তাঁরা আমাদের সংস্কৃতির অংশ হয়ে ওঠা পদ্মার ইলিশের জোগান দিয়ে যাচ্ছেন বংশপরম্পরায়।