পঞ্চাশে কিসের ভয়

পঞ্চাশেও ধরে রাখা যায় তারুণ্য। মডেল: তপন
পঞ্চাশেও ধরে রাখা যায় তারুণ্য। মডেল: তপন

যখন বয়স ছিল পনেরো, তখন খোলা মাঠে শুয়ে চিৎকার করে আবৃত্তি করতাম, ‘নবীন কিশোর তোমাকে দিলাম ভুবনডাঙার মেঘলা আকাশ’। নবীন কিশোরকে বলতাম, ‘তোমাকে আমার তোমার বয়সী সবকিছু দিতে বড় সাধ হয়’। অর্থাৎ কবিতাকে নিছক কবিতা হিসেবেই পড়তাম। এ ছিল বোধের অগম্য, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় একটা বয়সে পৌঁছে তাঁর কিশোরবেলাকে উইল করে দিয়ে যাচ্ছেন নবীন কিশোরকে। কিশোর কি আর সে কথা বোঝে!

তারপর বয়স বাড়তে লাগল, রক্তের তেজ কমে এল। পেছনে তাকিয়ে মধুর স্মৃতিগুলোর দিকে তাকাই আর ভাবি, তাই তো! আমারও তো অনেক কিছুই আছে, যা এ বয়সে ‘মানায় না আর’।
একটা ভয় এসে ভর করে শুরুতে। তিরিশ পেরোতেই মনে হয়, আরে! এই আমি তো সেই আমি আর নই!
চল্লিশের কোঠা পার হওয়ার পর থেকে বয়সের হিসাব-নিকাশ চুকে যায়। মনে হয়, নতুন করে শুরু হচ্ছে সব। আগে হুটহাট করে যেসব সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে, তার অনেক কিছুই এখন আর ঠিক বলে মনে হয় না। একধরনের স্থিতি বা জড়তাও বুঝি শরীরের বয়সের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে মনের বয়সে জায়গা করে নিতে চাইছে।
সমস্যা হয় তখনই, যখন পুরোনো সেই দিনের কথা মনে করে হাপিত্যেশ বেড়ে যায়। ইচ্ছে হলেই বেরিয়ে পড়া, ইচ্ছে হলেই রাত জেগে নরক গুলজার, ইচ্ছে হলেই কারও কথা ভেবে ফুটপাত দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে স্বগত সংলাপ—সব যেন বড্ড দূরের কোনো সময়ের কথা মনে করিয়ে দেয়। তখনই শুরু হয় অতীত রোমন্থন: আরে আমাদের সময় আমরা যখন...ব্লা ব্লা ব্লা...।’
আর যদি সময়ের হিসাবটা নিক্তিতে ওজন না করে স্বচ্ছন্দে এগিয়ে যাওয়া যায়, তাহলেই বোঝা যায় জীবন কত সুন্দর।

সময় কাটে না, সময় বয়ে যায়
শিশুবেলায়, কিশোরবেলায়—স্কুল-কলেজের গণ্ডিতে আবদ্ধ যখন, তখন কাটতেই চায় না সময়। একটা নবীন বছর এসে বুড়ো হতে চায় না আর। মনে হয়, সে যেন যুগের পর যুগ বসে থাকবে এখানে, এক ক্লাস থেকে অন্য ক্লাসে ওঠার সময়টাকে আটকে রাখবে। এক একটা দিন যেন কচ্ছপে পরিণত হয়েছে কিংবা হাঁটছে শামুকের গতিতে।

আর বয়স যখন চল্লিশ পার, তখন এক বেতন থেকে আরেক বেতনের সময় আসে চোখের পলকে। আর মনে হয়, এত দ্রুত কেন চলে যায় সময়? শঙ্কাও আসে মনে, ‘আর তো মাত্র কটা দিন!’ তখনকার ভাবনা শঙ্খ ঘোষের ভাষায়, ‘সুখের সংজ্ঞা তো আঙুলে গোনা যায়—বসতি নির্মাণ, বংশ রক্ষা’। যৌবনের সকল উন্মত্ততা জলাঞ্জলি দিয়ে তখন একটা সুখী গৃহকোণ গড়া আর বংশ যেন নির্বাপিত না হয়, তার ব্যবস্থা করে যাওয়াতেই সব মনোযোগ।

আরে না! এ কেবল শুরু

পঞ্চাশে পৌঁছাতে কম পথ তো পাড়ি দেওয়া হলো না, সে পথ থেকে কি কুড়িয়ে নেওয়ার মতো কিছু পাওয়া যায়নি? ২০ বছরে যতটা অভিজ্ঞতা জমে, চল্লিশে বা পঞ্চাশে তো তার চেয়ে বেশি থাকে পুঁজি। ‘সব জেনে গেছি, কিছু শেখার নেই আর’ ভাবে যে, সে থেমে পড়ে আর নিরীহ প্রাণীটির মতো জাবর কাটে অতীতের। আর যে প্রাণোচ্ছল, সে সব সময় খোঁজে নতুন কিছু। সে অন্যকেও বলে, ‘এসো করো স্নান নব ধারাজলে’। একটু খেয়াল করলেই দেখবেন, পঞ্চাশ পেরোনো কেউ কেউ হঠাৎ করে একটা বিদেশি ভাষা শেখার জন্য ভর্তি হচ্ছেন কোনো শিক্ষালয়ে কিংবা কোনো বিদেশি দূতাবাসের সংস্কৃতি বিভাগের ভাষা শিক্ষা কোর্সে, তরুণদের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে শিখে নিচ্ছেন নতুন কোনো ভাষা; হঠাৎ করেই গান গাইতে ইচ্ছে করে, ছায়ানট বা অন্য কোনো গানের স্কুলে ভর্তি হয়ে যান তিনি; পঞ্চাশের ভদ্রলোক বা ভদ্রমহিলা বর্ষীয়ানদের দেখছেন (মানে তাঁর চেয়ে বড় যাঁরা, তাঁদের) অন্য চোখে, তাঁদের সমস্যাগুলো স্পর্শ করছে পঞ্চাশের ‘তরুণ’কে। তরুণেরা বাধা না মেনে বেরিয়ে পড়ে অভিযানে, পাহাড়ের চূড়া ছুঁতে চায়, ডুব দিতে চায় সাগরের অতলে, পঞ্চাশে এসেও কারও কারও মনে হতে পারে, আমিও যোগ দিতে পারি এই রোমহর্ষক অভিযানে। আরে ভাই! পঞ্চাশ একটা সংখ্যামাত্র, জীবন তাতে শেষ হয়ে যায় না। এই বয়সেও কেউ কেউ ম্যারাথনে অংশ নেন। অনেকেরই মনে পড়ে যাবে, রজার ম্যাকমিলানের কথা। আলবার্টার এই উনআশি বছর বয়সী ভদ্রলোক ২০১৭ সালে তাঁর ১০০তম ম্যারাথন দৌড় সাঙ্গ করে গিনেস বুকে নাম উঠিয়েছেন। পঞ্চাশের মানুষ কি এ কথা জেনেও ভাববেন, জীবন থেমে গেল? মোটেই না। এ কেবল শুরু।

অসুখ-বিসুখ থাকবেই

হ্যাঁ, বয়স বাড়তে থাকলে শরীর একটু একটু ভেঙে পড়তে থাকে। কিন্তু তা নিয়ে ভাবনা-চিন্তার কিছু নেই। আধুনিক চিকিৎসাবিদ্যা মানুষের জীবনকে সহজ করে দিয়েছে। কোন সমস্যায় কোন ওষুধ—সেটা চিকিৎসকের কাছ থেকে জেনে নিয়ে দিব্যি সহজ জীবন যাপন করা যায়। পঞ্চাশে এসে যখন দেখবেন, তরুণদের অনেকেই অনিয়ন্ত্রিত জীবনযাপন করায় আপনার চেয়েও অসহায় অবস্থায় চিকিৎসকের ছুরির নিচে সঁপে দিচ্ছে নিজেকে, তখন বুঝবেন, নাহ! জীবনটা আনন্দময়! খাওয়াদাওয়ায় একটু নিয়ন্ত্রণ তো আনতেই হবে। ইচ্ছেমতো আর অপরিমেয় খাওয়ার বয়স এটা নয়। একটু বেছে খেলে দেখা যাবে, ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপসহ অন্যান্য অসুখের অদম্য স্রোতকেও বাঁধ তুলে ফিরিয়ে দেওয়া যাচ্ছে।

জীবন হবে ফুরফুরে

শরীরই এই বয়সে জানান দেবে, কী খাবেন, কী খাবেন না। গোগ্রাসে গিলবেন নাকি অল্প অল্প করে বারবার খাবেন। যা খাওয়া উচিত নয়, তা খেলে মূল্য দিতে হবে নিজেকেই। চর্বিওয়ালা মাংস খাওয়ার চেয়ে সালাদের প্লেটটাই জরুরি মনে হতে পারে আপনার। উল্টোটা হলেও ক্ষতি নেই—সে জন্য শরীর তা সইতে পারে কি না, সেটা দেখবেন।

এ বয়সে এসে অনেকেই বুঝতে পারেন, তরুণ বয়সের মতো ফ্যাশন নিয়ে আগ্রহ নেই ততটা। পোশাক-আশাকে তৈরি হবে নিজের স্টাইলও। এ বয়সে কেউ খাটো কামিজ কিংবা হাতাকাটা টি-শার্ট পরার জন্য ব্যগ্র হয়ে ওঠেন না—এ কথা সবাই জানেন।

ভ্রমণ হয়ে উঠতে পারে এ বয়সে আনন্দের খনি। পারিবারিক পরিকল্পনা গড়ে দিতে পারে পরবর্তী স্বপ্নের ভিত। বই পড়া, সিনেমা দেখা, ইউটিউবে গান শোনার মতো অভ্যাসগুলোয় মেলে দিতে পারেন প্রাণ।

যা-ই বলুন, পঞ্চাশে নিজেকে বুড়ো ভাবার কিছু নেই। চল্লিশ পেরোলেই চালশে, কিন্তু পঞ্চাশ পেরোলেই কেউ বুড়ো হয় না। সংখ্যা তো সংখ্যাই—মনের বয়স কত সেটাই ভেবে দেখুন! পঞ্চাশে নিজেকে চব্বিশ ভাবতে পারলেই আয়ু বেড়ে যাবে অনেকটা। অনেকের বাড়েও।