খিচুড়িবিলাস

ছবি: নকশা
ছবি: নকশা

এক থেকে দশের মধ্যে একটি সংখ্যা বলতে বললে বেশির ভাগ মানুষই বলবে ৭।

তেমনি তুমুল বা ঝিরঝিরে বৃষ্টিতে কোনো কিছু খাওয়ার কথা মনে হলে বেশির ভাগ মানুষের মনেই ভেসে উঠবে খিচুড়ির কথা। খিচুড়ির সঙ্গে বর্ষার রয়েছে নিবিড় সম্পর্ক। চাল-ডালের মিশেলে এ এক দারুণ উপাদেয় খাবার। যুগের পর যুগ ধরে এ এলাকার মানুষের রসনাবিলাসের সঙ্গী এই খিচুড়ি।

রাশিয়ায় যখন পড়তে গেলাম, তখন ক্যানটিনের খাবার খুব বিস্বাদ লাগত। হোস্টেলের বড় ভাইয়েরা অনায়াসে শিখিয়ে দিলেন খিচুড়ি রান্না। কোনো ঝামেলা নেই। চাল আর ডাল সমান পরিমাণে নিয়ে, পেঁয়াজ কেটে, হলুদ-লবণ আর কিছু মসলা দিয়ে চুলোয় চড়িয়ে দিলেই কেল্লা ফতে! চুপি চুপি বলি, হাঁড়ির তলায় খুব করে লেগে না গেলে খিচুড়ি খারাপ হওয়ার কোনো কারণ নেই। রান্নায় অনভিজ্ঞ অবস্থায় খিচুড়িতে পানি একটু বেশি হলে বড় গলায় বলতে পারবেন, ‘নরম খিচুড়ি রেঁধেছি।’ পানি ঠিক হলে বলবেন, ‘ঝরঝরে করে রেঁধেছি।’ রাঁধতে রাঁধতে রান্নায় হাত এসে গেলে নিজের ইচ্ছেমতো নরম-ঝরঝরে যা চান, সে রকম খিচুড়িই রান্না করতে পারবেন। রুশ দেশে রান্নাবান্না ঠিকমতো শিখে ফেলার আগে খিচুড়িই ছিল আমাদের প্রধান খাবার।

মসুরির ডালের খিচুড়িতে ডাল ভেজে নিতে হয় না। আচার, পেঁয়াজ, সরষের তেল, চাইলে এক কোয়া রসুন, দুটো কাঁচা মরিচের সঙ্গে খিঁচুড়ি মাখানো হলে সে খিচুড়ির স্বাদ পাল্লা দিতে পারবে পৃথিবীর তাবৎ সুস্বাদু খাবারকে। এবার ভেবে দেখুন, ডিমভাজি বা ডিম ভুনা যদি থাকে পাশে, তাহলে এই খাবারকে লাগবে অমৃতের মতো!

মুগডালের খিচুড়ির আবার খানিকটা আভিজাত্য আছে। ডালটা ভেজে নিতে হয় আগে। হলুদ না দিলেও খেতে ভালো লাগে। এ খিচুড়ির সঙ্গে ভুনা গরুর মাংস, ইলিশ ভাজার তুলনা নেই। যেকোনো ধরনের খিচুড়িই বেগুনভাজার সঙ্গ পেলে অতুলনীয় হয়ে ওঠে।

শুধু কি মসুর আর মুগ? সব ধরনের ডাল দিয়েই খিচুড়ি হয়। তবে ওই দুটির প্রচলনই সাধারণ্যে বেশি।

আর একটা কথা। সবাই তো রাজা-বাদশা নন, তাই ঘি দিয়ে খিচুড়ি রান্না করাটা একটু বাড়াবাড়ি মনে হয়। তাই তেলেই রান্না করে রান্নার একেবারে শেষ পর্যায়ে এসে এক বা দুই টেবিল চামচ ঘি ছিটিয়ে দেয়ে পুরো খিচুড়ির সঙ্গে মিলিয়ে দিলে মনে হবে ঘিয়ে রান্না খিচুড়িই তো খাচ্ছি!

সব ধরনের খিচুড়িতেই কাঁচা মরিচ অন্য রকম স্বাদ এনে দেয়। ভাপে পুরোপুরি সিদ্ধ হয়ে যাওয়া মরিচ প্লেটে খিচুড়ির সঙ্গে একটু ডলে নিয়ে লোকমা বানিয়ে মুখে পুরে ফেলুন। কী? কেমন লাগছে? সৈয়দ মুজতবা আলীর ‘রসগোল্লা’ গল্পটিতে রসগোল্লা খেয়ে সেই পুলিশের বড়কর্তার যে চেহারা হয়েছিল, আয়নার তাকিয়ে দেখলে নিজেকেও আপনার তেমন লাগবে।

প্রায় পাঁচ হাজার বছর আগে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া থেকে ধান এসেছিল এ অঞ্চলে। এশিয়ার অনেক জায়গায়ই ধান হয় শুকনো মাটিতে। ভারতবর্ষেই প্রথম পানিতে ছেয়ে যাওয়া জমিতে ধানের চাষ হয়। বাংলা নামের অঞ্চলটি তো এ ধরনের চাষের জন্য খুবই উপযোগী, তাই খাদ্যাভ্যাসে চাল ঢুকে যাওয়া ছিল শুধু সময়ের ব্যাপার। বাংলা সাহিত্যের আদি নিদর্শন চর্যাপদ, সেখানেও চালের উল্লেখ আছে। ‘টালত মোর ঘর নাহি পড়বেষী হাড়িত ভাত নাহি নিতি আবেশী’—পঙ্‌ক্তিটার কথা অনেকেরই মনে পড়ে যাবে।

খাবার থেকে যে ক্যালরি নেওয়ার দরকার হয়, তার বেশির ভাগটাই বাঙালি চাল থেকে নিয়ে অভ্যস্ত। বিশেষ করে গরিব মানুষ আধা কেজি চালের মধ্যে একটি মরিচ আর লবণ নিয়ে মহা উৎসাহে ভাত খেয়ে নিতে পারে। চর্যাপদ-এ কিন্তু ডালের উল্লেখ নেই। ডাল আসত উত্তর ভারত থেকে। মঙ্গলকাব্যের যুগ থেকে ডালের উল্লেখ পাওয়া যায় সাহিত্যে। এই চাল আর ডাল কবে কখন মিলেমিশে খিচুড়ি হয়ে গেল, সে তথ্য পাওয়া যায় না। তবে কোথাও কোথাও বলা হয়েছে, খ্রিষ্টপূর্বাব্দ ১২০০ শতকেও চালে-ডালে খিচুড়ি খাওয়ার প্রচলন ছিল। মোগল আমলেও সম্রাটদের প্রিয় খাদ্যের তালিকায় ছিল খিচুড়ি। বাদশাহ আকবর, জাহাঙ্গীর আর আওরঙ্গজেবের হেঁশেলে খিচুড়ি রান্না হতো। সাধারণ মানুষের ঘরেও এ খাবার তখনো ছিল জনপ্রিয়, এখন যেমন।

কোনো কোনো বাড়িতে ছুটির দিনে খিচুড়ি অবধারিত। আর বৃষ্টি পড়লে যেকোনো দিনই বদলে যেতে পারে মেন্যু। তখন চাল আর ডালের মিশেল হয়ে উঠতে পারে আপনার সবচেয়ে প্রিয় খাবার। এই তো দেখতে পাচ্ছি, ধোঁয়া ওঠা খিচুড়ির পাত্র, কিছু বেগুনভাজা, গোল করে কাটা পেঁয়াজ, সদ্য ভাজা ইলিশ কিংবা ভুনা গরু বা মুরগির মাংস। নাহ! আর ভাবতে পারছি না। প্লেটটা টেনে নিতে হবে এবার!