বাবার মতো হতে চাই

ক্রিকেটার তামিম ইকবাল ছেলে আরহাম ইকবাল খানের সঙ্গে। ছবি: সংগৃহীত
ক্রিকেটার তামিম ইকবাল ছেলে আরহাম ইকবাল খানের সঙ্গে। ছবি: সংগৃহীত

‘তোমার পড়ালেখার জন্য যা যা লাগে—টাকাপয়সা সব দিচ্ছি, এখন একটা ভালো রেজাল্ট করে দেখাও’ অথবা ‘তোমাদের জন্য সবকিছুই আমি করছি, কত কত টাকা খরচ করছি, কোনো কিছুর অভাব নেই, তবু তোমরা কেন অবাধ্য?’ এমনভাবে অনেক বাবা-ই সন্তানকে বলে থাকেন। কেবল অর্থসংস্থান, সন্তান ও পরিবারের সব চাহিদা পূরণ আর আয়েশের ব্যবস্থা করতে পারাটাই তাঁরা একমাত্র দায়িত্ব ও কর্তব্য বলে মনে করেন। কিন্তু ‘বাবা’ ভূমিকাটি কেবল পার্থিব চাহিদা পূরণের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। এমনকি সন্তান যখন ভূমিষ্ঠ হয়নি তখন থেকেই তার জন্মদাতা ব্যক্তিটি ‘বাবা’ হয়ে উঠতে থাকেন।
জন্মদাতার এই ‘বাবা’ হয়ে ওঠার জন্য তাকে হতে হয় দায়িত্বশীল। পিতৃপ্রধান পরিবারতন্ত্রের শুরু থেকেই ‘বাবা’ পরিবারের মূল সিদ্ধান্তগ্রহীতা। ‘হেড অব দ্য ফ্যামিলি’ বলতে যা বোঝায়, অনেকটা তা। যদিও পরিবারতন্ত্রের আধুনিক ধারণা এবং ‘ইনক্লুসিভ প্যারেন্টিং’-এ মা, বাবা এমনকি সন্তানের ভূমিকাও সমান গুরুত্বপূর্ণ। মন্টানা স্টেট বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক ডানকান তাঁর ‘বাবার গুরুত্ব’ শীর্ষক এক গবেষণা নিবন্ধে উল্লেখ করেন, ‘পরিবারে বাবার সম্পৃক্ততা সন্তানের বিকাশে অনবদ্য ভূমিকা রাখে। বিশেষত সন্তানের বুদ্ধির বিকাশ, নারী-পুরুষ ধারণা তৈরি, মানসিকতা এবং আচরণে বাবার বিশেষ প্রভাব থাকে। যেসব সন্তানের সঙ্গে তাদের বাবার সম্পর্ক উষ্ণ, তারা মানুষ হিসেবে সফল হয়।’
সন্তানের চিন্তার জগৎ তৈরিতে, তার কগনিটিভ ডেভেলপমেন্ট, নৈতিকতার বিকাশ এবং সর্বোপরি তার সব আচরণের পেছনে ‘বাবা’র প্রভাব অনেক। বিষয়টি গবেষণায়ও প্রমাণিত। সিগমুন্ড ফ্রয়েডের মতবাদ নিয়ে নানা মতবাদ রয়েছে, বিতর্কও রয়েছে। তিনি বলেছেন, ‘সন্তানের অতিপ্রয়োজনীয় একটি চাহিদা হচ্ছে বাবা কর্তৃক সুরক্ষাপ্রাপ্তি।’ ফ্রয়েডের অনেক মতবাদ প্রায় বাতিলযোগ্য হলেও আধুনিক গবেষণায় সন্তানের বিকাশে বাবার ভূমিকা অনস্বীকার্য।
‘বেইলি স্কেল অব ইনফ্যান্ট ডেভেলপমেন্ট’ ব্যবহার করে পরিচালিত এক গবেষণায় দেখা গেছে, ০-৩ বছরের শিশুদের মধ্যে যারা বাবার সাহচর্য পেয়েছে, তাদের আইকিউ-মাত্রা পরবর্তী সময়ে বেশি পাওয়া গেছে, যারা বাবার সাহচর্য পায়নি তাদের চেয়ে। এ জে হকিংস ২০০০ সালে এক গবেষণায় দেখিয়েছেন, ‘সন্তানের আত্মিক বিকাশে বাবার ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ, আনন্দদায়ক ও চ্যালেঞ্জিং।’ এই চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করাই বাবার প্রধানতম দায়িত্ব। একজন ভালো বাবা একজন ভালো সন্তানের জন্য জরুরি। ভালো সন্তান চাইলে একজন ভালো বাবা হতেই হবে।

একই পোশাকে পুত্র আয়াশের সঙ্গে অভিনেতা অপূর্ব
একই পোশাকে পুত্র আয়াশের সঙ্গে অভিনেতা অপূর্ব

বাবা কীভাবে দায়িত্ব পালন করবেন
জন্মের আগে থেকেই
সন্তান যখন মায়ের গর্ভে, তখন থেকেই বাবাকে ‘বাবা’ হয়ে উঠতে হয়। এ সময় মা ও সন্তানের পাশে থাকবেন তিনি। চিকিৎসকের কাছে যাওয়ার সময় সঙ্গ দেওয়া থেকে শুরু করে মায়ের যত্নে তিনি সক্রিয় অংশ নেবেন। এভাবেই অনাগত সন্তানের সঙ্গে তাঁর বন্ধন তৈরি হবে।

জন্মের পরপর
জন্মের পরপরই সন্তানের সঙ্গে অ্যাটাচমেন্ট তৈরির জন্য, নবজাতককে তিনি কোলে নেবেন, স্পর্শ করবেন এবং যত্নে সাহায্য করবেন।

নবজাতকের যত্ন
সন্তানের সঙ্গে নরম স্বরে, আদর করে কথা বলবেন—যদিও সন্তান সেটির উত্তর দিতে পারবে না। তার সঙ্গে খেলবেন। তাকে খাবার খাওয়াবেন। গোসল করানো, দোলানো, ছড়া বলা ইত্যাদিতে বাবা অংশ নেবেন।

স্কুলবেলা
সন্তানের স্কুলে যাওয়ার বয়স হলে বাবা তাকে সঙ্গ দেবেন। সঙ্গে করে স্কুলে নিয়ে যাবেন। স্কুলের বই কেনা আর বেতন দেওয়ার মধ্যে নিজের দায়িত্ব সীমাবদ্ধ রাখবেন না।

পরিবারে বাবার আচরণ
পরিবারে বাবার আচরণ হবে সংযত এবং দায়িত্বশীল। মায়ের প্রতি তিনি সম্মান বজায় রাখবেন। পারিবারিক কলহ থেকে বিরত থাকবেন। সন্তানের সামনে বা অগোচরে বাবা কখনোই পরিবারের কোনো সদস্যের নিন্দা করবেন না। সন্তান যদি দেখে তার বাবা মায়ের প্রতি অসদাচরণ করছে বা পরিবারের সদস্যদের সমালোচনা করছে তবে পরিণত বয়সে তার আচরণ আগ্রাসী হয়ে উঠবে। বাবা তাঁর নিজের পিতা-মাতা ও বয়োজ্যেষ্ঠদের কখনো হেয় করবেন না। সব সময় সম্মান দেবেন, যা সন্তানের ব্যক্তিত্ব গঠনে কাজে দেবে।

সমতা
বাবা তাঁর সন্তানদের সমানভাবে স্নেহ করবেন। পুত্র বা কন্যা হিসেবে কাউকে বেশি স্নেহ আর কাউকে অবহেলা করবেন না। পরিবারে সাহায্যকর্মীদের (গৃহকর্মী, গাড়িচালক, গার্ড ইত্যাদি) প্রতি কখনো বৈষম্যমূলক আচরণ করবেন না। তাঁদের উপযুক্ত সম্মান ও ভালোবাসা দেবেন। এগুলো সন্তানের মানবিক গুণকে বিকশিত করবে।

তুলনা আর সমালোচনা
সন্তানকে আরেকজনের সঙ্গে তুলনা করবেন না এবং সন্তানের কোনো ভুলত্রুটির জন্য তার সমালোচনা করবেন না, ব্যঙ্গ করবেন না। প্রয়োজনে তাকে বুঝিয়ে বলবেন।

সন্তানের আবেগকে বুঝতে পারা
সন্তানের আবেগকে বুঝতে হবে। সন্তানের মধ্যে কারও প্রতি প্রেম-ভালোবাসা তৈরি হলে সেটাকে বন্ধ না করে বিষয়টি নিয়ে সন্তানের সঙ্গে আলাদা করে কথা বলতে হবে।

সমাজে বাবার আচরণ
সমাজে বাবা একজন দায়িত্বশীল নাগরিক হিসেবে আচরণ করবেন। অনৈতিক কাজ থেকে বিরত থাকবেন। গবেষণায় প্রমাণিত যে বাবা যদি কোনো অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে সম্পৃক্ত থাকেন, তবে সন্তানের মধ্যে ‘কনডাক্ট ডিসঅর্ডার’ বা আচরণজনিত মানসিক সমস্যা হওয়ার ঝুঁকি বেড়ে যায়। সমাজের প্রচলিত নিয়মনীতি মেনে চলবেন—লিফটের সামনে বা বেতন দেওয়ার কাউন্টারের সামনে লাইন ভাঙবেন না, রাস্তার উল্টো দিক দিয়ে গাড়ি চালাবেন না। ফুট ওভারব্রিজ দিয়ে রাস্তা পার হবেন। বাবা তাঁর ব্যক্তিগত জীবনেও যেন নৈতিকতার চর্চা করবেন।

দেশপ্রেম
সন্তানকে দেশপ্রেমের শিক্ষা দেবেন। কখনোই সন্তানের সামনে দেশ নিয়ে হতাশাব্যঞ্জক আর নেতিবাচক কথা বলবেন না। যেমন ‘এ দেশের কিছু হবে না’, ‘এ দেশে সবাই দুর্নীতিপরায়ণ’ বা ‘এ দেশে থাকতে হলে নিয়মকানুন মেনে চলা যাবে না’ বা ‘এই দেশ বসবাসের অযোগ্য’। সন্তানকে ভাষা আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ ইত্যাদির ইতিহাস জানান। দেশ ও জাতির গৌরবগাথা সন্তানকে জানান। সন্তানকে যদি দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ করতে না পারেন তবে সে একজন হতাশাগ্রস্ত মানুষ হিসেবে বেড়ে উঠবে।

অপরকে সম্মান দেখানো
দেশের সূর্যসন্তান, মুক্তিযোদ্ধা, সৎ রাজনীতিবিদদের প্রতি সন্তান যেন সম্মান প্রদর্শন করতে পারে, সে জন্য তাকে উৎসাহিত করুন। কারও সম্পর্কে বিরূপ মন্তব্য করবেন না। দেশের ক্রিকেটার, ফুটবলার, চিকিৎসক, সাংবাদিক সব পেশাজীবীর প্রতি সম্মান প্রদর্শন করতে শেখান।
সন্তানের সামনে ঘৃণাবাদের চর্চা করবেন না। তার মধ্যে গণতান্ত্রিক বোধ তৈরি করতে হলে আগে বাবার নিজের মধ্যে তার চর্চা করতে হবে। ধর্মচর্চাকারীকে ব্যঙ্গ করবেন না, আরেকটি ধর্মের অনুসারীর প্রতি নেতিবাচক মন্তব্য করবেন না। শুধু ধর্মের ভিত্তিতে সন্তানের বন্ধু বা সহপাঠী বাছাই করবেন না। পৃথিবীতে নানা মত ও পথের মানুষ রয়েছে এবং প্রত্যেকের বিশ্বাস আলাদা। সবার বিশ্বাসের প্রতি সম্মান রাখার অভ্যাস সন্তানের মধ্যে গড়ে তুলুন।

বাবার ব্যক্তিগত আচরণ
বাবার ব্যক্তিগত আচরণ আর অভ্যাস সন্তানের আচরণে প্রভাব ফেলে। বাবা নিজের জীবনে স্বাস্থ্যকর অভ্যাস পালন করবেন। বাবার নিজের যত্ন, খাদ্যাভ্যাস সন্তানের ওপর প্রভাব ফেলে। তাই বাবা যে যত্ন সন্তানের জন্য চান, যে খাবার সন্তান গ্রহণ করুক চান, তিনি নিজেও সেই চর্চা করবেন। বাবা নিজে ধূমপান থেকে বিরত থাকবেন। গবেষণায় প্রমাণিত ধূমপায়ী পিতার সন্তানের মধ্যে ধূমপানের প্রবণতা বেশি। একই রকমভাবে বাবা মাদক গ্রহণ করা থেকে বিরত থাকবেন। কারণ বাবার মাদক গ্রহণ সন্তানকে মাদকের প্রতি আকৃষ্ট করবে। বাবা সব ধরনের আগ্রাসী আচরণ আর সহিংসতা থেকে দূরে থাকবেন। সন্তানকে শারীরিক নির্যাতন করবেন ন। বাবার আগ্রাসী আচরণ সন্তানের আচরণকে আগ্রাসী করবে। তার মধ্যে হতাশা বাড়াবে। সন্তানের নেট আসক্তি কমাতে হলে বাবা নিজেও ইন্টারনেটের যৌক্তিক ব্যবহার করবেন। সন্তানের হাতে প্রযুক্তি তুলে দেওয়ার আগে বিবেচনা করবেন যে সন্তান এটির উপযুক্ত হয়েছে কি না। সন্তানকে প্রযুক্তির যৌক্তিক ব্যবহার শেখাতে হবে।

সহযোগী অধ্যাপক, জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট, ঢাকা।