নতুন মাধ্যমে পুরোনো ছবি

দেখবেন তথ্যপ্রযুক্তিবিষয়ক সম্মেলনেও প্রধান অতিথি বক্তৃতার শুরুতেই বলেন, ‘প্রযুক্তিটা আমি একটু কমই বুঝি।’ এর কারণ হতে পারে, আমরা একটা অন্তর্বর্তী সময় পার করছি। অ্যানালগ যুগ থেকে এগিয়ে যাচ্ছি ডিজিটাল রূপান্তরের মধ্য দিয়ে। একটা প্রজন্ম জন্মেই ডিজিটাল বিপ্লব পাচ্ছে। আরেক প্রজন্মের কাছে ব্যাপারটা একদম নতুন ঠেকছে।

আজকের লেখার বিষয়টা দিয়েই উদাহরণ দিই। পকেট থেকে হাত বের করেই স্মার্টফোনে ক্লিক ক্লিক শব্দে আমরা যেমন ছবি তুলছি, অপর দিকে আলমারি ঝাড়া দিলে দু–চারটে ফটো অ্যালবাম সবার ঘর থেকেই বেরোবে। কারও কারও তো মানিব্যাগ থেকেও অসময়ে প্রিয়জনের ছবি উঁকি দিয়ে বিপাকে ফেলে দেয়।

যাহোক, সময় বয়ে গেলে প্রিয়ার কালো চোখ যে ঘোলাটে হয়ে যাবে, তা পারস্য দেশের কবি ওমর খৈয়াম বহু বছর আগেই লিখেছেন। সে সময় ক্যামেরা ছিল না বলে ছবি প্রিন্ট করে ফটো অ্যালবামে ভরে রাখার ব্যবস্থা ছিল না। নয়তো প্রিয়ার ছবির বেলাতেও একই ভবিষ্যদ্বাণী করতেন। অর্থাৎ স্মৃতিকাতর করে দেওয়া অ্যালবামের ছবিগুলো অবিনশ্বর নয়। যেকোনো দুর্যোগে নষ্ট হতে পারে, খারাপ আবহাওয়ায় নষ্ট হতে পারে, নিদেনপক্ষে হারিয়ে যেতে পারে।

এরই মধ্যে অনেক পুরোনো দলীয় ছবিতে (গ্রুপ ফটো) দেখবেন কয়েকজনকে চেনা যাচ্ছে না, মানে নষ্ট হয়ে গেছে। এ ধরনের পুরোনো অথচ অত্যন্ত প্রিয় ছবিগুলো সংরক্ষণের সম্ভাব্য সমাধান হলো ছবিগুলোকে ডিজিটাল মাধ্যমে রূপান্তর করা। এটাও যে অক্ষয়, তা বলছি না। তবে অনেক বেশি নিরাপদ। আর কাজটাও কঠিন কিছু না। চলুন আমরা আজ এই প্রক্রিয়াই জানব। একই সঙ্গে জানব, ডিজিটাল মাধ্যমে থাকা ছবিগুলো ঠিকঠাক বিন্যস্ত রাখার কৌশল। এতে এই করোনাকালে বাড়িতে থাকার সময়টার সদ্ব্যবহারও হবে।

ডিজিটাল মাধ্যমে স্মৃতি সংরক্ষণ

পুরোনো ছবি ডিজিটাল মাধ্যমে সংরক্ষণের পদ্ধতি হলো স্ক্যান করে রাখা। সেটা স্ক্যানারের মাধ্যমে হলে ভালো। আর স্ক্যানার না পেলে স্মার্টফোনে অ্যাপের সাহায্যেও কাজটা সারা যায়। বলা বাহুল্য, সে ক্ষেত্রে একই ফল পাওয়া যাবে না। তবে স্মৃতির সংরক্ষণটা তো হলো।

পশ্চিমা দেশগুলোতে অনেক প্রতিষ্ঠান পুরোনো ছবি স্ক্যান করার পেশাদার সেবা দিয়ে থাকে। আমাদের এখানে রাজধানীর নীলক্ষেতসহ অনেক প্রিন্ট-ফটোকপির দোকানে কাজটা করে দেয়। এতে অবশ্য প্রাইভেসি নষ্ট হওয়ার প্রশ্ন থাকে। তা ছাড়া এমন সময়ে বাইরে যাওয়ার চেয়ে নিজেরাই করে ফেলা ভালো। আমরা বরং পুরো কাজকে একটা অভিযান হিসেবে নিতে পারি।

শুরুতেই দেখুন কতগুলো ছবি স্ক্যান করতে হবে। পরিমাণ অর্ধশত ছাড়িয়ে গেলে কয়েকটি অংশে ভাগ করে নিতে পারেন। কারণ, স্ক্যান করার কাজটা খুব সৃজনশীল নয়। খানিক পরে একঘেয়েমি চলে আসতে পারে।

স্ক্যানারে করতে চাইলে

ছবি স্ক্যান করার জন্য শিটফেড স্ক্যানারের চেয়ে ফ্ল্যাটবেড স্ক্যানার ভালো। এ ধরনের স্ক্যানারে সমতল কাচের ওপর নথি রেখে ঢাকনা দিয়ে ঢেকে, তা স্ক্যান করতে হয়। মানে যে ধরনের স্ক্যানার আমরা সচরাচর দেখে থাকি। ৫ হাজার ৭০০ টাকার আশপাশে আপনি ক্যাননের ক্যানোস্ক্যান লাইড ৩০০ কিংবা ইপসনের পারফেকশন ভি৩৯ মডেলের স্ক্যানার কিনতে পারবেন। এখন দোকানে গিয়ে নয়, বরং সুযোগ থাকলে অনলাইনে কিনুন। এগুলো এ৪ বা লেটার আকারের নথি বা ছবি স্ক্যান করতে পারে। এই স্ক্যানার আপনি পরে অন্য কাজেও ব্যবহার করতে পারবেন।

স্ক্যান করার আগে কাচের তল পরিষ্কার ও শুকনা কাপড় দিয়ে আলতো করে মুছে নিন। এতে ধুলা থাকলে পরিষ্কার হয়ে যাবে। কাপড়ের টুকরোটি মাইক্রোফাইবার হলে ভালো, না হলেও সমস্যা নেই। খুব প্রয়োজন হলে হালকা ভিজিয়েও নিতে পারেন, তবে টিস্যু ব্যবহার না করাই ভালো।

স্ক্যান করার সময় মাথায় রাখুন

l একইভাবে ছবি থেকেও ধুলা পরিষ্কার করে নিন। এ ক্ষেত্রে তরল কিছু ব্যবহার করবেন না। টিস্যুও নয়। টিস্যু কিংবা পেপার টাওয়েল ব্যবহার করতে নিষেধ করা হয়, কারণ, এগুলো দিয়ে পরিষ্কার করলে দেখবেন হালকা ধুলাকণা বা আঁশজাতীয় কিছু থেকেই যায়।

l ছবিতে ভাঁজের দাগ থাকলে যতটা সম্ভব সমান করে স্ক্যান করুন। ইস্তিরি দিয়ে ডলে সমান করতে যাবেন না। পরবর্তী সময়ে কম্পিউটারে ছবি সম্পাদনার সফটওয়্যারে দাগ মুছতে পারবেন।

l স্ক্যান করার সময়–সুযোগ থাকলে একাধিক ছবি পাশাপাশি রেখে একসঙ্গে স্ক্যান করতে পারেন। এতে সময় ও শ্রম বাঁচবে। পরে ক্রপ করে নিতে হবে। অবশ্য প্রথম ছবিগুলো স্ক্যান করতেই একটু সময় লাগে, অভ্যস্ত হয়ে গেলে কম সময়ে কাজ সারা যায়।

l শুধু স্ক্যান করলেই তো হবে না। কম্পিউটারে তা সংরক্ষণও করতে হবে। একেক স্ক্যানারের বেলায় নিয়ম একেক রকম হতে পারে। পর্দায় দেখানো নির্দেশনা মেনে স্ক্যান করার সফটওয়্যারের সঙ্গে অভ্যস্ত হতে হবে।

l বর্তমানের সব স্ক্যানারেই সাদা–কালো ও রঙিন মোডে ছবি স্ক্যান করা যায়। ছবি সাদা–কালো হলেও স্ক্যান করতে বলা হয় রঙিন মোডেই। কারণ, ছবির সেপিয়া টোন ডিজিটাল সংস্করণে চাইলেও রঙিন মোডেই স্ক্যান করতে হবে। আর ছবি সাদা–কালো হলেও রঙিন মোড রাখলে সমস্যা নেই।

l ছবিগুলো কী কাজের জন্য ব্যবহার হবে, সে অনুযায়ী ফাইল ফরম্যাট আর রেজল্যুশন ঠিক করতে হবে। সংরক্ষণের জন্য উচ্চ রেজল্যুশন রাখাই ভালো। সে ক্ষেত্রে ৬০০ ডিপিআই (প্রতি বর্গ ইঞ্চিতে বিন্দুর সংখ্যা) এবং টিআইএফএফ ফরম্যাটে সংরক্ষণ করতে পারেন। আর ফেসবুকে শেয়ার করতে চাইলে ২০০ ডিপিআই এবং জেপিইজি ফরম্যাটে স্ক্যান করলেই যথেষ্ট হবে।

l এবার সম্পাদনার পালা। তবে আকার অনুযায়ী কাটা বা ক্রপ এবং সোজা করা বা স্ট্রেইটেন ছাড়া আর তেমন কিছু না করলেও চলে। আপনি যদি ছবি সম্পাদনায় দক্ষ হন, তবে অ্যাডোবি ফটোশপ বা এমন সফটওয়্যারে প্রয়োজন অনুযায়ী সম্পাদন করে নিতে পারেন। তা ছাড়া সব অপারেটিং সিস্টেমে বিনা মূল্যে ছবি সম্পাদনার সফটওয়্যার থাকে।

স্ক্যানার না পেলে

হাতের কাছে স্ক্যানার না পেলে স্মার্টফোন দিয়ে ছবি তুলে সংরক্ষণ করতে পারেন। এ ক্ষেত্রে দুটো পদ্ধতির একটি হলো সমতলে ছবি রেখে ফোনের ক্যামেরা সোজা ওপর থেকে ছবির দিকে তাক করে ক্যাপচার বোতাম চাপা, মানে মুদ্রিত ছবির ছবি তুলে রাখা। সে ক্ষেত্রে ঘরে পর্যাপ্ত আলো নিশ্চিত করতে হবে। বিষয়বস্তুর ওপর ছায়া পড়লে চলবে না। তবে কখনোই ফ্ল্যাশ ব্যবহার করবেন না।

দ্বিতীয় পদ্ধতিটা হলো অ্যাপ ব্যবহার করা। গুগল ফটোজের ‘ফটোস্ক্যান’ অ্যাপ ব্যবহার করাটাই বোধ হয় সবচেয়ে ভালো অপশন। https://bit.ly/3atSOoK ঠিকানার ওয়েবসাইট থেকে অ্যান্ড্রয়েড কিংবা আইওএস সংস্করণ নামিয়ে বিনা মূল্যে ব্যবহার করতে পারবেন। ব্যবহারও সহজ। তা ছাড়া অ্যাপটির সুবিধা হলো আপনার হয়ে নিজে থেকেই বেশ কিছু মৌলিক সম্পাদনা, যেমন ক্রপ, স্ট্রেইটেন, আলো ঠিক করা বা রং ঠিক করার কাজ করে দেবে। আবার প্রথম আলোর এই নিবন্ধে স্মার্টফোনে ছবি সম্পাদনার সাতটি অ্যাপের খোঁজ পাবেন: https://bit.ly/33VsktO।

এবার সংরক্ষণের পালা

তাহলে ক্লিক ক্লিক করে মুঠোফোন বা ক্যামেরায় তোলা ডিজিটাল ছবির মতো পুরোনো অ্যালবামের ছবিও ডিজিটাল ফরম্যাটে পেয়ে গেলেন। এবার সেগুলো সংরক্ষণের পালা। মুঠোফোনের মেমোরি কার্ড বা কম্পিউটারের হার্ডডিস্ক ড্রাইভে তো রাখবেনই। অন্তত আরেকটি ব্যাকআপ রাখা ভালো। সে ক্ষেত্রে এক্সটারনাল হার্ডডিস্ক ড্রাইভ ভালো অপশন হতে পারে। টোশিবা, ওয়েস্টার্ন ডিজিটাল (ডব্লিউডি), সিগেট, ট্র্যানসেন্ড, এডেটা, অ্যাপাচারের মতো প্রতিষ্ঠানের তৈরি এক, দুই বা তিন টেরাবাইট স্টোরেজের এক্সটারনাল হার্ডডিস্ক ড্রাইভ কিনে নিতে পারেন। সাড়ে পাঁচ হাজার টাকার আশপাশে এক টেরাবাইটের এক্সটারনাল হার্ডডিস্ক পেয়ে যাবেন।

আরও নিরাপত্তার জন্য নির্বাচিত ছবিগুলো অনলাইনে ক্লাউড স্টোরেজে সংরক্ষণ করতে পারেন। এ ক্ষেত্রে গুগল ড্রাইভ, ড্রপবক্স, মাইক্রোসফটের ওয়ান ড্রাইভ, অ্যাপলের আইক্লাউডসহ ফ্লিকারও বিবেচনায় রাখতে পারেন। নির্দিষ্ট পরিমাণ জায়গা বিনা মূল্যে পাওয়া যায়। কোটা পেরিয়ে গেলে অর্থ খরচ করে বাড়তি স্টোরেজ কিনতে হয়।

পরবর্তী সময়ে সহজে খুঁজে পেতে

ডিজিটাল ফরম্যাটে ছবি থাকার একটা বড় সুবিধা হলো কম্পিউটারে আপনি কোনো কিছু লিখে, তা খুঁজে নিতে পারবেন। তবে সে জন্য ছবিগুলোর ফাইল নেম ঠিকঠাক লেখা জরুরি। বিশেষ ছবিগুলোর জন্য আলাদা আলাদা নাম, আবার ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বরে বন্ধু ইমনের সঙ্গে শ্রীমঙ্গল ভ্রমণে গিয়ে যে ছবিগুলো তুলেছিলেন সেসবের জন্য একই নাম ব্যবহার করতে পারেন।

আবার আলাদা ফোল্ডার ও সাবফোল্ডারে সাজিয়েও রাখতে পারেন। যেমন ২০১৮ সালের সব ছবি ‘২০১৮’ নামে ফোল্ডার তৈরি করে তার ভেতরে মাস অনুযায়ী আলাদা সাবফোল্ডার তৈরি করে জানুয়ারির ছবি ‘জানুয়ারি’তে, ফেব্রুয়ারির ছবি ‘ফেব্রুয়ারি’তে রাখুন। প্রতি মাসের ভেতর আবার আলাদা ফোল্ডারে ‘ডলির বিয়ে’ কিংবা ‘মলির জন্মদিন’ লিখে ফোল্ডার তৈরি করে নিতে পারেন। মানে যেভাবে আপনি পরবর্তী সময়ে সহজে খুঁজে পাবেন বলে মনে হয়, সেভাবেই রাখুন। আর সব ছবি যে রাখতেই হবে, তা-ও তো নয়। অপ্রয়োজনীয় ছবি ফেলে দিয়ে জায়গা ফাঁকা করুন।

ডিজিটাল ফরম্যাটের যতই সুবিধা থাকুক, মুদ্রিত ছবি, যা হাত দিয়ে স্পর্শ করে দেখা যায়, তার আবেদন কিন্তু আছেই। আর সে জন্যও বলব, ছবি ডিজিটাল ফরম্যাটে সংরক্ষণ করুন। কারণ, যখন ইচ্ছা তখন প্রিন্ট করিয়ে নেওয়ার সুযোগ তো থাকছেই।