করোনার সময়ে শিশুর টিকাদান

স্বাস্থ্য বা টিকাদান কেন্দ্রে পুরোপুরি স্বাস্থ্যবিধি মানা জরুরি। ফাইল ছবি
স্বাস্থ্য বা টিকাদান কেন্দ্রে পুরোপুরি স্বাস্থ্যবিধি মানা জরুরি। ফাইল ছবি

করোনাভাইরাসের কারণে এপ্রিল-মে মাসে বাংলাদেশের প্রায় আড়াই লাখ শিশু নিয়মিত টিকা লাভে ব্যর্থ হয়েছে। তথ্যটা স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সূত্রে জেনেছি। একই সঙ্গে এই আশঙ্কাও দেখা দিয়েছে, যে মহামারির কারণে স্বাস্থ্য ও চিকিৎসাসেবায় নানা সংকট তৈরি হওয়ায় আগামী ৬ মাসে বাংলাদেশে ৫ বছরের কম বয়সী অতিরিক্ত ২৮ হাজার শিশুর মৃত্যু হতে পারে। এই অনাকাঙ্ক্ষিত মৃত্যুরোধে এই মুহূর্ত থেকেই শিশুদের টিকা দেওয়া এবং তা নিয়মিত করা খুবই জরুরি।

নিয়মিত টিকা না দেওয়া শিশুদের দুটি ভাগ রয়েছে। এক দল এখনো টিকা শুরু করতে পারেনি, আর আরেক দল টিকা শুরু করলেও নিয়মিতভাবে দিতে পারেনি। কারও প্রথম ও দ্বিতীয় বা দ্বিতীয় ও তৃতীয় ডোজের মধ্যে ২ থেকে ৩ মাস বিরতি পড়ে গেছে। এই দুই দলকেই চিহ্নিত করে সরকারি কার্যক্রমের আওতায় দ্রুত টিকাদান শুরু করার পাশাপাশি নিয়মিত করতে হবে।

এখন প্রশ্ন হলো এমন সংকট আর আতঙ্কের সময় কীভাবে আমরা অভিভাবকদের টিকাদান কেন্দ্রমুখী করতে পারি বা কী সাবধানতা অবলম্বন করা উচিত? এরই মধ্যেই মানুষের মনে একটা আস্থার সংকট তৈরি হয়েছে। কেউ ভাবছেন আদৌ টিকাদানকেন্দ্র বা স্বাস্থ্যকেন্দ্রে গিয়ে এই সেবা মিলবে কি না, মিললেও শিশুকে নিয়ে যাওয়া ঝুঁকির কি না! টিকা দিতে গিয়ে শিশু এবং মা যদি কোভিড-১৯–এ সংক্রমিত হন—এ আশঙ্কায় পরিবারের মুরুব্বিরা বাধা দিচ্ছেন। টিকাদানকেন্দ্রের পরিবেশ, সংক্রমণ ঝুঁকি, পরিবহন ও যাতায়াত, জনসমাগম, অপেক্ষমাণ জায়গার পরিবেশ, পরিচ্ছন্নতা নিয়ে প্রশ্ন আছে। সেখানকার স্বাস্থ্যবিধি আর সামাজিক দূরত্ব মানার ব্যবস্থা কেমন ইত্যাদি নিয়ে শঙ্কা আছে। এ ছাড়া এ সময় জীবন–জীবিকার টানাপোড়েনে অনেকের ঠিকানা আর স্থান বদলের কারণে টিকাদানের গুরুত্ব বাবা-মায়ের মাথায় থাকলেও অনেকে বিষয়টা এড়িয়ে গেছেন।

চাই নতুন ব্যবস্থাপনা

করোনা মহামারির আগে টিকাকেন্দ্রে যে পরিবেশে কার্যক্রম চালানো যেত, এখন আর সেভাবে চালানো যাবে না। স্বাস্থ্যবিধি মেনে, নিরাপদ দূরত্ব বজায় রেখে টিকা দিতে গেলে, আগে এক দিনে যত বাচ্চার টিকা দেওয়া যেত, এখন আর তা সম্ভব হবে না। লম্বা সময় শিশু ও মাকে টিকাদানকেন্দ্রে লাইনে থাকতে হতে পারে। তাতে সংক্রমণ ঝুঁকি বাড়তে পারে। তা ছাড়া দীর্ঘ অপেক্ষায় টয়লেটের প্রয়োজনীয়তা ও সুবিধা, শিশুকে দুধ খাওয়ানোর সুবিধা ইত্যাদি নিয়েও চিন্তা করতে হবে।

বাংলাদেশে শিশুদের টিকা দেওয়া হয় মূলত নির্দিষ্ট টিকাকেন্দ্রে এবং মাঠপর্যায়ে অস্থায়ী স্যাটেলাইট ক্লিনিকের মাধ্যমে। করোনাকালে অনেক স্যাটেলাইট ক্লিনিকের কার্যক্রম বন্ধ হওয়ার সম্মুখীন। এগুলো চালু করার জন্য আশু পদক্ষেপ নিতে হবে। মহামারির সময় বদ্ধ ঘরের চেয়ে বড় মাঠে, যেমন স্কুলের মাঠে ক্যাম্প করে টিকা দান কার্যক্রম চালানো ভালো।

টিকাকেন্দ্রে কর্মরত স্বাস্থ্যকর্মীর স্বাস্থ্য সুরক্ষার বিষয়টিও অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনায় নিতে হবে। টিকা দেওয়ার কর্মী করোনাক্রান্ত হলে আসা সবাই ঝুঁকির মুখে পড়বেন।

* প্রথমে অভিভাবকদের টিকা না দেওয়ার ভয়াবহতা ও ঝুঁকি সম্পর্কে বোঝাতে হবে। করোনার চেয়েও গুরুতর কিছু রোগ–বালাই যে এই টিকা না নেওয়ার কারণে হতে পারে সেটা প্রচার করা দরকার।

* টিকাকেন্দ্রের সংক্রমণ ঝুঁকি কমানোর জন্য সব ধরনের ব্যবস্থা নিতে হবে। ভিড় এড়াতে দরকার হলে টেলিফোনে, অনলাইনে অথবা আগে গিয়ে পূর্বনির্ধারিত অ্যাপয়েন্টমেন্ট বা তারিখ সময়ে নাম লেখানোর ব্যবস্থা করতে হবে। কেন্দ্রে যথেষ্ট দূরত্ব বজায় রেখে লাইনে দাঁড়ানোর স্থান বৃত্ত করে এঁকে দেওয়া, হাত ধোয়ার ব্যবস্থা ইত্যাদি নিশ্চিত করতে হবে। টিকাকর্মী অবশ্যই মাস্ক পরে থাকবেন।

* মা ও শিশু দুজনই ভালো মানের মাস্ক পরবেন। নাকে–মুখে হাত দেবেন না কিছুতেই। হাঁচি–কাশির স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলবেন। টিকাকেন্দ্রে প্রবেশের আগে ভালো করে সাবান দিয়ে হাত ধুয়ে নেবেন। বাচ্চাকে টিকা দেওয়া হয়ে গেলে আবার হাত ধুয়ে নেবেন। টিকাকর্মীরও উচিত প্রতিটি শিশুকে টিকা দেওয়ার পর গ্লাভস পরা হাতে অ্যালকোহল স্পিরিট মেখে হাত পরিষ্কার করে পরবর্তী শিশুকে টিকা দেওয়া।

* গণপরিবহন এড়িয়ে চলাই ভালো। কাছের টিকাকেন্দ্রে হেঁটে যেতে পারলে সবচেয়ে ভালো হয়।

* এ সময় টিকাকেন্দ্রে অপেক্ষাকাল বেশি লাগতে পারে, সেটা মাথায় রেখেই মা-বাবাকে বাচ্চা ও মায়ের জন্য খাবার, পানি ইত্যাদি প্রস্তুতি নিয়ে টিকাকেন্দ্রে যেতে হবে। ভিড় বা জনসমাগমে ধাক্কাধাক্কি করার চেয়ে অপেক্ষায় থাকাই ভালো। তাই ধৈর্য ধরুন।

* ফিরে এসে জামাকাপড় সাবান দিয়ে ধুয়ে দেবেন আর শিশুসহ বাবা–মা গোসল করে নেবেন।

* টিকা দেওয়ার পর শিশুর হালকা জ্বর আসতে পারে এ নিয়ে ভীত হওয়ার কিছু নেই। জ্বর দীর্ঘমেয়াদি হলে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হবেন।

* যদি বাড়িতে কেউ বা বাবা–মা নিজেরা করোনায় আক্রান্ত হয়ে থাকেন তবে ওই সময় টিকাকেন্দ্রে যাবেন না। আইসোলেশনের মেয়াদ শেষ হলে যাবেন। শেষ কবে টিকা দেওয়ার তারিখ ছিল আর কত দিন দেরি হলো এগুলো প্রয়োজনে লিখে নিয়ে যাবেন। এতে নতুন কার্ড করতে সুবিধা হবে।