শেষ রাতে শেষ পাতে

পুরান ঢাকার একটি হোটেলে পরিবারের সদস্যরা মিলে সেহরি খাচ্ছেন
পুরান ঢাকার একটি হোটেলে পরিবারের সদস্যরা মিলে সেহরি খাচ্ছেন

বিভিন্ন হোটেল-রেস্তোরাঁয় ইফতারের আয়োজন তো নতুন নয়। এখন পরিবার-পরিজন নিয়ে কিংবা বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে বাইরে গিয়ে সেহিরও খাচ্ছেন অনেকে। ১৪ জুলাই রাতে ঢাকার বিভিন্ন এলাকা ঘুরে সেই চিত্রই তুলে ধরলেন পল্লব মোহাইমেন সঙ্গে ছিলেন কবির হোসেন
ফেসবুকে যাঁরা অভ্যস্ত তাঁরা জানেন, সামাজিক যোগাযোগের এই মাধ্যমে ‘চেক-ইন’ নামে একটা সুবিধা আছে। আপনি যেখানে অবস্থান করছেন ‘চেক-ইন’ দিয়ে মানচিত্রে আপনার সেই জায়গাটার কথা জানাতে পারেন বন্ধুদের। রমজান মাসে মধ্যরাতের পরে ফেসবুক বন্ধুদের কিছু ‘চেক-ইন’ চোখে পড়ে। সেসবের বেশির ভাগ পুরান ঢাকা আবার কোনোটা ধানমন্ডি, বনানী বা উত্তরায় কোনো রেস্তোরাঁয় বন্ধুর অবস্থান জানান দেয়। আবার অনেকে সেহির খেতে গিয়ে খাবারের বা নিজেদের ছবি তুলে ‘সেহির অ্যাট আল-রাজ্জাক’ এমন স্ট্যাটাস দিয়ে সবাইকে জানিয়ে দেয়, কোথায় আছে সে। 

রাতের বেলা মাঝেমধ্যে, নিদেনপক্ষে এক দিন বাসার বাইরে রেস্তোরাঁয় গিয়ে সেহির খাওয়ার এ ব্যাপার গত বছরের রোজার মাস থেকেই বেশি চোখে পড়ছে। এ ধারাটা শুরু হয়েছে বছর দুই ধরে—বললেন বংশালে নর্থ-সাউথ রোডে হোটেল আল-রাজ্জাকের মহাব্যবস্থাপক নুরুল ইসলাম। জানালেন, তাঁদের হোটেলে বারিধারা, গুলশান, বনানী ও ধানমন্ডি থেকেই বেশির ভাগ মানুষ খেতে আসে। আর এর মধ্যে পরিবারের সংখ্যা বেশি।
একটি সিমেন্ট কোম্পানির প্রধান পরিচালন কর্মকর্তা হাবিবুর রহমান আল-রাজ্জাকে এসেছেন ধানমন্ডি থেকে পুরো পরিবার নিয়ে। এ পরিবারের সদস্য তাসফিয়া হাবিব বলেন, ‘গত বছর এখানে এসে বসার জায়গা পাইনি। তাই এবার আগেভাগেই এসেছি।’

ঢাকার উত্তরার একটি রেস্তোরাঁয় বুফে সেহরির আয়োজন
ঢাকার উত্তরার একটি রেস্তোরাঁয় বুফে সেহরির আয়োজন

রাত ফুরালেই ছোট ভাই চলে যাবেন চাকরির প্রশিক্ষণে। সে উপলক্ষে পরিবারের সদস্য ও ভাইয়ের বন্ধু—সব মিলিয়ে ১১ জনের একটি দল নিয়ে লালবাগ থেকে সেহির খেতে এসেছেন মইনুল হক। বললেন, ‘ভাই কাল চলে যাবে। তাই নামী হোটেলে সেহির খেতে আসা।’
বাসার বাইরে সেহির খাওয়ার এই যে চল, সে কারণে ঢাকার ঐতিহ্যবাহী এবং নতুন কিছু রেস্তোরাঁয় এখন থাকছে সেহির আয়োজনও। মোটামুটি প্রায় সব হোটেলেই সেহির খাওয়া শুরু হয় রাত সাড়ে ১২টা বা একটা থেকে। খোলা থাকে সেহিরর শেষ সময় পর্যন্ত। যে রাতে বেরিয়েছিলাম তার পরদিন ছিল হরতাল। রমজান মাসেও গেছে মাত্র চার দিন। তাই সেহিরর আয়োজনে ভিড় অনেকটাই কম। রেস্তোরাঁর কর্মীদের কাছ থেকে জানা গেল, বৃহস্পতি, শুক্র ও শনিবার ভিড় থাকে অনেক বেশি।
সাড়ে তিন মাস বয়স হয়েছে উত্তরার রবীন্দ্র সরণির ব্যাকইয়ার্ড শেফ রেস্তোরাঁর। চার রকম বিরিয়ানি, তেহারি, মোরগ পোলাও, সাদা পোলাও, বিশেষ মিষ্টান্ন দিয়ে বুফে সেহির খাওয়ার ব্যবস্থা। রাত পৌনে একটার দিকে গিয়ে দেখা গেল, সেখানে সব খাবার সাজিয়ে রাখা হচ্ছে। রেস্তোরাঁর ভারপ্রাপ্ত ব্যবস্থাপক শাহনেওয়াজ রহমান জানান, পরিবার ও দম্পতিরা খেতে আসেন বেশি। জানা গেল, উত্তরায় আরও দু-একটি রেস্তোরাঁ কয়েক দিনের মধ্যে সেহির খাওয়ার ব্যবস্থা চালু করবে।
ঐতিহ্যবাহী স্টার হোটেল ঠাটারীবাজার থেকে ছড়িয়ে গেছে পুরো ঢাকা শহরেই। বনানীর স্টার কাবাব অ্যান্ড রেস্টুরেন্ট থেকে জানা গেল, স্টারের সব শাখাতেই সেহিরর আয়োজন শুরু হয় রাত দেড়টা থেকে। আশপাশের মানুষই বেশি যান স্টারে। ধানমন্ডি ২ নম্বর সড়ক, কারওয়ান বাজার, ফার্মগেট ও ওয়ারীতে স্টারের অন্য শাখাগুলোতেও আছে সেহিরর আয়োজন।
ঢাকার হোটেল-রেস্তোরাঁয় সেহিরর আয়োজনে মোটামুটিভাবে উপমহাদেশীয় ও বাঙালি খাবারের মজার সব পদ থাকে। এসবের মধ্যে বিরিয়ানি, সাদা ভাত, সাদা পোলাও, খাসির রেজালা, লেগ রোস্ট, গ্লাসি, গরুর কালা ভুনা, মোরগ মোসাল্লাম, চিকেন কারি, চিকেন চাটনি, চিংড়ি, রুই, পাবদা ও ইলিশ ভুনা, বিশেষ ডাল ইত্যাদি নানা পদ জনপ্রিয়। সঙ্গে লাচ্ছি, ফালুদা, ফলের রস, দই, ফিরনি, কোমল পানীয়, চা-কফি তো থাকে। স্টার ও আল-রাজ্জাকে অবশ্য গরুর মাংসের কোনো পদ পাওয়া যায় না।
সেহির খাওয়ার জায়গা হিসেবে পুরান ঢাকার আলাউদ্দিন রোড, ঠাটারীবাজার, রায়সাহেব বাজার, নাজিরাবাজার, বংশাল ইত্যাদি এলাকার হোটেলগুলোর নামডাক আছে। সেহিরর আয়োজন থাকে আল-ইসলাম, ক্যাফে ইউসুফ, ঘরোয়া, মিরানিয়া-গাউছিয়া, কাঞ্চি, নাজিরিয়া, তৈয়্যেবাদ, কামাল হোটেল, মামুন বিরিয়ানি, কামাল’স কিচেন, খন্দকার হোটেল ইত্যাদি রেস্তোরাঁয়। রোজার মাত্র দুই দিন আগে ওয়াইজঘাটে চালু হয়েছে নানা রেস্তোরাঁ। শুরুতেই এখানে রাখা হয়েছে সেহিরর আয়োজন। মগবাজারের ক্যাফে ডি তাজেও আছে সেহির খাওয়ার ব্যবস্থা। শেষ রাতে খাবারের শেষ পাত দিয়ে শুরু হয় রমজানের একেকটা দিন, যা আবার শেষ হয় ইফতারি দিয়ে। রাতে ঘুরে বিভিন্নজনের সঙ্গে কথা বলে বোঝা গেল, সেহিরর খাবারে একটু বৈচিত্র্যের স্বাদ পেতেই বাইরে গিয়ে সেহির খাওয়া।