অকারণ চুরি, অহেতুক মিথ্যা

কারণ ছাড়া চুরি করা এক ধরনের রোগ। ছবিটি প্রতীকী। ছবি: কবির হোসেন
কারণ ছাড়া চুরি করা এক ধরনের রোগ। ছবিটি প্রতীকী। ছবি: কবির হোসেন

এক.
সাদিয়ার বয়স ১৬। ধনী পরিবারের মেয়ে। বাবা-মায়ের সঙ্গে বিদেশ যাচ্ছে, এয়ারপোর্টে ডিউটি ফ্রি দোকানে ঢুকে বের হওয়ার সময় শুরু হলো ঝামেলা। দোকানের বিক্রয়কর্মী দাবি করলেন, সাদিয়া তাঁদের দোকান থেকে কিছু একটা না বলে নিজের ব্যাগে ঢুকিয়ে নিয়েছে। শুনে তো সাদিয়ার বাবা-মা রেগে আগুন, কিন্তু সাদিয়ার ব্যাগ চেক করে পাওয়া গেল খুবই কম দামের একটি নেইল পলিশ। সে সত্যিই দোকান থেকে তুলে নিয়েছিল। বাবা-মা তো লজ্জায় অধোবদন। নিয়মকানুনের নানা ঝামেলা শেষে তাঁরা ফ্লাইট ধরতে পারলেন। সাদিয়ার বক্তব্য, সে নিজেকে সংবরণ করতে পারছিল না এবং সত্যিকার অর্থে তার এই নেইল পলিশের কোনো প্রয়োজনও ছিল না!

দুই.
২০ বছর বয়সী সজীবের সমস্যা আরেকটু ভিন্ন। তিনি ইন্টারনেটে খুব বেশি পরিমাণে আসক্ত। ইন্টারনেট ব্যবহার করতে না পারলে তাঁর মনে অশান্তি তৈরি হয়, অস্থির লাগে। এমন নয় যে সে নিষিদ্ধ কোনো ওয়েবসাইট দেখে, কিন্তু ইন্টারনেটে সে প্রায় দিনের একটা বড় সময় কাটিয়ে দেয়। তাঁরও বক্তব্য যে নিজেকে সামলাতে পারেন না।

তিন.
২২ বছর বয়সের বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়া সুমী। তিনি কারণে-অকারণে মিথ্যা বলেন। এটা তাঁর ছোটবেলার অভ্যাস। ছোটবেলায় বিষয়টি বড় সমস্যা না হলেও এই বয়সে তাঁর এই মিথ্যা বলার জন্য তিনি ক্রমেই একা হয়ে যাচ্ছেন, বন্ধু-স্বজনদের কাছে হেয় হচ্ছেন। তাঁর এই মিথ্যা বলে কোনো লাভ হয় না, হয়তো সেগুলো নিতান্তই ছাপোষা মিথ্যা বা বানিয়ে বানিয়ে কথা বলা, যাতে কারও কোনো ক্ষতি হচ্ছে না বা কারও কোনো লাভ হচ্ছে না। তবু তিনি এগুলো বলে যাচ্ছেন। জিজ্ঞাসা করা হলে তিনিও বলেন যে কোনোভাবে মিথ্যা না বলা থেকে নিজেকে বিরত রাখতে পারেন, তাঁর অস্থিরবোধ হয়। মিথ্যা বা বানিয়ে বলে তবেই শান্তি।

মানসিক স্বাস্থ্যবিজ্ঞানে এগুলো ইম্পালস কন্ট্রোল ডিসঅর্ডারের অন্তর্ভুক্ত। আবার বলা যায় এগুলো করার জন্য ব্যক্তি নিজের মধ্যে একধরনের অপ্রতিরোধ্য তাড়না অনুভব করেন। বাধ্য হন। কখনো এটি ইম্পালসিভ (তাড়নাগত) আবার কখনো হয়ে ওঠে কম্পালসিভ (বাধ্যতাধর্মী)। যেমন সাদিয়ার যে ‘চুরি’র সমস্যা, তা আসলে প্রথাগত চুরি নয়। তার সমস্যাটির পোশাকি নাম ক্লেপটোম্যানিয়া। পৃথিবীর বিখ্যাত অনেক ব্যক্তির এই সমস্যা ছিল বলে প্রচার রয়েছে। এ সমস্যা যাঁর থাকে, তিনি যখন-তখন দোকান, বিমানবন্দর বা হোটেল-রেস্তোরাঁ এমনকি কারও বাসা থেকে বিভিন্ন জিনিস ‘চুরি’ করে নিয়ে আসেন। গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, যা তিনি নিয়ে আসেন, তা তাঁর ব্যক্তিগত কোনো প্রয়োজনে লাগে না বা টাকার জন্য তিনি সেটি বিক্রিও করেন না। সাধারণ চুরির সঙ্গে এখানেই পার্থক্য। এই আচরণ বারবার করে থাকেন এবং জিনিসটি নেওয়ার আগে তাঁর মধ্যে এক তীব্র উৎকণ্ঠা বা দুশ্চিন্তা তৈরি হয়। সফলভাবে জিনিসটি নেওয়ার পর তিনি স্বস্তি বা আরাম অনুভব করেন। যতক্ষণ সেটি তাঁর কবজায় না আসছে, ততক্ষণ তাঁর মানসিক চাপ কমে না। জিনিসটি হতে পারে খুবই খেলো, ছোট এবং কম দামি (যেমন: কলম, ইরেজার, তোয়ালে); আবার হতে পারে মূল্যবান কিছু (যেমন: গয়না, টাকা, মুঠোফোন)। কিন্তু মূল কথা হচ্ছে উদ্দেশ্য। যে সাধারণ চোর, তার উদ্দেশ্যই থাকে লোভে পড়ে বা টাকার কারণে চুরি করা। আর যাঁর ক্লেপটোম্যানিয়া আছে, তিনি নিজের টেনশন কমানোর জন্য ‘চুরি’ করেন। কাউকে ক্ষতিগ্রস্ত করা, প্রতিশোধ নেওয়া বা বিক্ষুব্ধ হয়ে কাজটি তিনি করেন না। লুকিয়ে নিয়ে আসা জিনিসটি তিনি কখনো ফেলে দেন বা লুকিয়ে রাখেন বা মালিকের অগোচরে সেটি জায়গামতো ফিরিয়ে দিয়ে আসেন। পুরুষদের চেয়ে নারীদের এই সমস্যা বেশি, আর প্রতি এক হাজার মানুষের মধ্যে প্রায় ছয়জনের এই সমস্যা রয়েছে বলে গবেষকেরা মনে করেন। শিশু-কিশোরেরা অনেক সময় কন্ডাক্ট ডিসঅর্ডার বা আচরণজনিত মানসিক সমস্যার কারণে চুরি করে থাকে, যা ক্লেপটোম্যানিয়া থেকে আলাদা।
ক্লেপটোম্যানিয়া ছাড়াও আরও কিছু ইম্পালস কন্ট্রোল ডিসঅর্ডার আছে যেমন ‘প্যাথলজিক্যাল লাইয়িং’ অর্থাৎ বিনা কারণে মিথ্যা বলা বা বানিয়ে বানিয়ে কথা বলা। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘কাকাবাবু’ সিরিজের বইয়ে জোজো চরিত্রটিতে আমরা এ ধরনের মিথ্যা বলা আর বানিয়ে কথা বলার প্রবণতা দেখি। কারও আছে ইন্টারনেটে আসক্তি, কারও বা টেনে টেনে মাথার চুল ছিঁড়ে ফেলার প্রবণতা (ট্রিকোটিলোম্যানিয়া), বা নিজের ত্বক খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে তুলে ফেলা (স্কিন পিকিং)।
কেউ আছেন কোনো উদ্দেশ্য ছাড়াই অন্যের সম্পত্তি বা ঘরে আগুন লাগিয়ে দেন (পাইরোম্যানিয়া), কেউ বা নানা ধরনের স্বাভাবিক বা অস্বাভাবিক যৌনচিন্তা ও আচরণে সব সময় আচ্ছন্ন থাকেন যে এ বিষয়ে চিন্তা না করে থাকতেই পারেন না, যাকে বলা হয় সেক্সুয়াল কম্পালসন। এ ছাড়া আরও কিছু ইম্পালস কন্ট্রোল ডিসঅর্ডার রয়েছে যেমন প্যাথলজিক্যাল গ্যাম্বলিং, যেখানে ব্যক্তি সব সময় একটা জুয়া বা বাজি ধরেন, এতে তাঁর আর্থিক, সামাজিক ক্ষতি কী হচ্ছে, সে চিন্তা করেন না; বাজি না ধরতে পারলে তাঁর মনে অশান্তি বিরাজ করে। আরেকটি সমস্যা হচ্ছে কম্পালসিভ শপিং, এ সমস্যা যাঁদের আছে, তাঁরা প্রয়োজনে-অপ্রয়োজনে কেনাকাটা করে ঘর ভর্তি করে ফেলেন, তা কাজের জিনিস হোক আর অকাজের। কিনতে না পারলে তাঁর উৎকণ্ঠা দূর হয় না। আরেক প্রকার ইম্পালস কন্ট্রোল ডিসঅর্ডার হচ্ছে তুচ্ছ কারণে বা কারণ ছাড়াই হঠাৎ খুব রেগে যাওয়া (ইন্টারমিটেন্ট এক্সপ্লোসিভ ডিসঅর্ডার)। হঠাৎ তাঁরা রেগে ফেটে পড়েন, অন্যকে গালিগালাজ করেন বা আক্রমণ করেন।
কেন এই ইম্পালস কন্ট্রোল ডিসঅর্ডার হয়ে থাকে, তা নিয়ে বিতর্ক রয়েছে, চলছে গবেষণা। প্রচলিত মতবাদগুলো হচ্ছে, একজন মানুষের বেড়ে ওঠার প্রক্রিয়ায় ধারণাগত ও আচরণের বিবর্তন এবং মস্তিষ্কের কিছু রাসায়নিক পদার্থের কমবেশি হওয়ার কারণে এই সমস্যা হয়ে থাকে। সমাজ ও আইন এই সমস্যাকে কীভাবে দেখবে, তা নিয়েও আছে মতভেদ—কোনো আইনে এগুলো রোগ হিসেবে বিবেচিত হলে শাস্তি কম দেওয়া হয়, আবার কোনো দেশের আইনে শাস্তি দেওয়ার সময় এটিকে রোগ হিসেবে বিবেচনায় নেওয়া হয় না।
চিকিৎসার মাধ্যমে এই সমস্যা অনেকটাই নিয়ন্ত্রণ করা যায়—সাইকোথেরাপি, বিশেষ করে কগনিটিভ বিহেভিয়ার থেরাপি ও কিছু ওষুধ সেবনের প্রয়োজন হতে পারে। তাই কারও যদি এ ধরনের সমস্যা থেকে থাকে, তবে বড় ধরনের আইনি ঝামেলায় পড়ার আগেই বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া জরুরি।

ইম্পালস কন্ট্রোল ডিসঅর্ডারকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে চিকিৎসার পাশাপাশি যা করতে পারেন
* স্বজন বা বন্ধুদের কাছে বিষয়টি ব্যাখ্যা করুন। ঝুঁকিপূর্ণ সময়ে তাঁরা আপনাকে বিপদ থেকে রক্ষা করবেন এবং প্রয়োজনে প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নেবেন।
* ইম্পালস কন্ট্রোল করতে না পারার বিষয়টি ডায়েরিতে লিখে রাখুন—তাহলে একপর্যায়ে দেখতে পাবেন চিকিৎসায় কতটুকু উন্নতি হচ্ছে।
* একই ধরনের সমস্যা আছে এবং যাঁরা চিকিৎসা গ্রহণ করে এটিকে নিয়ন্ত্রণে রেখেছেন, তাঁদের নিয়ে সহায়তাকারী দল গঠন করুন,
একে অন্যকে পরামর্শ দিন।
* যেসব পরিস্থিতিতে এমন ঘটনা ঘটাতে পারেন, সেই পরিস্থিতিগুলো এড়িয়ে চলুন ও নিকটজনের কাছাকাছি থাকুন।
* নিজের তাড়নাগুলো নিয়ন্ত্রণে রাখতে চিন্তাকে অন্যদিকে সরানোর লক্ষ্যে থট ডাইভারশন জাতীয় বিহেভিয়ার থেরাপি যেমন হাতে রাবার ব্যান্ড লাগিয়ে আস্তে আস্তে তা বারবার টানা, উল্টোদিক থেকে সংখ্যা গণনা ইত্যাদি করা যেতে পারে। আর আপনার আশপাশে কারও যদি এই ধরনের সমস্যা থেকে থাকে, তাহলে আপনি ব্যাপারটা নিয়ে রাগারাগি না করে সহানুভূতির সঙ্গে নিন, দরকার হলে চিকিৎসকের পরামর্শ নিন।
লেখক: মনোরোগ বিশেষজ্ঞ
ই-মেইল: [email protected]