বরপক্ষ বড় বেশি!

পাত্রী উচ্চশিক্ষিত। সবদিক থেকেই পাত্রের যোগ্য। আবার কোনো কোনো ক্ষেত্রে পাত্রীর যোগ্যতা পাত্রের থেকে হয়তো বেশিই। তবুও বিয়ের কনে দেখা বা বিয়ের আসরে বরপক্ষ মনে করে তাঁরাই বড় বেশি। এ চিত্র কি পাল্টাবে না?
বরপক্ষ বলে কনে বা কনেপক্ষকে ছোট করে দেখা শোভন আচরণ নয়। মডেল: জামান, স্বপ্না ও এশা, ছবি: সুমন ইউসুফ
বরপক্ষ বলে কনে বা কনেপক্ষকে ছোট করে দেখা শোভন আচরণ নয়। মডেল: জামান, স্বপ্না ও এশা, ছবি: সুমন ইউসুফ

ছেলের বিয়ের জন্য পাত্রী দেখা চলছে অনেক দিন থেকেই। কাউকে ছেলের মনে ধরে তো ছেলের মা-খালা-ফুফুর মনে ধরে না। একের পর এক মেয়ে দেখা চলছেই। অনেক ক্ষেত্রেই এই আদিখ্যেতা ‘বিয়ে’ নামক সামাজিক অনুষ্ঠানের মৌলিক অংশ। এতে যে মেয়েদের ছোট করা হচ্ছে তা নারী হয়েও আমাদের মা, খালা, ফুফুদের তখন মনে থাকে না। বর-কনের একটি অসফল দেখাদেখি পর্ব বাস্তবে জন্ম দেয় নানা দুঃখজনক ঘটনার। পাত্রী ও পাত্রীপক্ষ মনোবেদনা, অসম্মান, প্রত্যাখ্যানের যন্ত্রণার শিকার হয়। এ নিয়ে গল্পের শেষ নেই আমাদের চারপাশে।
পাত্রী উচ্চশিক্ষিত। দেখতে-শুনতেও ভালো। চলনে-বলনে কোনো দোষ নেই। পাত্রী দেখাদেখি হলো, কিন্তু বিয়ে হলো না। পাত্রের কোনো এক চাচাকে পাত্রী নাকি ‘যথাযথ’ সম্মান দেয়নি। এ ঘটনার শিকার সেই মেয়ে এতটাই বিমর্ষ হয়ে পড়েছিল যে তাকে মনোরোগ চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হয়েছিল।
বিয়েবাড়ির গেট। চলছে হৈহল্লা। কে জেতে কে হারে? মান-ইজ্জতের প্রশ্ন। যেভাবেই হোক বরপক্ষকে ভেতরে ঢুকতে হবেই। সেই যে তুলকালাম কাণ্ড শুরু হলো তা যেন আর শেষ হয় না। এই পর্বটা খুনসুটি পর্যন্ত থাকলেই ভালো। কিন্তু অনেক সময় এই মজা আর মজার পর্যায়ে থাকে না। পাত্রপক্ষ বলে কথা। বড়াই-বড়ত্ব তো দেখাতেই হবে।
বিয়ের অনুষ্ঠানে হোক কিংবা খাওয়াদাওয়া পর্বেই হোক—পাত্রীপক্ষকে হেয় করতেই হবে যে। আর এ কাজে রয়েছে অনেক রকম অস্ত্র। আগেও চল ছিল—এখনো মফস্বলে অনেক জায়গায় বরপক্ষÿভোজনপটু লোকজন নিয়ে যায় সঙ্গে। উদ্দেশ্য—১০ জনের খাবার একা সাবাড় করে পাত্রীপক্ষকে ‘ডাউন’ দেবে। পাত্রীপক্ষকে জব্দ করতে না পারলে আর মজা কোথায়!
এই চল নতুন নয়। এই ধারাকে বদলানোর কোনো প্রয়াসও দেখা যায় না অনেক ক্ষেত্রে। বরং বিয়ের অনুষ্ঠানের নিছক নির্দোষ আনন্দ বলে আখ্যা দিয়ে চালু রাখা হচ্ছে এখনো। পাত্র ভোজনপটু হোক না হোক, তার জন্য আস্ত খাসির রোস্ট চাই-ই চাই। এক ডজন আস্ত মুরগির রোস্টও চাই।
মানুন বা না-ই মানুন, যৌতুককে আমরা বিদায় দিতে পারিনি এখনো। গোপন নানা কেতায় টিকে আছে যৌতুক। আর তাই এখনো যৌতুকের বিরুদ্ধে লড়ে যেতে হচ্ছে সচেতন মানুষকে। নানা শাস্তির বিধান সত্ত্বেও তা চলছে।
পাত্র যৌতুকের একদম বিরুদ্ধে। কিন্তু তাকে একটা মোটরসাইকেল উপহার দিলে মন্দ হয় না। সেটায় চড়ে বউকে নিয়ে সাড়ম্বরে শ্বশুরবাড়ি যেতে পারবে। খাট, লেপ তোশক, চাদর, বালিশ, এলইডি টিভি, প্রেশার কুকার, হাঁড়ি-পাতিল, ড্রেসিং টেবিলসহ নানা আসবাব না দিলে সেটা কেমন দেখায়! সংগতি থাকলে ফ্ল্যাট-জমি-প্লট দিলে আরও ভালো। কন্যা তাতে সুখে থাকবে। থাকা-খাওয়া নিয়ে কন্যাকে কোনো দুশ্চিন্তা করতে হবে না যে! এমন একখানা নামজাদা বিরল পাত্র পাওয়া গেছে—তাকে যত দেওয়া যায়, ততই তো মঙ্গল। এতেই যেন মেয়ের সুখ! এটা-ওটা নানা ভুজংভাজুং করে এই যে উপহারের মোড়কে যৌতুক নেওয়া—এটাও বরপক্ষের বড়ত্ব জাহিরেরই অংশ।
কন্যারই হোক কিংবা পুত্রের, বিয়ে তো বিয়েই। অথচ আমরা দুটি ক্ষেত্রে দুই রকম আচরণ করি। নিজের মেয়ের বেলায় দেখা যায় বেশ কাঁচুমাচু ভঙ্গিতে পাত্রপক্ষকে আপ্যায়ন করতে। ভাবখানা মেয়ের বিয়ে তো নয়—জীবনের কঠিন কোনো দুর্যোগ মোকাবিলা। কন্যাদায়গ্রস্ত পিতা বলার চল আছে এখনো। যদিও এখনকার নারী স্বাবলম্বী। সে আর মা-বাবার দায় নয়। লেখাপড়া জানে। চাকরিবাকরি করে। অর্থকরী কাজে নারী যুক্ত। সমাজে, সংসারে তার ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। তাকে নিয়ে কাঁচুমাচু হতে হবে কেন?
আসলে আমরা ভুগছি হাজার বছরের পুরোনো কুসংস্কারে। এটাকে কখনো সামাজিক আচার, বৈবাহিক সংস্কৃতি, কালচার, ধর্মীয় আচরণের নামে আধুনিক আলোকিত জমানাতেও টিকিয়ে রাখতে চাইছি।
পাত্রীকে বা তার আত্মীয়স্বজনকে ছোট হতেই হবে। বিয়ের আগে যে মেয়ে গান গাইত, বিয়ের পর তাকে তা ছাড়তেই হবে। নাচলে সে যেন অপরাধ। আবৃত্তি করলে সেটাও বাদ। ঘরের বউয়ের গলা উঁচু হবে কেন! কী করবে ঘরের বউ! শুধু ঘরকন্না করবে। রান্নাবান্না করবে। সন্তানের জন্ম দেবে, লালনপালন করবে। ঘর সামলাবে।
অনেক দৃষ্টান্ত রয়েছে চারপাশে। এমনও আবদার করা হয়—বিয়ের পর পাত্রীকে চাকরি ছাড়তে হবে। ভালো চাকরি। ভালো বেতন। মেয়েটি নিজের পায়ে দাঁড়ানো। নাহ্! পাত্রী হিসেবে একদম অচল। চাকরি ছাড়িয়ে যদি বউকে ঘরদোরের কাজের গৃহকর্মী না বানানো যায়, তাহলে পাত্রের সম্মানটা থাকে কোথায়!
কেউ কেউ আছেন, মেয়ের বিয়ের সময় যদি একবার ঠকে যান তবে সেটা ষোলো আনা তুলে আনতে চান ছেলেকে বিয়ে করিয়ে আনার মাধ্যমে। এ যেন প্রতিশোধপর্ব। অনেকে নিজের বিয়ের সময় শ্বশুরবাড়ি থেকে বিশেষ কিছু পাননি। কিন্তু সেই খেদ মনে মনে আজও বয়ে চলেছেন। সেটাও পুষিয়ে ফেলতে চান ছেলেকে বিয়ে করানোর মাধ্যমে। ছেলেকে পণ্য বানিয়ে ছাড়েন নিজেদের অজান্তেই। অথচ পাত্রীর যোগ্যতা বিভিন্ন গুণা দুই পক্ষের সমঝোতা—যেগুলোর প্রতি নজর দেওয়া দরকার সেসব বিষয়ে চোখ বুজে থাকে সবাই।

যা চলছে বিয়ের নামে
পানচিনি, হলুদ-সন্ধ্যা, বিয়ে, বউভাত—এই চারটি অনুষ্ঠান সামর্থ্য থাকুক বা না থাকুক করতে হবে কনভেনশন সেন্টারে। নিদেনপক্ষে পাড়ার কোনো কমিউনিটি সেন্টারে। এটা নাকি স্ট্যাটাস সিম্বল। আর তা চাপিয়ে দেওয়া হয় কনেপক্ষের ওপর। এ রকমই ঘটনার শিকার আমার কাছে আসা এক মেয়ে। ছেলের আগে একটা বিয়ে হয়েছিল। সেটা যেকোনো কারণেই হোক ভেঙে গেছে। বিয়ের যখন আলাপ চলছিল, পাত্র একদম তা লুকিয়ে গেছে। জানাজানি হলো বিয়ের অনুষ্ঠানের দিন। বিয়ের পিঁড়িতে বসে এটা জানলে মনের অবস্থা কী হয়? নববিবাহিত মেয়েটির প্রশ্নে আমি বিব্রত। সে কেঁদেই চলছিল। তার এখন মনোসমস্যা হলো—মেয়েটি এখন কোনো বিয়ের অনুষ্ঠানে যেতে চায় না। গেলেই সেই দুঃসহ মুহূর্তের দৃশ্য চোখে ভেসে ওঠে। কাজের মাঝখানেও সেই কথা মনে আসে। আনমনা হয়ে যায়। অস্থিরতা বোধ করে।
বিয়ের নানা আয়োজন অবশ্যই হবে। কনেপক্ষ, বরপক্ষ অবশ্যই উৎসব করবে। কিন্তু তাতে সমতা থাকা চাই। কনেপক্ষের ওপর চাপিয়ে দেওয়া চলবে না। গয়নাগাটি, বর্ণাঢ্য অনুষ্ঠান—বরের নানা চাহিদা চাপিয়ে দেওয়া অন্যায়। এগুলো হবে উভয় পক্ষের আন্তরিকতার ভিত্তিতে। সংগতি অনুযায়ী সব হবে।

কেন এই জটিলতা
নিজের অতৃপ্তি, অপ্রাপ্তি মানুষ তার ছেলেমেয়ের মধ্য দিয়ে পূরণ করতে চায়। যার যেটা অভাব, স্বাভাবিকভাবেই সেটা সে পূরণ করতে চাইবে। নিজে পারেনি বলেই মানুষ ছেলেমেয়ের মধ্য দিয়ে তার বাস্তবায়ন ঘটাতে চায়। অনেক সময় নিজের বাস্তবজ্ঞানের আলোকে সন্তানদের আলোকিত করতে চায়। কিন্তু প্রলুব্ধ মন যখন চোখে পর্দা ফেলে, তখন জটিলতা তো দেখা দেবেই।

এভাবে কত দিন চলবে
হাসপাতালে ভর্তি হলো ২২-২৩ বছরের একটা মেয়ে। হুইলচেয়ারে বসা। ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছে। আমার রুমের দরজার সামনে। কথা বলতে পারছে না, হাঁটতেও পারছে না সপ্তাহ খানেক হলো। কথা বলে জানা গেল, মেয়েটির বিয়ে হয়েছে তিন-চার বছর। বাবার আর্থিক সচ্ছলতা তেমন নয়। একটি ছেলেও আছে। মেয়েটির অসুস্থ শাশুড়িকে দেখতে গেছে মেয়েটির বাবা। হাতে এক কেজি ফজলি আম। শাশুড়ি তেলেবেগুনে জ্বলে গেলেন। কোন সাহসে তাঁর বেয়াই মাত্র এক কেজি আম নিয়ে তাকে দেখতে গেলেন? এ নিয়ে বাবার সামনেই মেয়েকে যা মন চায় বললেন। বাবা চলে গেলেন। আর মেয়েটি প্রচণ্ড মানসিক আঘাত পেল। ভর্তি হলো হাসপাতালে।

যা হলে ভালো হয়
* এই গ্লানির বাস্তবতা বছরের পর বছর ধরে চলছে। নাটকে, উপন্যাসে এখনো পাত্র বিয়ের সময় মাকে বলে, ‘তোমার জন্য দাসী আনতে যাচ্ছি।’
* কেন বলে? এটা বলাই নাকি সামাজিক রীতি। যে মাকে দাসী এনে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে পুত্র যাচ্ছে, বলা বাহুল্য; সেই মাও একদিন দাসীর মর্যাদা নিয়েই এই সংসারের চৌকাঠে পা দিয়েছিলেন।
* এটা গল্প বা নাটকের হলেও বাস্তবে এ থেকে আমরা মুক্ত হতে পারিনি। মনে মনে এই প্রবৃত্তিই ধারণ করে চলেছি।
* আর তাই নিজের মননকে শুদ্ধ করতে হবে আগে। পাত্রী বা পাত্রীপক্ষকে হেয় করার প্রবৃত্তি থেকে নিজেকে দূরে রাখতে হবে। মনোবিজ্ঞানশাস্ত্রে একটা কথা আছে—ইমপ্যাথেটিক অ্যাটিচ্যুড। অন্যের সমস্যাকে নিজের সমস্যা হিসেবে বিবেচনা করতে হবে। পাত্রপক্ষ হিসেবে যে জুতোয় পা গলিয়ে খুব হামবড়াই করা হলো; পাত্রীপক্ষÿহলে একই ব্যক্তি বা পক্ষকে সেই জুতো খুলে অসম্মানের শিকার হতে হচ্ছে। সুতরাং রুচি, অভ্যাস, দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টালেই তো হয়। বিবাহ ও সংসার নামক সামাজিক সংগঠন মানবজাতির ইতিহাসে অনিবার্য ও ইতিবাচক অংশ। নর ও নারী; পাত্র ও পাত্রী—উভয়কে নিয়েই এই সংসার। তারাই সংসারের ওতপ্রোত জরুরি অঙ্গ। অপরপক্ষকে হেয় না করে সম্মানের ও মর্যাদার সম্ভ্রম প্রতিষ্ঠাই এই বিবাহ সংগঠনকে মজবুত ভিত্তি দেবে।

সুলতানা আলগিন : সহযোগী অধ্যাপক, মনোরোগবিদ্যা বিভাগ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা