'উই শ্যাল ওভারকাম'

ইংরেজিতে ‘উই শ্যাল ওভারকাম’ নামে একটি গান আছে। অসম্ভব দারুণ রকমের পজিটিভ স্বপ্ন দেখায় গানটি। জোয়ান বায়েজের (১৯৪১) গাওয়া এ গানটির কথা মনে পড়ছে বেশ কিছুদিন ধরে।

করোনা আক্রান্ত পৃথিবী এই মুহূর্তে কঠিন সময়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। এই মুহূর্তে পৃথিবীর ৩২ লাখের বেশি মানুষ করোনায় আক্রান্ত। মৃতের সংখ্যা বাড়ছে জ্যামিতিক হারে। প্রথম ৮০ দিনে যেখানে মারা গিয়েছিলেন ৫০ হাজারের মতো, সেখানে পরের সাত থেকে দশ দিনে মারা গিয়েছিলেন আরও ৫০ হাজারের মতো। এখন পর্যন্ত মারা গেছেন ২ লাখ ৩৩ হাজারের বেশি মানুষ।

আমাদের এই দক্ষিণ এশিয়ায় কিছুদিন যদিও আক্রান্ত ও মৃতের হার কম ছিল। এখন তা বাড়ছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ইতিমধ্যেই ভাইরাসটিকে মহামারি হিসেবে ঘোষণা দিয়েছে।

পৃথিবীতে মহামারির ঘটনা কিন্তু মোটেই নতুন নয়। পৃথিবীর পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে নানা মহামারিতে মানুষ আক্রান্ত হয়েছে একাধিকবার। সূদুর অতীত ইতিহাসে নাই–বা গেলাম। গত তিন শ বছরের ইতিহাসে যে মহামারিগুলো হয়েছে, সেগুলো হলো ১৭২০ সালে প্লেগ, ১৮২০ সালে কলেরা, ১৯২০ সালে স্প্যানিশ ফ্লু। চীন থেকে শুরু হওয়া বর্তমান মহামারিটিও উল্লিখিত মহামারিগুলোর মতো একই পথ অনুসরণ করেছে। ইতিহাস সত্যিই নিজেকে পুনরাবৃত্তি করেছে। কে জানে? কিন্তু সৃষ্টিকর্তার অপার করুণায় আমরা কিন্তু এসব মহামারিকে বারবার জয় করে এসেছি। এবারও করব ইনশা আল্লাহ।

উনিশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে জন স্নো নামের এক ইংরেজ চিকিৎসক আবিষ্কার করলেন, ১৮৫৪ সালে লন্ডনে কলেরার মূল কারণ ছিল দূষিত পানি। তাঁর এই আবিষ্কার যে শুধু মহামারির ওষুধ নিয়ে বিজ্ঞানীদের ভাবিয়ে তুলেছিল, তা নয়। এর সঙ্গে সঙ্গে বিজ্ঞানীরা জনস্বাস্থ্য, রোগ এবং তার ছোঁয়াচে বৈশিষ্ট্য নিয়েও ক্রমেই ভাবতে শুরু করলেন। শেষে একসময় এই রোগের বাহককে খুঁজে বের করলেন। জানলেন, তা কীভাবে ছড়ায় এবং কীভাবে দ্রুত হারে মানবশরীরে এই রোগ বাড়তে থাকে। ধীরে ধীরে চিকিৎসাভিত্তিক প্রমাণের ওপর ভিত্তি করে এই রোগের ব্যবস্থা নেওয়া হয়, যাতে পৃথিবীতে মানুষের অস্তিত্ব টিকে থাকে।

‘টাইফয়েড মেরি’র কথা নিশ্চয় আমরা অনেকেই জানি। আইরিশ আমেরিকান এই নারীর আসল নাম মেরি মেলন। পেশায় ছিলেন কুক। কিন্তু ১৯০৮ সাল থেকে তিনি পরিচিত হয়ে উঠেছিলেন ‘টাইফয়েড মেরি’ নামেই। কাজের ধরনের জন্য নিজের অজান্তেই তিনি টাইফয়েডের বাহক হয়ে বহু সম্ভ্রান্ত পরিবারে এই রোগ ছড়িয়েছিলেন। এ জন্য ১৯১০ সাল পর্যন্ত বছর দুয়েক তাঁকে আইসোলেশনে রাখা হয়েছিল। পরবর্তীকালে তাঁরই কারণে নিউইয়র্কের একটি হাসপাতালে ১৯১৫ সালে ফের মহামারি ছড়ায়। মৃত্যুর দিন পর্যন্ত কোয়ারেন্টিনে ছিলেন ওই নারী। ১৯৩৮ সালে ৬৯ বছর বয়সে তিনি মারা যান।

২০২০ সালে এসেও গল্পটা কিন্তু প্রায় একই রকম। বিজ্ঞানের উন্নতি ঘটলেও ওই সময় টাইফয়েডের ওষুধ ছিল না। তেমনিভাবে এখনো কোভিড-১৯–এর কোনো ওষুধ অদ্যাবধি আবিষ্কার করা সম্ভব হয়নি। চিকিৎকেরা বলছেন, এর বিরুদ্ধে জিততে গেলে মানুষকে ঘরে থাকতে হবে। ভাইরাসকে জয়ের ব্রত নিয়ে মেরির মতো আমরাও তাই আজ গৃহবন্দী। দেশে দেশে লকডাউন। অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড স্থবির। আমাদের দেশের মতো দেশগুলোর মানুষের একটি বিরাট অংশ অসহায়। এমন পরিস্থিতিতেও গৃহবন্দী অবস্থায় বসে বসে এক সুন্দর আগামী, সুন্দর পৃথিবীর স্বপ্ন দেখছি আমরা। আর তাই নিজের মতো বাঁচতে, সারা জীবন ঘুরতে আজ আমাদেরও এটুকু মেনে নিতে হবে। কিন্তু কিছু মানুষ তা শুনছে না।

আমরা করোনাকে জয় করার আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছি। বিজ্ঞানীদের চেষ্টার শেষ নেই। প্রতিষেধক আবিষ্কারের চেষ্টা চলছে অবিরাম। সর্বশেষ যুক্তরাজ্যের অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটির বিজ্ঞানীদের দ্বারা আবিষ্কৃত Chadox1 করোনাভাইরাসের ভ্যাকসিন হিসেবে পরীক্ষামূলকভাবে মানবদেহে প্রয়োগ করা হয়েছে ২৪ এপ্রিল। হাজার হাজার জন স্নো মনপ্রাণ উজাড় করে খাটছেন রোগীদের সুস্থ করতে। ওষুধ আবিষ্কার এবং টিকা বানাতে। চাচ্ছেন পৃথিবী থেকে করোনাকে মুছে দিতে। আর তাঁদের সাহায্যে এগিয়ে এসেছেন আরও অনেক জন স্নোর মতো মানুষ। তাঁরা কেউ পুলিশ, কেউ সমাজসেবী, কেউ ব্যাংকার। কেউবা আবার ব্যবসায়ী কিংবা ওষুধ বিক্রেতা। আবার কেউ এনজিও কর্মী। আছেন সামনের সারির স্বাস্থ্যকর্মীরা। আছেন অ্যাম্বুলেন্সচালকও। আমাদের বুঝতে হবে যে মহামারি সত্ত্বেও পৃথিবীর আট লাখের ও বেশি মানুষ ইতিমধ্যে সেরে উঠেছেন এই ভাইরাস থেকে।

প্রতীকী ছবি
প্রতীকী ছবি

জাপানের এক হাজার বছর বয়সী একটি চেরিগাছ আছে। চেরিগাছটির নাম ‘তাকিজাকুরা’। ওয়াটারফল চেরি ট্রি নামেও অনেকেই চেনেন একে। জাপানে ঘুরতে আসা পর্যটকের অনেকেই এ গাছটির সৌন্দর্য একনজর দেখতে ভিড় জমান ফুকুশিমার মিহারু এলাকায়। জাপানের দাইচি পারমাণবিক প্ল্যান্ট থেকে মাত্র তিরিশ মাইল দূরে এই গাছটির অবস্থান। জাপানের ইতিহাসে সবচেয়ে ভয়াবহ ভূমিকম্পে সৃষ্ট সুনামিতে দাইচি পারমাণবিক প্ল্যান্ট ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এর তেজস্ক্রিয়ায় আশপাশের শহরেও বিপর্যয় নেমে আসে। ক্ষতিগ্রস্ত হয় অনেক কিছুই। কিন্তু দাইচি পারমাণবিক প্ল্যান্ট থেকে মাত্র তিরিশ মাইল দূরে দাঁড়িয়ে থাকা ‘তাকিজাকুরা’র কিছুই হয়নি।

গাছটির রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বে আছেন সিদাফুমি হিরাতা। তাঁর মতে, জীবনে অনেক কঠিন বিপর্যয় দেখেছে এই গাছ। সহ্য করেছে অনেক প্রতিকূলতা । হয়তো আরও বড় কোনো বিপর্যয়ও দেখবে। হয়তো তখনো সে সবকিছুর সাক্ষী হয়ে ঠিকই দাঁড়িয়ে থাকবে অবলীলায়। কিছুই হবে না তার। তিনি আরও বলেন, গাছে চেরি ফুল ফুটছে এখনো (সূত্র: প্রথম আলো ডেস্ক, ২৫ এপ্রিল, ২০২০)। এভাবে হয়তো আরও এক হাজার বছর ফুল দিয়ে যাবে গাছটি। আর মানুষ এই গাছের থেকেই নেবে শক্তি ও সাহসের অনুপ্রেরণা।

আসুন, আমরাও প্রতিজ্ঞা করি, এই ভাইরাসের হাত থেকে আমরা নিজেদের বাঁচাব। নিজেকে সুস্থ রাখার পাশাপাশি পরিবারের এবং আশপাশের মানুষগুলোকে ও সুস্থ রাখার চেষ্টা করব। বিবেচক মানুষের মতো নিয়ম মেনে এই ভাইরাসের বিরুদ্ধে লড়াই করে যেতে হবে আমাদের। আশা করা যায়, খুব দ্রুতই পৃথিবী এই ভাইরাসের ভয়াল থাবা থেকে মুক্তি পাবে।

আশার সঙ্গে সঙ্গে সংকটের এই মুহূর্তে প্রেরণা দিতে ‘গীতবিতান’–এর রবীন্দ্রনাথ ত আর আছেনই—

সংকোচের বিহ্বলতা নিজেরে অপমান,

সংকটের কল্পনাতে হোয়ো না ম্রিয়মাণ।

মুক্ত করো ভয়, আপনা-মাঝে শক্তি ধরো, নিজেরে করো জয়।

দুর্বলেরে রক্ষা করো, দুর্জনেরে হানো,

নিজেরে দীন নিঃসহায় যেন কভু না জানো।

মুক্ত করো ভয়, নিজের ‘পরে করিতে ভর না রেখো সংশয়।

ধর্ম যবে শঙ্খরবে করিবে আহ্বান

নীরব হয়ে নম্র হয়ে পণ করিয়ো প্রাণ।

মুক্ত করো ভয়, দুরূহ কাজে নিজেরই দিয়ো কঠিন পরিচয়॥

*লেখক : কলামিস্ট। [email protected]