বানরের প্রতি নিষ্ঠুরতা মুদ্রার একপিঠ নয় তো

বানরের প্রতি এই পাশবিক নিষ্ঠুরতা যারা প্রদর্শন করতে পারে তাদের এই প্রদর্শন মানুষের প্রতি নেমে আসতে কতক্ষণ? ছোটবেলায় আমার সব থেকে প্রিয় সঙ্গী ছিল বানর। বাঁদরামির নাকি কোনো সীমা ছিল না, তাই সীমাকে ছেড়ে রীমাকে (বড় হয়েও যে মেয়েটির মোহ ছাড়তে পারিনি সহজে) নিয়ে টানাটানি করতে বলত সবাই!

আবার কথায় কথায় বলত আশকারা পেয়ে পেয়ে একেবারে মাথায় উঠেছে। বানরকে নিয়ে কখনো মশকারা করতে নেই বেশি আশকারা দিলে মাথায় উঠে পড়ে! আমিও নাকি মায়ের আশকারা পেয়ে মাথায় চড়ে বসেছিলাম! সেই থেকে বানরকে আমার জীবনের প্রিয় বন্ধু হিসেবে মনে হতো।

বন্ধু হয় নাকি মনের মিলনে। ছোটবেলা থেকেই বানরের প্রতি একটা গভীর মমতা জন্মেছিল। মা প্রায় একটা নীতিকথা দিয়ে ছোটবেলায় পড়ানো শুরু করতেন—বলতেন বানরকে আশকারা দিলে সব সময় মাথায় ওঠে! বলেই একটা গল্পের অবতারণা করতেন। এক রাজার একটা বানর ছিল। সেটি তিনি সব সময়ই দরজার কাছে বেঁধে রাখতেন এবং প্রতিদিন বাড়ি ঢোকার সময় বানরকে একটা করে লাঠির বাড়ি বরাদ্দ করতেন। ঘটনাটি রাজার এক প্রাণীপ্রেমী মন্ত্রী আমলে নিলেন এবং রাজাকে কারণ ব্যাখ্যার জন্য বিনয়ী অনুরোধ জানালেন। রাজা বললেন, তাহলে আপনি খেয়াল রাখবেন বানরের দিকে। এরপর রাজা যখন বানরের কাছ দিয়ে আসতেন প্রথম দিন রাজাকে দেখে ভয় পেয়ে দূরে সরে গেলেন। এমন কয়েক দিন মার না খেয়ে প্রথমে রাজার গা ঘেঁষে দাঁড়াতে লাগল, পরদিন মাথায় উঠে বসে পড়ল! তখন মন্ত্রীকে রাজা কী যেন ইঙ্গিত করে বুঝিয়ে দিয়েছিলেন।


তাই বলি বানর যেন সেই আদিকাল থেকে বাঙালির প্রধান একটি শিক্ষা উপকরণ; শিক্ষা দিয়েছেন আর বানরের নাম নেননি, এমন শিক্ষক মনে হয় বাঙালির ইতিহাসে বিরলতম। এমন কোনো মা–বাবা খুঁজে পাওয়া যাবে না, যাঁরা বানরকে অনুষঙ্গ বানিয়ে তাঁর সন্তানকে ডাকেননি। কিন্তু সে কখনো ভরতের ঘরে পূজিত হয় নাই! বরং হয়েছে নিগৃহী! অপর পক্ষে সমগোত্রীয় হয়েও হনুমানজি পূজিত ও বিজিত। কিন্তু এই হনুমানও বানার সেজে ধোঁকা দিয়েছে।

কিন্তু বানর কখনো পূজা পায়নি, পেয়েছে অপবাদ আর অবহেলা। তাই বানর মরলে ও মারলে কোনো বিচার হয় না। এটা খেলার অনুষঙ্গ হিসেবে। কারণ, আমাদের ছেলেবেলায় যখন ফেসবুক বিনোদন, বিনোদন জগৎকে গ্রাস করতে পারেনি তখনো বানর আর সাপ ছিল গ্রামীণ বাংলার অন্যতম খেলার মাধ্যম।

কয়েক দিন আগে প্রথম আলো পত্রিকার সংবাদ মারফত জানলাম, মাদারীপুর পৌরসভার চরমুগরিয়া এলাকার ৮ ও ৯ নম্বর ওয়ার্ডে শত বছর ধরে মানুষের পাশাপাশি বসবাস করে আসছে বানর। এ অঞ্চলে এখনো আড়াই হাজারের মতো বানর আছে। বানরের খাবরের তীব্র সংকট দেখা দেওয়ায় বানরগুলো দলে দলে ভাগ হয়ে আশপাশের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে–ছিটিয়ে রয়েছে। কিছু বানরকে স্থানীয় লোকজন স্বেচ্ছায় সকাল-বিকেল খাবার দেয়। তবে কিছু বানর খাবার না পেয়ে তারা কিছু লোকের বাড়িতে প্রায়ই হানা দেয়। কখনো কখনো ঘরের ভেতরে প্রবেশ করে রান্না করা খাবার ছিনিয়ে খায়। বানরের উৎপাত সহ্য করতে না পেরে অনেকেই বানরগুলোকে লক্ষ্য করে ইট-পাটকেল ছুড়ে মারলে বানরগুলো ভয়ে পালিয়ে যায়। কিন্তু সম্প্রতি ঘটছে ভিন্ন ঘটনা। মাস তিনেক আগেও অন্তত ১৫টি বানরকে খাবারের সঙ্গে বিষ দিয়ে মেরে ফেলা হয়। তখন বিষয়টি মানুষের মধ্যে জানাজানি না হলেও মঙ্গলবার বিকেলে খাবারের সঙ্গে বিষ মিশিয়ে একত্রে অনেক বানর মেরে ফেলার বিষয়টি নজরে আসে স্থানীয়দের। মৃত অবস্থায় উদ্ধার হওয়া ১৫টি বানরকে এলাকার একটি খাল পাড়ে মাটি চাপা দেওয়া হয়েছে।

উৎপাত সহ্য না করতে পেরে তাদের বিষ খাইয়ে মেরে ফেলেছে! কী নিষ্ঠুর, কঠিন কাজ তারা এত সরল সমীকরণে সেরে ফেলল। কিন্তু একবারও ভাবল না কেন এই বানর আজ করল উৎপাত তাদের। সবুজ, শস্য শ্যামলা বাংলায় কেন বানরেরা আজ এত অসহায়? আর কত কত নিষ্ঠুর হলে আমাদের জ্ঞান ফিরবে? তাহলে কি রবিঠাকুরের সেই প্রার্থনা আমাদের আবার করতে হবে?

‘দাও ফিরে সে অরণ্য, লও এ নগর,


লও যত লৌহ লোষ্ট্র কাষ্ঠ ও প্রস্তর


হে নবসভ্যতা! হে নিষ্ঠুর সর্বগ্রাসী,


দাও সেই তপোবন পুণ্যচ্ছায়ারাশি,


গ্লানিহীন দিনগুলি, সেই সন্ধ্যাস্নান,


সেই গোচারণ, সেই শান্ত সামগান,


নীবারধান্যের মুষ্টি, বল্কলবসন,


মগ্ন হয়ে আত্মমাঝে নিত্য আলোচন


মহাতত্ত্বগুলি। পাষাণপিঞ্জরে তব


নাহি চাহি নিরাপদে রাজভোগ নব—


চাই স্বাধীনতা, চাই পক্ষের বিস্তার,


বক্ষে ফিরে পেতে চাই শক্তি আপনার,


পরানে স্পর্শিতে চাই ছিঁড়িয়া বন্ধন


অনন্ত এ জগতের হৃদয়স্পন্দন।’


*লেখক: শিক্ষার্থী