একজন এফ আর খান

স্ট্রাকচারাল ইঞ্জিনিয়ার এবং স্থপতি এফ আর খান
স্ট্রাকচারাল ইঞ্জিনিয়ার এবং স্থপতি এফ আর খান

৩ এপ্রিল ছিল বিশ্বখ্যাত স্ট্রাকচারাল ইঞ্জিনিয়ার এবং স্থপতি এফ আর খানের ৮৮তম জন্মদিন। ১৯২৯ সালের এই দিনে বাংলাদেশের মাদারীপুর জেলার শিবচর উপজেলায় তিনি জন্মগ্রহণ করেন। গুগল যদি তাদের ডুডল দিয়ে খোঁচা না দিত, তাহলে আমরা অধিকাংশ বাঙালিরা এই অসাধারণ মানুষটির জন্মদিনটি হয়তো মনেও করতে পারতাম না। অথচ অত্যন্ত স্বল্পসংখ্যক যে কয়েকজন মানুষ শিল্প, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে বাঙালির অবস্থান বিশ্বমানে তুলে দিয়ে গেছেন, ফজলুর রহমান খান তাঁদেরই একজন।
ফজলুর রহমান খান ১৯৮২ সালের ২৬ মার্চ জেদ্দায় মৃত্যুবরণ করেন। এর পরের বছরেই আমি যুক্তরাষ্ট্রে আসি। সেই সময় এ দেশের মানুষ বাংলাদেশকে প্রায় চিনত না বললেই চলে। কোত্থেকে এসেছ, এই প্রশ্নের উত্তরে বাংলাদেশ বললে অনেকেরই পরবর্তী প্রশ্ন হতো, ‘সেটা কোথায়?’ একটু দিন দুনিয়ার খবর রাখে, এমন মানুষ হলে বলত, ‘ও, বাংলাদেশ; তোমাদের দেশে না দুর্ভিক্ষে প্রত্যেক বছর শত শত লোক মারা যায়’ অথবা, ‘তোমাদের দেশটা তো সব সময় বন্যার পানির নিচে থাকে।’ কথাগুলোয় শ্লেষের ছোঁয়া অস্পষ্ট থাকত না। তাই ওই প্রশ্নটার মুখোমুখি হলেই কেমন একটা অস্বস্তিতে ভুগতাম। আশ্চর্য, প্রথম চাকরির ইন্টারভিউতে বসে এ প্রশ্নটাই আমাকে শুনতে হলো। আমার সিভিতে চোখ বুলাতে বুলাতে ইন্টারভিউ বোর্ডের একজন মন্তব্য করে বসলেন, ‘তুমি দেখছি বাংলাদেশের লোক।’ মেজাজটা খারাপ হয়ে গেল। জানি, এর পরেই আসছে পৃথিবীর অন্য প্রান্তের কিছু দুর্ভিক্ষপীড়িত আর বন্যাকবলিত মানুষের জন্য হালকা সহানুভূতির কিছু বাণী। কিন্তু না, অবাক হয়ে শুনলাম তিনি বললেন, ‘তুমি এফ আর খানের দেশের লোক?’ ধাক্কাটা সামলে উঠে উত্তর দেওয়ার আগে বুকটা গর্বে ফুলে উঠল, শুধু বললাম, ‘জি।’ অবিশ্বাস্য হলেও এই দেশে আমার দ্বিতীয় চাকরির সাক্ষাৎকারের প্রথম দশ মিনিটের মধ্যেই সেই একই প্রসঙ্গ উঠে এল। এবার আর কোন দেশের লোকটোক না, সিভির পাতায় চোখ রেখে সরাসরি, ‘তুমি তো দেখছি এফ আর খানের দেশ থেকে এসেছ।’ পেশাগত কারণে এ কথাটি তখন বিভিন্নভাবে গত কয়েক বছরে অনেক শোনা হয়ে গেছে; তাই প্রথম ইন্টারভিউয়ের মতো চমকে গেলাম না। কিন্তু পরের কথাটি শুনে আবারও অবাক হতে হলো। আমার ভাবি চাকরিদাতা বললেন, ‘তুমি জানো, আমি তার সঙ্গে পাঁচ–পাঁচটি বছর এক অফিসে কাজ করেছি।’ কথাটি বলার সময় মনে হলো তার চোখে একধরনের দ্যুতি খেলে গেল। সেই দ্যুতি, যা দেখা যায় বাংলাদেশের কোনো এক পড়ন্ত বয়সী গ্রাম্য কৃষকের চোখে যখন সে গল্প করে, কেমন করে মাইলের পর মাইল হেঁটে সে একাত্তরের ৭ মার্চে রেসকোর্সের মাঠে গিয়ে পৌঁছেছিল, কিংবা সেই বৃদ্ধার চোখে যার দুটি গালে এখনো জন কেনেডির সযত্নে দেওয়া চুম্বনের ছোঁয়া লেগে আছে। এফ আর খানের ব্যাপারে লিখতে গিয়ে বলা এই কথাগুলো কি একটু বাড়াবাড়ি মনে হচ্ছে? হয়তো; কিন্তু ভবন নির্মাণ আর নকশাশিল্পের সঙ্গে জড়িত পেশাজীবীদের কাছে মনে হয় তা হবে না। কী করেছিলেন তিনি, যে কারণে প্রকৌশলী স্থপতিরা তাঁকে এখনো এত ভক্তিভরে স্মরণ করেন?
এমন অল্প কথায় সব বলা সম্ভব নয়। খুব সংক্ষেপে বলতে গেলে শুরু করতে হয় উইকিপিডিয়ার ভাষায়, ‘তিনি ছিলেন কাঠামো প্রকৌশলের আইনস্টাইন।’ অথবা ইলিনয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক এবং ‘আর্ট অব দ্য স্কাইস্ক্র্যাপার, দ্য জিনিয়াস অব ফজলুর খান’ বইটির লেখক মীর এম আলীর মতো, ‘আমাদের সময়ের শ্রেষ্ঠতম প্রকৌশলীদের একজন’ বলে। ‘কাঠামো প্রকৌশল শুধু বিজ্ঞান নয়, শিল্পও’—এই প্রবাদবাক্যের প্রবর্তক প্রিন্সটনের অধ্যাপক ডেভিড বিলিংটন। এ প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে তিনি বলেছেন, খানের প্রকৌশলকর্ম আমার এই প্রবাদবাক্যের জন্য সবচেয়ে বড় উদাহরণ। ‘বিলিংটন এই সূত্র ধরে আরও বলেছেন, ‘এই শিল্পের মন্ত্র হচ্ছে, নিয়মনিষ্ঠ দক্ষতা, যা দিয়ে কম উপাদান ব্যবহার করে, স্বল্পব্যয়ে, দৃষ্টিনন্দন, ছিমছাম একটি ভবন বানানো যায়; আর এফ আর খানের সব গগনচুম্বী অট্টালিকায় তা আমরা সহজেই দেখতে পারি।’
ফজলুর রহমান খান নামটা মার্কিনদের জন্য উচ্চারণ করা বেশ কঠিন ছিল। তাঁর সহকর্মী ও ঘনিষ্ঠজনেরা তাঁকে ফাজ নামে ডাকতেন। স্কিডমোর ওয়িংস অ্যান্ড মেরিল (এসওএম) নামে যে ফার্মের সঙ্গে তিনি ১৯৫৫ সাল থেকে শুরু করে তাঁর মৃত্যুকাল পর্যন্ত কর্মজীবন কাটিয়েছেন, সেখানে খুব নামডাকওয়ালা অনেক স্থপতিরা কাজ করতেন। স্থপতি ও স্ট্রাকচারাল ইঞ্জিনিয়ারদের মধ্যে আবার একধরনের পেশাগত রেষারেষি রয়েছে। একজন স্থপতির শৈল্পিক পরিকল্পনা আর কাঠামো প্রকৌশলীদের বিজ্ঞানভিত্তিক অশৈল্পিক দৃষ্টিভঙ্গি নাকি পরস্পরবিরোধী। সেখান থেকেই এই রেষারেষির উৎপত্তি। এই পেশায় যাঁরা আছেন, তাঁরা ব্যাপারটা অস্বীকার করতে পারবেন না। কিন্তু ফাজ খানের ব্যাপারে তাঁর সহকর্মীরা কেউই সেটা মানতে চান না। কেন তা পরে বলছি; তার আগে বলি তিনি স্কাইস্ক্র্যাপার ডিজাইনে বৈপ্লবিক কী পরিবর্তন এনেছিলেন। যতটা সম্ভব আমার মতো করে বলছি। একটি ভবন যখন আকাশচুম্বী হয়ে ওঠে, তখন তার কাঠামোর ওপরে পাশ থেকে একটা চাপ আসে। উচ্চতা যত বাড়তে থাকে, মূলত বাতাস কিংবা ভূমিকম্পভিত্তিক এই চাপও তত বাড়তে থাকে। প্রকৌশলের ভাষায় একে বলে ল্যাটেরাল লোড। এই চাপ সহ্য করার জন্য সুউচ্চ ভবন তৈরিতে, ভিত্তি থেকে শুরু করে কলাম এবং বিমের আয়তন প্রচলিত জ্ঞানে প্রকাণ্ড করার দরকার হতো। এতে করে যে শুধু ভবন তৈরির উপাদানের অসাশ্রয় হতো তা নয়, ভবনের চেহারাতেও এর প্রকাশ্য একটা প্রকোপ পড়ত। এফ আর খান ‘টিউবুলার কনসেপ্ট’ নামে একটি মৌলিক প্রকৌশলতত্ত্ব স্কাইস্ক্র্যাপার ডিজাইনে নিয়ে আসেন। টিউবুলার কনসেপ্ট ব্যাপারটা বেশ খটমটে একটা বিষয়, সহজ করে বোঝানোটা আমার সাধ্যের বাইরে। অল্পস্বল্প যা বুঝি তাই বলছি, এর বেশি জানতে চাইলে গুগলের সাহায্য নেওয়ার অনুরোধ করব। ভবনের অঙ্গে যে ল্যাটারেল লোড আসে, সেটা সইবার জন্য খান একটি ফাঁপা সিলিন্ডারের মতো কাঠামো প্রস্তাব করেন। যে কাঠামোর মূল ভর থাকবে মাটির নিচে, ওপরের অংশ ভূমির সমান্তরালে ক্যান্টিলেভার হয়ে বেড়ে উঠবে। খুব ঘন ঘন করে বসানো কলাম এবং স্প্যান্ড্রেল বিমের সংযোগে গড়া হবে সেই সিলিন্ডারের দেয়াল। এই দেয়াল একদম নিশ্ছিদ্র না হওয়াতে অবকাঠামো তুলনামূলকভাবে হালকা থেকে যাবে, শুধু তা–ই নয়, ভেতরের অন্যান্য কাঠামোর ওজনের অনেকটাও সেই বাইরের অবকাঠামোর ওপরে চাপিয়ে দেওয়া যাবে। খানের এই টিউবুলার কনসেপ্ট ব্যবহার করে ১৯৬৮ সালে শিকাগো শহরে গড়ে ওঠে ১০০তলা ভবন, জন হ্যানকক সেন্টার। এর কিছুদিন পর তৈরি হয় সিয়ারস টাওয়ার, যা ১৯৭৩ সাল থেকে শুরু করে দীর্ঘ ২৫ বছর যাবৎ পৃথিবীর সবচেয়ে উঁচু বিল্ডিং হিসেবে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে ছিল। তার সরাসরি সম্পৃক্ততায় সেটাই ছিল সর্বোচ্চ ভবন। কিন্তু তিনি আমাদের মাঝে আজ যদিও নেই, তবু সারা পৃথিবীতে স্কাইস্ক্র্যাপার ডিজাইনে এখন পর্যন্ত তাঁর বিকল্প খুঁজে পাওয়া যায়নি। মালয়েশিয়ার পেট্রোনাস টাওয়ারই হোক আর দুবাইয়ের বুর্জ আল খালিফাই হোক, প্রকৌশলীরা তাঁর কনসেপ্ট ধরেই আজও ডিজাইন করে চলেছেন। স্কাইস্ক্র্যাপার ডিজাইনই যে শুধু তাঁর নাম জড়িয়ে আছে তা কিন্তু নয়। এত এত বিশিষ্ট স্থাপনায় তাঁর নাম জড়িয়ে আছে যে এর সবটা লেখা সম্ভব নয়। জেদ্দা এয়ারপোর্টের হজ টার্মিনাল অনেকের পরিচিত, তাই তাঁর কাজের আরেকটি উদাহরণ হিসেবে এখানে উল্লেখ করতে চাইছি।
লেখাপড়ার সূত্রে তিনি যদিও একজন প্রকৌশলী, কিন্তু এসওএমে তাঁর সহকর্মীদের ভাষ্যমতে, ফাজ হচ্ছেন স্থপতি এবং প্রকৌশলী—দুটিই। দুই পেশার মাঝে তিনি ছিলেন এক অবিচ্ছেদ্য যোগসূত্র। তাঁর কাঠামো পরিকল্পনা স্থাপত্যশৈলীর সুস্পষ্ট দিকনির্দেশনা করে। তাই তাঁকে স্থপতি হিসেবে দলে টানতে এসওএমর বাইরের স্থপতিরাও কখনো আপত্তি করেন না।
এফ আর খানের জীবনী বলতে এই লেখা নয়। তাঁর জন্মদিনে একটি কথা বারবার মনে হচ্ছে বলে এই লেখা; অন্যরা দিলেও বাংলাদেশ কি তাঁকে তাঁর যোগ্য সম্মান দিয়েছে? ১৯৭১ সালে আমাদের স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় তিনি সিয়ারস টাওয়ার ডিজাইন করছিলেন। সেই সময় বারবার কাজ ফেলে রেখে আমেরিকার এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে ছুটে বেড়িয়েছেন স্বাধীনতার সপক্ষে জনসমর্থন গড়ে তোলার জন্য। ১৯৯৯ সালে তাঁকে স্বাধীনতা পদক দেওয়া হয়েছে, আর একই বছর ডাক বিভাগ তাঁর নামে চার টাকা দামের একটি ডাকটিকিট বের করেছিল। ব্যস, ওই পর্যন্তই। যাকে ছাড়া বাঙালির ইতিহাস অপূর্ণ রয়ে যাবে, এই প্রজন্ম কি তাঁকে চেনে? পরের প্রজন্মের কথা থাক।
অথচ, তাঁর অবলম্বিত দেশ আমেরিকা কিন্তু তাঁর প্রতিভার মর্যাদা দিতে পিছপা হয়নি। জীবদ্দশায় এবং তাঁর মৃত্যুর পরেও তাঁকে অজস্র প্রাতিষ্ঠানিক সম্মাননা দেওয়া হয়েছে। তাঁর নামে বিশ্ববিদ্যালয়ে সম্মানসূচক চেয়ার করা হয়েছে। ২০০৯ সালে মিসরে এক বক্তৃতায় তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা যে সব আমেরিকান মুসলমান নাগরিক এ দেশের সভ্যতাকে সমৃদ্ধ করেছেন, তাঁদের মাঝে এফ আর খানও একজন বলে উল্লেখ করেছেন। শিকাগো শহরে তাঁর নামে একটি রাস্তার নামকরণ পর্যন্ত করা হয়েছে; আর আমরা?