বালক রাজার হাতে হোয়াইট হাউস

নিউজউইকের প্রচ্ছদে এভাবে তুলে ধরা হয়েছে ‘অলস বালক’ ট্রাম্পকে
নিউজউইকের প্রচ্ছদে এভাবে তুলে ধরা হয়েছে ‘অলস বালক’ ট্রাম্পকে

এ যেন ‘শ্রীমান পৃথ্বীরাজ’-এর কল্পরাজ্য, যেখানে বালক রাজার রাজত্বে জাতীয় সংগীত হচ্ছে ‘হরিদাসের বুলবুল ভাজা/ টাটকা তাজা, খেতে মজা...’। যেখানে পৃথ্বীরাজ নামের বালক রাজা তাঁর স্বপ্নে দিন কাটায় হেসেখেলে। রাজদরবার ভর্তি মোসাহেবে। আর সংকট উপস্থিত হলেই আদেশ দেয় ‘গর্দান নেওয়ার’। সফল বাঙালি চলচ্চিত্র নির্মাতা তরুণ মজুমদার এ দৃশ্যকে বাস্তব হিসেবে উপস্থিত করেননি। এটি এক বালকের স্বপ্নদৃশ্য শুধু।

কিন্তু এ দৃশ্যই এখন বাস্তব হয়ে উঠেছে হোয়াইট হাউসে। বালক রাজার মতোই খামখেয়ালিভাবে দেশ পরিচালনা করছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। পৃথ্বীরাজের মতোই যেকোনো সংকটের মুখে তিনি হাজির করছেন অভ্রান্ত দাওয়াই, ‘ইউ আর ফায়ারড।’ তিনি যেন এখনো তাঁর সেই জনপ্রিয় টিভি শো ‘দ্য অ্যাপ্রেনটিস’ সঞ্চালনা করছেন।
পৃথ্বীরাজের মতোই তিনি খেলায় মগ্ন। সাবেক প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার গলফ খেলার তীব্র সমালোচক ট্রাম্প নিজেই অভিষেকের দুই সপ্তাহের মধ্যে গলফ ক্লাব অভিমুখী হয়েছেন। অথচ অভিষেকের পর প্রথম পাঁচ মাস গলফ খেলা থেকে দূরে ছিলেন সাবেক প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশ। আর বারাক ওবামার ক্ষেত্রে এ ব্যবধান ছিল চার মাসের।
নিউইয়র্ক টাইমসের তথ্যমতে, অভিষেকের পর প্রথম ছয় মাসে তিনি ৪০ বারের বেশি গলফ ক্লাবে গেছেন। আর এ জন্য ব্যয় হয়েছে মার্কিন করদাতাদের ৫৫ মিলিয়ন ডলার। এখানেই শেষ নয়। প্রথম ছয় মাসেই দক্ষিণ ফ্লোরিডা, মার-এ-ল্যাগো কিংবা নিউজার্সির নিজস্ব ক্লাবে তিনি ৫৬ বার গিয়েছেন, যা তাঁর প্রেসিডেন্ট কার্যালয়ে উপস্থিতির প্রায় এক-তৃতীয়াংশ।
বারাক ওবামার গলফ খেলাকে ‘কর্তব্যে গুরুতর অবহেলা’ হিসেবে দেখলেও নিজের অতি গলফপ্রীতিকে তিনি ‘কর্তব্য’ই জ্ঞান করছেন। সর্বশেষ গত বছর প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে রিপাবলিকান মনোনয়ন পাওয়ার পর তিনি টুইটার পোস্টে লেখেন, ‘আমেরিকা যখন অধঃপাতে যাচ্ছে, ওবামা তখন দায়িত্ব এড়াতে গলফ খেলছেন।’ একই সঙ্গে ‘প্রেসিডেন্ট হলে মানুষের জন্য কাজ করার বদলে গলফ খেলার সময়’ তাঁর হবে না বলেও জানান তিনি।
২০১৬ সালের প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী ট্রাম্প এখন হোয়াইট হাউসে। এটাই বাস্তবতা। আর সঙ্গে এ–ও বাস্তব যে এক বছরের ব্যবধানে তাঁর প্রতিশ্রুতি উবে গেছে কর্পূরের মতো। ট্রাম্প-ঘনিষ্ঠরা অবশ্য বলছেন, ‘গলফ প্রেসিডেন্টের ভালো থাকার জন্যই প্রয়োজন। যাই করুন, তিনি সব সময় কাজেই থাকেন।’
তবে অন্য অনেক বিশ্লেষকই এ অতি গলফপ্রীতিকে দেখছেন ‘প্রেসিডেন্সি নিয়ে ট্রাম্পের অবসাদের’ প্রমাণ হিসেবে। এমএসনবিসির সঞ্চালক লরেন্স ও’ডোনেলতো ট্রাম্পকে ‘মার্কিন ইতিহাসের সবচেয়ে অলস ও উদাস’ প্রেসিডেন্ট হিসেবে আখ্যা দিয়েছেন। এ ক্ষেত্রে তিনি বিভিন্ন আইন প্রণয়ন ও সংশোধনে কংগ্রেসের তৎপরতার বিষয়ে ট্রাম্পের সুস্পষ্ট ঔদাসীন্যকে যুক্তি হিসেবে হাজির করেন। এমনকি জনসম্পৃক্ততার ক্ষেত্রেও তিনি ব্যাপকভাবে উদাসীন। এখন পর্যন্ত ট্রাম্প মাত্র একটি একক সংবাদ সম্মেলন করেছেন।
গুরুত্বপূর্ণ বিদেশ সফর, সংবাদ সম্মেলন কিংবা ওবামাকেয়ার বাতিলের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে দেশের অভ্যন্তরে প্রচারণা চালানোর সময় না থাকলেও তিনি প্রথম ছয় মাসে ১ হাজার ২৯টি টুইট করার সময় ঠিকই পেয়েছেন। এসব টুইটও হতে পারত তাঁর প্রশাসনের নীতি প্রচারের অস্ত্র। কিন্তু তার বদলে, তাঁর টুইটার পোস্টজুড়ে রয়েছে সাবেক প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা ও প্রতিদ্বন্দ্বী হিলারি ক্লিনটনের সমালোচনা। রয়েছে নিজ প্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণ পদধারীদের তীব্র সমালোচনাও, যার সর্বশেষ শিকার অ্যাটর্নি জেনারেল জেফ সেশনস। আর ‘ভুয়া’ সংবাদমাধ্যমের সমালোচনা তো রয়েছেই। আর আছে যেকোনো সংকটেই সেই শ্রীমান পৃথ্বীরাজের মতোই ‘গর্দান নেওয়ার’ মতো বরখাস্তের আদেশ দেওয়ার প্রবণতা। এরই মধ্যে উল্লেখযোগ্যসংখ্যক কর্মকর্তার হোয়াইট হাউস ত্যাগই এর প্রমাণ। দিনে পাঁচ ঘণ্টা টেলিভিশন দেখা এই মার্কিন প্রেসিডেন্ট এমনকি হোয়াইট হাউসের তিন শতাধিক পদের বিপরীতে কোনো মনোনয়নও দেননি।
নিজের বিরুদ্ধে আলসেমির অভিযোগ ওঠার আশঙ্কা ট্রাম্পের ঠিকই আছে। এ জন্যই গত ১২ মে এক টুইটার পোস্টে নিজেকে ‘একজন সক্রিয় প্রেসিডেন্ট’ হিসেবে বর্ণনা করতে দেখা যায় তাঁকে। যদিও প্রেসিডেন্টের জনসমক্ষে প্রকাশিত কর্মসূচিগুলো বিশ্লেষণ করে ওয়াশিংটন পোস্টের এক প্রতিবেদনে একে ‘অত্যন্ত হালকা’ বলে উল্লেখ করা হয়েছে। একই সঙ্গে এর ব্যাখ্যা হিসেবে সংবাদমাধ্যমটি বলছে, ‘হয় তিনি অনেক কিছু গোপন রাখছেন, নয়তো তিনি তেমন কিছুই করছেন না।’
এরই মধ্যে হতাশার বাণীও শোনা গেছে ট্রাম্পের কণ্ঠে। গত এপ্রিলে তিনি প্রকাশ্যেই বলেছেন, ‘আগের জীবনটিকেই আমি ভালোবাসি। এখন অনেক বেশি কাজ করতে হচ্ছে আমাকে। অথচ আমি একে (প্রেসিডেন্সিকে) সহজ ভেবেছিলাম।’ তার রয়েছে বিস্তর অজুহাতও। তিনি বলেছেন, ‘স্বাস্থ্য সুরক্ষা আইন এতটা জটিল হবে, তা কেউ ভাবতে পারেনি।’ কিন্তু সত্য হচ্ছে, তিনি ছাড়া সবাই এটা জানত। আর এ কারণেই ওবামা তাঁর অ্যাফোর্ডেবল কেয়ার অ্যাক্টকে আমেরিকানদের সামনে তুলে ধরতে কয়েক মাস সময় ব্যয় করেছিলেন।
বাস্তবতা থেকে পলায়ন নয় বরং ঘনঘন পলায়নই ট্রাম্পের বড় বৈশিষ্ট্য। তার চেয়েও বড় বিষয় হচ্ছে এসব কিছুকে তিনি কিছুই মনে করছেন না। গত মে মাসে ট্রাম্পের জীবনী লেখক টিমোথি ও’ব্রায়ান নিউইয়র্ক টাইমসকে বলেন, ‘কোনো কিছুকেই তিনি গ্রাহ্য করেন না। আর তিনি হাড়েমজ্জায় অলস। তিনি না জেনেই অনেক কিছু করেন। আগে তিনি এটা ব্যবসাক্ষেত্রে করেছেন, এখন করছেন রাজনীতির মাঠে।’
প্রশ্ন হচ্ছে, ট্রাম্প কি কোনো কাজই করেননি। হ্যাঁ করেছেন। এখন পর্যন্ত তিনি মোট ৪২টি আদেশে সই করেছেন। এসব আদেশের মধ্যে খুব অল্পসংখ্যকই গুরুত্বপূর্ণ। পরিবর্তনের স্বপ্ন দেখানো ট্রাম্প তিমির কথা বলে চুনোপুঁটি মারছেন। আর দাবি করছেন এভাবেই তিনি আমেরিকাকে আবারও ‘গ্রেট’ বানাবেন। যেন তিনি এখনো নির্বাচনী প্রচারণা চালাচ্ছেন। এ ক্ষেত্রে যে বিষয়গুলোকে তিনি নিজের কৃতিত্ব হিসেবে বর্ণনা করছেন, তা–ও অর্জন হয়েছে ওবামা প্রশাসনের সময়েই। মহামন্দার সময় দায়িত্ব নিয়ে বেকারত্বের হার ৭ দশমিক ৮ শতাংশ থেকে ৪ দশমিক ৭ শতাংশে নামিয়ে এনেছেন বারাক ওবামাই। এমনকি যে অবৈধ অভিবাসী নিয়ে ট্রাম্প এত সোচ্চার, সেখানেও মূল কাজটি করে গেছেন ওবামাই। আর এসবকেই বালকসুলভভাবে নিজের কৃতিত্ব হিসেবে জাহির করছেন ট্রাম্প।
ট্রাম্প নিজেও তাঁর এ বালক চেতনার কথা জানেন। দ্য ট্রুথ অ্যাবাউট ট্রাম্প বইয়ের লেখক মাইকেল ডি’আন্তোনিওকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে ট্রাম্প নিজেই বলেছিলেন, ‘প্রথম শ্রেণিতে পড়ার সময় আমি নিজেকে যেমন দেখেছি, এখনো ঠিক সে রকম। একটুও বদল হয়নি। ধাত ও মেজাজে কোনো ভিন্নতা নেই।’ মাইকেলের মতে, ‘এটি কখনোই একটি মহান গণতান্ত্রিক দেশের নেতার মানসিকতা হতে পারে না। বরং এক বালক রাজার মানসিকতার সঙ্গেই এটি বেশি সাযুজ্যপূর্ণ।’