ট্রাম্পের বক্তব্য 'অ-প্রেসিডেন্টসুলভ'

ডোনাল্ড ট্রাম্প
ডোনাল্ড ট্রাম্প

‘বিভিন্ন পক্ষের অনুসারীদের মধ্যে ঘৃণা, সংকীর্ণতা ও সহিংসতার যে প্রদর্শন হলো, জোরালো ভাষায় আমি তার নিন্দা জানাচ্ছি। সব পক্ষ এর জন্য দায়ী। এটা আমাদের দেশে বহু বছর ধরে চলে আসছে। শুধু ডোনাল্ড ট্রাম্প বা বারাক ওবামার আমলে নয়, এটি অনেক অনেক বছর ধরে চলে আসছে।’ ভার্জিনিয়া অঙ্গরাজ্যের চার্লটেসভিলে শ্বেতাঙ্গ উগ্রপন্থীদের সঙ্গে উদারপন্থীদের সংঘর্ষের ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে দেওয়া এক বিবৃতিতে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এসব কথা বলেন।

আমেরিকায় শ্বেতাঙ্গ উগ্রবাদীরা যখন জাতিগত ঘৃণা উসকে দিয়ে দাঙ্গা পরিস্থিতি তৈরি করছে, তখন এর চেয়ে অপ্রেসিডেন্টসুলভ বক্তব্য আর কিছুই হতে পারে না। নিউজার্সির বেডমিনিস্টার থেকে দেওয়া ট্রাম্পের বক্তব্যের সবচেয়ে আপত্তিকর অংশটি হচ্ছে, চার্লটেসভিলের ঘটনায় তিনি উভয় পক্ষকেই ঘৃণা পোষণের জন্য দোষারোপ করেছেন। সংক্ষিপ্ত বিবৃতিতে তিনি ‘সব পক্ষের’ দায়ের বিষয়টি দুবার উল্লেখ করেন, যা ভীষণভাবে আপত্তিকর।
চার্লটেসভিলের ঘটনায় উভয় পক্ষ থেকে জাতিগত ঘৃণা উৎসারিত হয়নি। বর্ণবাদী ও অসহিষ্ণু স্লোগান উভয় পক্ষ থেকে আসেনি। একটি সুনির্দিষ্ট পক্ষ যুদ্ধংদেহী ভঙ্গিতে এ ধরনের স্লোগান দিয়েছে। আর অন্য পক্ষটির অবস্থান ছিল কোনো নির্দিষ্ট গোষ্ঠীর শ্রেষ্ঠত্বের ধারণার বিরুদ্ধে। তার বর্ণবাদী কোনো ধারণার জন্ম দেয়নি, বরং এর বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছে। আর দিন শেষে এ উদারপন্থী পক্ষটি বিপরীত পক্ষের কাউকে আহত না করেই মাঠ ছেড়েছে। এর বিপরীতে শ্বেতাঙ্গ উগ্রবাদীদের হামলা শিকার হতে হয়েছে এই গোষ্ঠীকেই। সে ক্ষেত্রে সহিংসতার দায় কীভাবে উভয় পক্ষের ওপর বর্তায়, এ প্রশ্ন অত্যন্ত যৌক্তিক।
সহিংসতার দায় ‘উভয় পক্ষের’ এমন বক্তব্য দিয়ে ট্রাম্প আদতে ‘ডানপন্থীদের ঐক্যের’ ডাক দেওয়া শ্বেতাঙ্গ উগ্রবাদীদের ভিত্তিভূমিতে থাকা ঘৃণা ও অসহিষ্ণুতাকে ঢাকার প্রয়াস পেয়েছেন। অথচ সত্য হচ্ছে, ১২ আগস্ট জড়ো হওয়া শ্বেতাঙ্গ উগ্রবাদীদের হৃদয় ছিল ঘৃণা ও অসহনশীলতায় পরিপূর্ণ। তাদের এ জমায়েত কোনোভাবেই প্রতিবাদ ছিল না, যা ঘটনাচক্রে সহিংস হয়ে উঠেছিল। বরং একেবারে অন্তর্গতভাবেই সহিংসতার উদ্দেশ্য নিয়েই তারা জড়ো হয়েছিল। এ ধরনের গোষ্ঠীকে আদর্শিক বা রাজনৈতিক-যেকোনোভাবেই পুনর্বাসন বা আশ্রয় দেওয়াটা পুরো জাতির জন্যই ক্ষতিকর। আর এ ক্ষতিকর কাজটিই সংক্ষিপ্ত বক্তব্যের মধ্য দিয়ে করেছেন স্বয়ং প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প।
উদ্ভূত পরিস্থিতি ‘রক্ষণশীল ও উদারনৈতিকদের বিতর্কের’ তথাকথিত অবস্থায় নেই। এটি একটি সহিংস পরিস্থিতি, যার দায় একটিমাত্র পক্ষের। আর এর বিপরীতে পক্ষ নির্বিশেষে সবার দাঁড়ানোটা কর্তব্য। এ ক্ষেত্রে দেশের প্রেসিডেন্ট হিসেবে পথ দেখানোর দায়টি পড়ে ডোনাল্ড ট্রাম্পের ওপরই। কিন্তু ‘অপ্রিয় সত্য’ খোলাখুলি উচ্চারণের প্রতিশ্রুতি দেওয়া ট্রাম্প পথ দেখানো দূরের কথা, সে পথ মাড়ানইনি।
ট্রাম্পের এ অবস্থানের সমালোচনা করছেন খোদ রিপাবলিকানরাই। কলোরাডোর রিপাবলিকান সিনেটর কোরি গার্ডেনার নিজের টুইটার পোস্টে লিখেছেন, ‘মিস্টার প্রেসিডেন্ট, শয়তানকে আমাদের নাম ধরেই ডাকা উচিত।’ একইভাবে ফ্লোরিডার রিপাবলিকান সিনেটর মার্কো রুবিও টুইটারে লিখেছেন, ‘এরা ছিল শ্বেতাঙ্গ উগ্রবাদী। আর এটি ছিল অভ্যন্তরীণ সন্ত্রাস।’ কিন্তু এর বিপরীতে ট্রাম্প কী করছেন? বুঝে বা না বুঝেই তিনি চার্লটেসভিলে জড়ো হওয়া উগ্রবাদীদের পক্ষে সাফাই গাইছেন। শুধু তাই নয়, নিজের দায় এড়াতে তিনি সাবেক প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামাকেও টেনে এনেছেন। এমনকি এখানেও থামেননি তিনি। তিনি বলেছেন, এ ধরনের বিষয় বহু বছর ধরে চলে আসছে। তিনি বলতে চাইছেন, ‘দোষ আমার নয়।’ নিজের ‘হেইট স্পিচের’ দিক থেকে চোখ ফেরাতে তিনি পুরো মার্কিন সংস্কৃতিকেই কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে দিলেন। তিনি বলতে চাইছেন, একই ধরনের ‘ঘৃণার প্রচার’ বারাক ওবামাও করেছিলেন।
অন্য অপ্রেসিডেন্টসুলভ মুহূর্তগুলোর মতোই ট্রাম্প এখানে অনাকাঙ্ক্ষিত আচরণ করেছেন। শুরু থেকেই তিনি এমন সব বিষয়ে কথা বলেছেন, যখন তাঁর নীরব থাকাটাই ছিল শ্রেয়। একইভাবে ১২ আগস্ট শ্বেতাঙ্গ উগ্রবাদীরা রণসাজে পথে নেমে এলে তাঁর কঠোর সতর্কতা দেওয়ার কথা থাকলেও তিনি ছিলেন নীরব। আর যখন বললেন, ভুল বললেন। ওবামা প্রশাসনের পুরো মেয়াদজুড়ে যে ট্রাম্প ‘উগ্র ইসলামি সন্ত্রাসবাদের’ নাম উচ্চারণ না করায় ওবামা ও হিলারি ক্লিনটনের বাক্‌সংযমের তীব্র সমালোচনা করেছেন, সেই তিনিই নিজ দেশের মধ্যে ঘটে যাওয়া হতাহতের ঘটনার মূল হোতাদের নাম উচ্চারণ করতে ভুলে গেলেন। তিনি ঐক্যের ডাক দিয়েছেন, সহিংসতার বিপরীতে কথা বলেছেন। আর উভয় পক্ষের ঘাড়ে দায় চাপিয়ে উৎসাহ দিয়েছেন অসহনশীলতাকেই। এমনকি ঘটনাস্থলে হেলিকপ্টার দুর্ঘটনায় নিহত দুই কর্মকর্তার মৃত্যুতে শোক জানালেও তিনি শ্বেতাঙ্গ উগ্রবাদের প্রতিবাদ করতে গিয়ে নিহত নারীর জন্য কোনো সমবেদনা জানাতে ভুলে গেছেন।

ক্রিস সিল্লিৎসা, সম্পাদক, সিএনএন