ভালোবাসার শহর আমাকে টানে, খুউব...

খাওয়াদাওয়ার ব্যাপারে আমি একটু সেকেলে। একটু না, মহা সেকেলে। গ্রাম্য টাইপ বলা যায়। আমার মেয়ে অরিত্রি অনেকটা আমার মতো। কিন্তু আমার ছেলে অর্ক এবং জেসমিন আবার আমাদের দুজনের চেয়ে ভিন্ন। জেসমিন ঢাকার মেয়ে বলে মাংস–বিরিয়ানি বেশি পছন্দ। তাই আমাদের মেনু ভিন্ন ভিন্ন হয়। অর্ক খুবই ভোজনরসিক। এখন অর্ক নিজের বাসায় থাকে বলে জেসমিনের কাজ অনেক কমে গেছে। খাবার টেবিলে অর্ককে মিস করি আমরা। একটু পরপর ফ্রিজ খোলার আর কেউ নেই। টরন্টোর তাবৎ রেস্টুরেন্ট অর্কর চেনা। মনে আছে, অর্ক তখন স্কলাস্টিকায় পড়ে। স্কুল থেকে আসার সময় প্রায় প্রতিদিন বলত, বাবা আমাকে ক্যান্ডিফ্লসে নিয়ে যাও। আমি নিয়ে যেতাম। গুলশান–১-এ এই নামে একটা ফাস্ট ফুডের দোকান ছিল। খুব চলত দোকানটা। সেখানে বার্গার, আইসক্রিম ইত্যাদি পাওয়া যেতো। স্কুল ছুটির পর লাইন লেগে যেত। এখনো এই নামে কোনো দোকান আছে কি না জানি না।

আমি যখন স্কুলে পড়তাম, টিফিন পিরিয়ডে দেখতাম, অনেকেই মালেক ভাইয়ের মালাই আইসক্রিম খাচ্ছে। আমার কাছে প্রায়ই পয়সা থাকত না বলে খেতে পারতাম না। অন্যেরা খাচ্ছে, আমি মুগ্ধ হয়ে দেখি। কোনো বন্ধু অফার করলে সেটাও গ্রহণ করতে চাইতাম না। বলতাম, ‘নারে আমার টনসিলের সমস্যা আছে। মা বলছে ঠান্ডা না খেতে।’ সেই থেকে আইসক্রিম আমার প্রিয় আজও। কানাডা দেশটায় এত এত আইসক্রিম পাওয়া যায় যে মাথা খারাপ হওয়ার জোগাড়। মনে হয়, সব আইসক্রিম খেয়ে ফেলি। অর্কর বাইরের খাবার খুব পছন্দ। রেস্টুরেন্ট গিয়ে খাবার অর্ডার করা একটা আর্ট। সঠিক কম্বিনেশন সবাই করতে পারে না। যেমন আমি রেস্টুরেন্টে খাবার অর্ডার দেওয়ার পর দেখা গেল অদ্ভুত কিছু হয়েছে। নিজের অর্ডার দেওয়া খাবার নিজেই খেতে পারছি না। আমি কি দিনে দিনে আরও বোকা হয়ে যাচ্ছি! অর্ক খুব ভালো বোঝে কোনটার সঙ্গে কোনটা যাবে, কতটুকু খাবার অর্ডার করলে অপচয় হবে না।
আমার সব সময় মনে হয়, ইশ্‌, খাবার বোধ হয় কম পড়ে যাবে। বাজারে গেলে উল্টো পাল্টা জিনিস কিনি। সঠিক পরিমাপ বুঝতে পারি না। ছোটবেলায় আমাকে কখনো বাজারে পাঠানো হতো না। ভাই বাজার করত, আমি চটের ব্যাগ নিয়ে পেছন পেছন ঘুরতাম। দেখতাম কীভাবে দরদাম করতে হয়। এক শ টাকার কই মাছকে কীভাবে ষাট টাকায় নামিয়ে আনতে হয়। দরদাম করায় আমি খুবই লাজুক। মনে হয়, লোকটা কী ভাববে আমাকে! খেতে বসলে মনে হয়, টেবিলে যে খাবার আছে তাতে আমার হবে তো! একটা ভয় থাকে। আমার ডায়াবেটিস আছে বলে জেসমিন খুব কড়া খাওয়া দাওয়ার ব্যাপারে। মনে মনে বলি তুমি আমাকে এত কষ্ট দাও কেন খাবার নিয়ে! যখন একা থাকি মাইক্রোওভেনে খাবার গরম করার সময় মনে মনে বলি এত কমে হবে আমার! কিন্তু খেতে বসে দেখি পারছি না তো শেষ করতে! একটুতেই পেট ভরে যাচ্ছে! জেসমিন বলে কতটুকু খেলে পেট ভরবে তাও বলে দিতে হবে! ছোটবেলায় মনে হয় খাওনি ঠিকমতো। আমি বলি ঠিক বলছ। তখন তো জানতাম না কোনো খাবারে কত পুষ্টি। তখন তো ক্যালরি হিসাব করে খাওয়ার রেওয়াজ চালু হয়নি! ক্যালসিয়ামের সঙ্গে যে ভিটামিন ডি খেতে হয়, সেটা কে জানত! ওর ধারণা, আমি খাবার অপচয় করি। টেবিলে আমার অনেক খাবার দেখতে ভালো লাগে এটা ঠিক। মা বলত, আমার নাকি চোখের খিদে। কথাটা সত্যি।

আমি যে শহরটায় থাকি সেটা, একটা অসাধারণ শহর। মনেই হয় না যে বিদেশ। সব ধরনের খাবারই এখানে পাওয়া যায়। আমি যে খাওয়াদাওয়ায় সেকেলে রয়ে গেছি সেটার জন্য টরন্টো শহর খানিকটা দায়ী। ছোটবেলায় দেখেছি মা কত–কী নিজ হাতে লাগাতেন। শিম, ধুন্দুল, লাউ, পুঁইশাক, বরবটি, ডাঁটা শাক, বেগুন, মুলা, কাঁকরোল, আরও কত–কী। খেতের থেকে আনা পাটশাক রান্না করতেন। এসবের কোনো কিছুরই অভাব নাই টরন্টোতে। পটোলও পাওয়া যায়। সব ধরনের মাছ আসছে দেশ থেকে। কানাডার নিজস্ব মাছও অতি সুস্বাদু। কানাডিয়ান বিফ, ল্যাম্ব বা চিকেন অতি উন্নত মানের। সব বড় বড় স্টোরে হালাল সেকশন আছে। সামারে অনেকেই তাদের বাড়িতে শাক সবজি করেন। কোনো আত্মীয়র বাড়িতে দাওয়াত থাকলে আমার জন্য ভাত, ডাল, সবজি আর মাছ থাকবেই। সফেদা, পাপায়া আর লিচু আমার খুব প্রিয় ফল। ছোটবেলায় দেখতাম চকবাজারে ফলের দোকানে আঙুর ঝুলে আছে। আপেল বা আনার সাজানো আছে থরে থরে। মাছিরা খাচ্ছে কিন্তু আমি তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছি। নিতান্ত অসুস্থ না হলে ওসব ফল জুটত না। আর এখন দেখি ঘরে আঙুর, আপেল, পিচ, আনার, কলা গড়াগড়ি খায়। এগুলো অতি সুস্বাদু এবং দামেও সস্তা।
কানাডায় বারো মাস ফল পাওয়া যায়। এখানে এত ধরনের দুধ পাওয়া যায় যে চমৎকার সব মিষ্টির আইটেম নিজেরাই ঘরে করে অনেকে। দই, রসগোল্লা, কালোজাম, পায়েস, সন্দেশ। এ ছাড়া মিষ্টির দোকানও আছে অনেক।

ঝাল টাইপ পিঠা আমার প্রিয়। একদিন জেসমিনকে বললাম, আমার জন্য ছিটা পিঠা বানাও। বাড়িতে গেলেই মা বলতেন জসিমেরে ছিডাপিডা বানাইয়া দে। চালের পিঠা মাংসের ঝোল দিয়ে খেতে কতই না স্বাদের। আহা জিবে পানি এসে যাচ্ছে। জেসমিন মাঝে মাঝে ইকবাল ফুড থেকে চালের গুঁড়ো এনে ছিটা পিঠা বানায় আমার জন্য। তবে ছিটা পিঠা বানাতে গিয়ে কিচেন সয়লাব করে ফেলে! এমনকি চাপটি খেতে ইচ্ছে করলেও বানিয়ে দেয়। চিতই পিঠা তো হরহামেশাই চলছে। আগেই বলে রাখি কেউ যদি আমাকে পিঠা খাওয়ার দাওয়াত দেন মিষ্টি পিঠা বানাবেন না। হা হা হা। জোক করলাম। বাংলাদেশে থেকেও সবই আসছে এখানে। হাজার মাইল দূরত্ব আর কোনো বাধা নয়। টোস্ট বিস্কুট থেকে শুরু করে মসলা পর্যন্ত। আমিতো সকালে নিজের হাতে চা বানাই তারপর বাংলাদেশি ব্র্যান্ডের টোস্ট দিয়ে ভিজিয়ে ভিজিয়ে খাই। টোস্ট না হলে মুড়িতো আছেই। জেসমিন বলে মুড়ি আর টোস্ট তোমার একমাত্র খাদ্য। আর শুধু কি বাংলাদেশের খাবার! যে দেশের খাবার খেতে মন চায় হাতের কাছেই আছে সব। কি চাইনিজ, কি ম্যাক্সিকান, কি ইন্ডিয়া, কি আফগান, কি পাকিস্তান, কি লেবানিজ। পিৎজা হচ্ছে অন্যতম প্রধান খাদ্য এখানকার মানুষের। শুক্রবার আর শনিবার রাতে রেস্টুরেন্টে জায়গা পাওয়া কঠিন। কানাডায় একমাত্র ডেজিগনেটেড এলসিবিও এবং বিয়ার স্টোর ছাড়া অ্যালকোহল বিক্রি হয় না। ১৯ বছরের নিচের কারও কাছে সিগারেট বিক্রি করা যায় না। ধূমপানকে খুবই নিরুৎসাহিত করা হয় উন্নত বিশ্বে। এখনকার তরুণেরা ধূমপানের বিপক্ষে। মেয়েরা বেশি ধূমপায়ী।

আগেই বলেছি খাবারদাবারে আমি গ্রাম্য টাইপ। কিছুই খেতে মন না চাইলে অন্তত ভাতের সঙ্গে ডিম ভাজা, আলুভর্তা আর যদি ঘন ডাল হয়, তাতেই সই! পৃথিবীতে কত ধরনের চাল আছে, তা এখানে না এলে জানতাম না। আমি ব্রাউন চালের ভাত খাই। যদিও অতি বিস্বাদ খেতে। তাও অভ্যাস করে নিয়েছি। শুঁটকি জিনিসটা আমরা বরিশালের মানুষেরা খেতে জানতাম না। কিন্তু ঢাকার মেয়ে বিয়ে করার পর শুঁটকি খাওয়া শিখেছি। প্রচুর ঝালসহকারে লইট্ট্যা শুঁটকি অতি সুস্বাদু। আর করলা হচ্ছে ইবাদতের মতো। ডাল আমার প্রিয়। ডালের সঙ্গে যদি শজনে ডাঁটা থাকে, তাহলে অতি চমৎকার। শজনে পাওয়া খুব সহজ। ভর্তা জিনিসটা কে আবিষ্কার করেছে কে জানে। আলু ভর্তা ছাড়াও বেগুন ভর্তা, শিম ভর্তা, বরবটি ভর্তা বা টাকি মাছের ভর্তা আহা জীবন কত সুন্দর...। সকালে আটার রুটির সঙ্গে টাটকা সবজি বা তেল ছাড়া একখানা পরোটা, সঙ্গে একটা ডিম পোচ, ওমেগা থ্রি এবং সঙ্গে অর্গানিক কলা। সবশেষে জম্পেশ এক কাপ চা! সকালটা স্বর্গীয় হয়ে উঠতে বাধা নাই কোনো। ডায়াবেটিস বলে অনেক কিছুই বর্জন করেছি। রাতে বেশির ভাগ খাই ওটমিল না হয় সিরিয়াল এক পার্সেন্ট দুধ সহকারে বা কখনো হোল গ্রেইন ব্রেড এক স্লাইস।

বিনোদনের জন্য টরন্টো শহরের তুলনা নাই। ছুটির দিনে কিছু না কিছু থাকবেই। বাংলাদেশি কমিউনিটি যেমন তেমনি অন্যান্যদেরও নানা কিছু থাকে। টরন্টোতে বাঙালি কমিউনিটি বড় হচ্ছে ক্রমশ। অনেক প্রতিভাবান এই শহরকে মুখরিত করছেন। নতুন প্রজন্ম অবিশ্বাস্য ভালো করছে। ওদের জন্য আমি গর্ব করি। ওরা কানাডার মেইন স্ট্রিমে নিজেদের দক্ষতা দেখাচ্ছে। এখানে বাংলা টেলিভিশন চ্যানেল আছে, সংবাদপত্র আছে, অনলাইন পত্রিকা আছে, গানের, নাচের, কবিতার, নাটকের, আবৃত্তির স্কুল আছে। কোচিং সেন্টার আছে, ল ফার্ম আছে, মানি এক্সচেঞ্জ আছে, ট্রাভেল এজেন্সি আছে, বাড়ি কেনা বেচার এজেন্ট আছে। সাংস্কৃতিক সংগঠন আছে, উদীচী আছে, ছায়ানট আছে। সুরকার আছে, মিউজিশিয়ান আছে, নাট্যাভিনেতা আছে, সিনেমা মেকার আছে। গুরুগম্ভীর আলোচনা অনুষ্ঠান হচ্ছে নিয়মিত, বইমেলা হচ্ছে প্রতিবছর, একুশ উদ্‌যাপন হচ্ছে, বিজয় দিবস হচ্ছে, স্বাধীনতা দিবস হচ্ছে, পিকনিক হচ্ছে, ক্রুজ হচ্ছে। রাস্তায় প্রতিবাদ হচ্ছে যেকোনো অন্যায়ের। পুজো হচ্ছে ঘটা করে, ঈদের নামাজ হচ্ছে। সবাই সবার বাড়িতে যাচ্ছে। কি হচ্ছে না এখানে! সবই হচ্ছে। আবার ঝগড়া বিবাদ হচ্ছে, কমিটি পাল্টা কমিটি হচ্ছে। সমিতি আছে, রাজনৈতিক দল আছে, গ্রুপিং পাল্টা গ্রুপিং আছে, হিংসা আছে, অন্যের সম্মানহানির চেষ্টা আছে, সাধু আছে, শয়তানও আছে, কেউ একটা ভালো কাজ করছে সেটা নষ্ট করার চেষ্টা আছে, পরচর্চা আছে। পরচর্চা একটা বড় বিনোদন এখানে। সবকিছু মিলিয়ে জীবন অনেক বৈচিত্র্যময়।

বিয়েশাদি হচ্ছে ঘটা করে, ঢাকার চেয়েও সুন্দর আয়োজন হচ্ছে বিয়েতে। আবার বিয়ে ভাঙছে অহরহ, প্রেম হচ্ছে, পরকীয়া হচ্ছে। নিজের দেশকে মিস করার সুযোগ তেমন নাই। আইপি টিভি বা যাদু বক্সের মাধ্যমে শত শত টিভি চ্যানেল দেখা যায়। বিভিন্ন ভাষার চ্যানেল। সেখানে বাংলাদেশের ক্রিকেট খেলা দেখা যায়। ঢাকার সবগুলো টিভি চ্যানেল আছে। পত্রিকা পড়া যায়। গানের সিডির দোকান আছে, বইয়ের দোকান আছে, বাঙালি রেস্টুরেন্ট আছে, গ্রোসারি আছে, পিঠার দোকান আছে। স্টেডিয়ামে গিয়ে খেলা দেখা যায় আমেরিকান সকার বা হকি। বড় বড় শিল্পীদের কনসার্ট হচ্ছে নিয়মিত। কখনো এ আর রহমান, কখনো শ্রেয়া ঘোষাল, কখনো সাবিনা ইয়াসমিন, কখনো হৈমন্তী শুক্লা কখনো বা জাস্টিন বিভার ..। কখনো শাহর খান, কখনো সালমান খানরা আসছেন। প্রতিবছর টরন্টো ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল হচ্ছে, হলিউড স্টারদের পদচারণায় মুখর হচ্ছে টরন্টো। ফোবানা হচ্ছে, আরও বড় বড় অনুষ্ঠান হচ্ছে ফি বছর। ঢাকার সিনেমা চলছে এখানকার থিয়েটারে।

টরন্টো আমার নিজের শহর। ভালোবাসার শহর। এই শহরে পা দিলেই একটা নিরাপদ ফিলিংস হয় আমার। কত বড় বড় শহর ঘুরেছি। নিউইয়র্ক, লস অ্যাঞ্জেলেস, লন্ডন, টোকিও, কলকাতা, ব্যাংকক, কুয়ালালামপুর, প্যারিস, রোম, মাদ্রিদ কিন্তু টরন্টোর মতো দেখিনি কোনো শহর। ট্রান্সপোর্ট ব্যবস্থা এত ভালো যে এক প্রান্ত থেকে আর এক প্রান্তে যাওয়া খুবই সহজ। যে কেউ রাত বিরেতে একা একা মনের সুখে ঘুরতে পারে। কোনো ভয় নেই। এই শহরের প্রেমে পরবে যে কেউ..। কিন্তু সবকিছুর ওপর হচ্ছে বরিশাল শহর। যে শহরে আমি জন্মেছি। বরিশালের বাড়ির সেই পথ–ঘাট, পুকুর, খেলার মাঠ, মুসলিম কবরস্থান যেখানে মা, সাজু আর মৌরি ঘুমিয়ে আছে, বাবার কবর, দরগাবাড়ির মসজিদ যেখানে আমি জুম্মার নামাজ পড়তাম, সদর রোড, লঞ্চঘাট শশী মিষ্টান্ন ভান্ডার, বুক ভিলা, পাবলিক লাইব্রেরি, বিএম কলেজ, নুরিয়া হাইস্কুল, হাতেম আলী কলেজ, বাংলাবাজার, মেডিকেল কলেজ ক্যাম্পাস, কীর্তনখোলা নদীর তীর, কত ফেলে আসা স্মৃতি, স্কুল কলেজের বন্ধু, আত্মীয়–পরিজন সবকিছু আমাকে টানে, খুব টানে...।