বৃষ্টিভেজা ক্ষণে হেলালের 'ঝলমলিয়া' প্রদর্শিত

ঝলমলিয়া ছবি দেখছেন দর্শক ও অতিথিরা
ঝলমলিয়া ছবি দেখছেন দর্শক ও অতিথিরা

সেদিন ৫ নভেম্বর রোববার। ঘড়ির কাঁটায় সময় এক ঘণ্টা পিছিয়েছে। দিনভর বৃষ্টি। মন্ট্রিয়েলের তীব্র শীত কনকন করে গায়ে লাগছে। তারওপর সেদিন মন্ট্রিয়েলে মিউনিসিপ্যাল নির্বাচনের দিন।
মন্ট্রিয়েল বায়োস্কোপের আয়োজকদের টেনশন বাড়ছিল বৃষ্টির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে। কনকর্ডিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের জন মলসন বিজনেস স্কুল অডিটোরিয়ামে ঢুকতেই অন্যরকম আবহে মন ভালো হয়ে গেল। চমৎকার এ মিলনায়তনটি প্রায় পরিপূর্ণ।
মন্ট্রিয়েল বায়োস্কোপ হলো মন্ট্রিয়েল শহরে প্রথমবারের মতো কোনো ফিল্ম সোসাইটি বা চলচ্চিত্র সংসদ। এদিন সেটিরই শুভ উদ্বোধন করা হলো। গুণী চলচ্চিত্রকার সাইফুল ওয়াদুদ হেলাল ও তাঁর টিম ‘ঝলমলিয়া’ রাজধানী অটোয়া থেকে এসেছে। ঘড়ির কাটায় ঠিক ৫:৩০ মিনিটে আয়োজকেরা দাঁড়িয়ে গেলেন মঞ্চে। এই বিষয়টা উল্লেখ না করলেই নয় যে প্রবাসে আমাদের সব অনুষ্ঠানই বিলম্বে শুরু হয়। মন্ট্রিয়েল বায়োস্কোপ ঠিক সময়ে অনুষ্ঠান শুরু করে আমাদের সামনে দৃষ্টান্ত
স্থাপন করল।
আয়োজকদের পক্ষ থেকে আবু হোসেন জয় সবাইকে শুভেচ্ছা জানিয়ে অনুষ্ঠান শুরু করলেন। কনকর্ডিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের স্টুডেন্টস অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি শ্রীনিবাস শুভেচ্ছা জানালেন। দক্ষিণ ভারতীয় শ্রীনিবাস কয়েক লাইন বাংলা বলে সবার মন জোগালেন। তারপর বাংলাদেশ গ্র্যাজুয়েট স্টুডেন্টস অ্যাসোসিয়েশন, কনকর্ডিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে প্রাক্তন সভাপতি রাফি মোহাম্মদ আজাদ ও বর্তমান সভাপতি রিজওয়ানুল হক আলভিন শুভেচ্ছা জানালেন। বায়োস্কোপের পক্ষ থেকে অপরাহ্ণ সুসমিতো চলচ্চিত্রকার সাইফুল ওয়াদুদ হেলালকে ডেকে নিলেন মঞ্চে। প্রামাণ্য চলচ্চিত্র ঝলমলিয়া নিয়ে ছোট্ট ও সারগর্ভ বক্তব্যের পরই শুরু হলো বড় পর্দায় ঝলমলিয়ার প্রদর্শনী।

ঝলমলিয়া চলচ্চিত্রের পোস্টার
ঝলমলিয়া চলচ্চিত্রের পোস্টার

৫৪ মিনিট দৈর্ঘ্যের ডকু ফিল্ম এই ঝলমলিয়া। বৃষ্টিভেজা বিকেলে বিপুলসংখ্যক প্রবাসীর উপস্থিতি এবং ঝলমলিয়া ডকুমেন্টারি একটি অনবদ্য সৃষ্টি বলে দর্শকদের অভিমত জানিয়ে দিল এটা কোনো বানানো কল্পকাহিনীভিত্তিক বিস্ফোরণ কিংবা অ্যাটাকের সিনেমা নয়, এটা আসলেই প্রকৃতি জল ও জীবনের কাদামাখা বায়োস্কোপ।
ঝলমলিয়া নিয়ে লিখেছিলেন দেশের খ্যাতিমান চলচ্চিত্র গবেষক ও লেখক চলচ্চিত্র সংসদ আন্দোলন কর্মী ও সংগঠক মাহমুদুল হোসেন। অথচ ঝলমলিয়া এক প্রামাণ্যগল্প, প্রাচ্য জাদুর রসে ডোবানো উৎকৃষ্ট এক কাহিনি, যা এলোমেলো করে দেয় প্রামাণ্য সব প্রকল্প, এজেন্ডা, ইস্যু ও টার্গেট। কিন্তু এসব সার্থকতা কি সে চায়নি? বলব, সম্ভাব্য আপত্তির মুখে, সে উৎকর্ষ তার অর্জিত হয়নি। ঝলমলিয়া প্রামাণ্যকরণ করে ঠিকই, কিন্তু সেটি ঘটে এক শরণার্থী বোধের, সংবেদের। যে ঠিকানা নেই, যে মাটির শুধু কিংবদন্তি আছে, যে অস্তিত্ব নাগরিক বিচ্ছিন্নতায় ট্র্যাজিক, যেসব মানবিক স্বাদু স্বপ্ন নির্মমভাবে দলিত ঝলমলিয়া তাদের অনুসন্ধান, ক্রমাগত বেহিসাবি বিবেচনা; এক অলৌকিক অমর্ত্যের আকাঙ্ক্ষা।’
ঝলমলিয়া প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, লেখক শিশির ভট্টাচার্য্য তাঁর লেখার একটি অংশে লিখেছেন, ২০১৬ সালে হেলাল শেষবার হুড়কা গ্রামে এসেছিল রাস উৎসবে। ঝলমলিয়া দিঘির পাশেই এক মন্দিরে অনুষ্ঠিত হয় এ উৎসব। নারী-পুরুষ রাধা-কৃষ্ণ সেজে ঘুরে ঘুরে নাচে নাম-সংকীর্তন করতে করতে। একটি দৃশ্যে দেখা যায়, রাসপূর্ণিমার সন্ধ্যায় নারীভক্তরা ঝলমলিয়ায় পুণ্যস্নান করছে। লাল শাপলা হাতে সিক্তবসনা এক নারী যখন ঝলমলিয়ার ডুব দিয়ে উঠতে থাকে তখন ক্যামেরা তার মুখের ওপর স্থির হয়। আমরা অবাক হয়ে দেখি, মুখটি সাফিয়ার। ব্যাকগ্রাউন্ডের আকাশে তখন জ্বলজ্বল করছে রাসপূর্ণিমার চাঁদ।
কণ্ঠশিল্পী কবি মণিকা মুনার কলমে ‘আমি গ্রামে বড় হয়েছি এমন বাংলাদেশ দেখেই এবং সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ক্রমাগত বিভ্রান্ত হয়েছি সেই সরল, অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের অস্তিত্ব বিলোপের প্রচারণায়। পরিচালক সাইফুল ওয়াদুদ হেলালকে আমায় ধন্যবাদ জানাতেই হবে আমার স্মৃতির বাংলাদেশ যে বিলুপ্ত হয়নি সেই বিশ্বাস তাঁর ডকুমেন্টারি ফিল্ম ঝলমলিয়ার মাধ্যমে ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য।’