প্রবাসে দেশের সাহিত্যের স্বচ্ছ আয়না

বিএলআরসির সাহিত্য পত্রিকা নতুন সংখ্যার প্রচ্ছদ
বিএলআরসির সাহিত্য পত্রিকা নতুন সংখ্যার প্রচ্ছদ

‘সাহিত্য পত্রিকা’ মানে মনের কোণের একটি অতি ভালো লাগার বিষয় আমার জন্য। এই ভালো লাগার শুরুটা হয়েছিল খুব ছোট্টবেলা। তাই সাহিত্য পত্রিকা দেখলেই গোগ্রাসে গিলে ফেলতে ইচ্ছে করে নিমেষে। বলছিলাম বিএলআরসি সাহিত্য পত্রিকার অক্টোবর ২০১৭ সংখ্যা নিয়ে। প্রতি বছর টরন্টোতে অনুষ্ঠিত হয় বাংলাভাষী লেখকবৃন্দের সম্মেলন। এ সম্মেলনের পাশাপাশি সাহিত্য পত্রিকাটির নতুন সংখ্যার প্রকাশ একটি বিশেষ সংযোজন। দ্বিতীয়বারের মতো এবারও সাহিত্য সম্মেলনের পাশাপাশি প্রকাশিত হলো বেঙ্গলি লিটারারি রিসোর্স সেন্টার (বিএলআরসি) ’র সাহিত্য পত্রিকাটি। ১৩৮ পৃষ্ঠার এ সাহিত্য পত্রিকায় কানাডার টরন্টো এবং টরন্টোর বাইরের বিপুলসংখ্যক লেখকের লেখা ছাপা হয়েছে।
সাহিত্য পত্রিকার উন্নত মান বলতে যা বোঝায় তার কোনো অংশে কমতি নেই এই সংখ্যায়। গতবারের মতোই চমৎকার বর্ণিল প্রচ্ছদে অলংকৃত এ সাহিত্য পত্রিকাটি হাতে নিলেই মন ভরে যাবে এটি নিশ্চিত। নির্ভুল বানানে এবং সাহিত্যের বিভিন্ন শাখার সৃজনশীল লেখনী সমৃদ্ধ এ পত্রিকাটি এক নিশ্বাসে পড়ার মতো বলে আমার বিশ্বাস। ছাপার মান খুবই উন্নত এ কথা আর বলবার অপেক্ষা রাখে না।
শুরুতে সম্পাদকীয় লেখা হয়েছে বাংলা এবং ইংরেজি উভয় ভাষায়। এ ছাড়া এতে রয়েছে ইংরেজি ও বাংলায় রচিত প্রবন্ধ-নিবন্ধ, গল্প, কবিতা, স্মৃতিকথা এবং প্রতিবেদন। কয়েকটি ছড়া ছড়িয়ে থাকলে ছন্দে ছন্দে ডুবে যাওয়া যেতো হয়তো। পরবর্তী সংখ্যায় হয়তো কিছু ছড়া স্থান পাবে এ অভাবটুকু পূরণ করার নিমিত্তে।
এবারের সংখ্যায় ইংরেজি লেখাগুলো প্রথমেই উপস্থাপিত হয়েছে। অবশ্য দু’একটি ইংরেজি লেখা পরবর্তী কালে বাংলা লেখাগুলোর পাশাপাশি জায়গা করে নিয়েছে। গতবারের সংখ্যায় ইংরেজি লেখাগুলো ছিল শেষের দিকে। নাতিদীর্ঘ ইংরেজি বাংলা উভয় ভাষায় প্রবন্ধগুলো উপস্থাপিত হয়েছে খুব সুনিপুণভাবে। প্রবন্ধগুলোর মধ্যে বাঙালি লেখক, বাংলা ভাষা, বাঙালি সমাজ, রাজনীতি, রবীন্দ্রনাথ, বাঙালি সংস্কৃতির প্রয়োজনীয়তা, মাতৃভাষা, প্রেম, মহাবিশ্ব, প্রাচীন সাহিত্য কথন ইত্যাদি স্বল্প পরিসরে উঠে এসেছে।
নিরঞ্জন রায় আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার আসামি সম্প্রতি প্রয়াত মাহফুজুল বারীর সাহিত্যচর্চার ওপর স্মৃতিচারণমূলক একটি লেখা লিখেছেন। নানা আঙ্গিকে তুলে ধরেছেন বারীর পরিচিতি এবং সাহিত্যের প্রতি তাঁর একনিষ্ঠতা। নিরঞ্জন রায় মিশেছেন মুক্তিযোদ্ধা বারীর সঙ্গে গভীর সখ্যে। সে কারণেই তাঁর কথায় উঠে এসেছে নানা অজানা তথ্য। এ ছাড়া আরও বেশ কিছু প্রবন্ধ এতে ঠাঁই পেয়েছে যেগুলো পড়লেই বোঝা যাবে অতি যত্নে লেখা হয়েছে এ প্রবন্ধগুলো। মনজুর মাহমুদ লিখেছেন ‘টরন্টোর দু’চাকার রিকশা’ নিয়ে। তার মতে খুব শিগগিরই রিকশার জনপ্রিয়তা অনেক বেশি বেড়ে যাবে টরন্টোতে। ‘রবীন্দ্রনাথ ও ইয়েটস: পরিপূরক বন্ধুত্ব’ হলো ড. দিলীপ চক্রবর্তীর গবেষণালব্ধ উপস্থাপনা। ড. অরুণ ভৌমিক জাপানের চমৎকার দৃশ্য ফুটিয়ে তুলেছেন তাঁর ‘সাকুরার দেশে’ প্রবন্ধে।
বেশ ক’টি ছোটগল্প স্থান পেয়েছে এ সাহিত্য পত্রিকায়। সুদক্ষ লেখক, সমালোচক, উপস্থাপক এবং আবৃত্তিকার হাসান মাহমুদের ‘হারানো খেলাঘরে’ দিয়ে শুরু হয়েছে ছোটোগল্পের পশরা। সর্বমোট ১৫টি ছোটগল্প বর্তমান সংখ্যায় উপস্থাপিত হয়েছে। প্রতিটি গল্পের রয়েছে ভিন্ন ভিন্ন প্রেক্ষাপট। নীরব প্রেমের একটি চমৎকার চিঠির উপহার মিলেছে অসীম ভৌমিকের সুনিপুণ লেখায়। চিঠিটা শুরু করা হয়েছে রবি ঠাকুরের একটি আবেগী লাইন দিয়ে—‘তুমি রবে নীরবে হৃদয়ে মম, তুমি রবে নীরবে।’ আরও কিছু চমৎকার ছোটগল্প ছড়িয়ে আছে এ সংখ্যায়। তার মধ্যে যুথিকা বড়ুয়া’র ‘আগুনের পরশমণি’, শান্তা নিরুপমা’র ‘ঢেঁকিদের স্বর্গ যাত্রা আর যথারীতি ধান ভানা’, হেলাল মহিউদ্দীনের ‘ঘোর সকালে অমাবস্যায় শুভ্রা মনিকা’ ইত্যাদি বিশেষভাবে উল্লেখ্য। সবশেষে আছে মুস্তাফা দুলারী’র ছোটগল্প ‘রাক্ষস’, যেখানে গল্পকার বাংলাদেশের এক অসৎ আমলার প্রতিবিম্ব তুলে ধরেছেন। আশা করছি, এ সাহিত্য পত্রিকার ক্ষুদ্র পরিসরের গল্পের আয়োজন পাঠকদের মনে দাগ ফেলবে।
বর্তমান সংখ্যায় বিএলআরসি-র গত বছরের কর্মকাণ্ডের ওপর রয়েছে বেশ কয়েকটি প্রতিবেদন। অখিল সাহা তাঁর প্রতিবেদনে ২০১৬ সালের প্রথম সাহিত্য সম্মেলনকে উদ্দেশ্য করে স্লোগান তুলেছেন, ‘আমরা চাই লেখকেরা সমাজে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করুন’। আরও কিছু প্রতিবেদন সংযোজিত হয়েছে, যেমন, ‘প্রবাসে একটি প্রয়োজনীয় কর্মশালা’ এবং ‘ভিন্ন আঙ্গিকে মাতৃভাষা দিবস উদ্‌যাপন’ ইত্যাদি। এটি অতি আশার বিষয় যে, সাহিত্য চর্চার পাশাপাশি বিএলআরসি কিছু কর্মশালা আয়োজনের কাজও হাতে তুলে নিয়েছে ইতিমধ্যে।
বিএলআরসি’র সাহিত্য পত্রিকার উদ্বোধনী সংখ্যা নিয়েও পর্যালোচনা প্রকাশ করা হয়েছে। এতে যাঁরা পূর্ববর্তী সংখ্যাটি হাতে পাননি বা পড়ার সুযোগ পাননি তারা কিছুটা হলেও ধারণা লাভ করতে পারবেন। ফারজানা নাজ শম্পা খুব স্বল্প কথায় বিএলআরসি সম্পর্কে ধারণা দিয়েছেন তার ‘বিএলআরসি: কানাডায় বাংলা সাহিত্যের নতুন সোপান’ লেখাটিতে।
তরুণদের সাহিত্য-চর্চা বিষয়টিও বাদ যায়নি এ সংখ্যায়। তাসনিমা খান তুলে ধরেছেন তার অনবদ্য লেখায় ‘টরন্টোতে তরুণদের জন্য সাহিত্য উদ্যোগ’। তরুণেরা আমাদের ভবিষ্যৎ, যাদের মানুষ করে গড়ে তোলবার আপ্রাণ চেষ্টায় আমরা মত্ত। সুতরাং, তরুণেরা হোক আগামী দিনের সু-সাহিত্য চর্চার ধারক এবং বাহক। লেখকের মতে: ‘...আজকের সন্তানেরা বাস্তবতার সাগরে ভাসতে ভাসতে আজ তীরহারা।’ আমাদের প্রচেষ্টা সেই সাগরে ভাসা সন্তানদের সাহিত্য-চর্চার মাধ্যমে মনের খোরাক জোগাড় করার রাস্তা দেখিয়ে দেওয়া।
সবশেষে, কয়েকটি পাতা জুড়ে রয়েছে কবিতা এবং কবিতাগুচ্ছ, যা কবিদের মনে খোরাক মেটাবে বলে বিশ্বাস। অধিকাংশ কবিতাই আধুনিক ছাঁচে ফেলে উপস্থাপিত হয়েছে।
সার্বিক বিবেচনায় এ সাহিত্য পত্রিকাটি সাহিত্য ক্ষুধিত জনের ক্ষুধা মেটানোর জন্য একটি বিশেষ অবলম্বন বটে! পূর্ববর্তী অনুষ্ঠানের দুই-চারটি রঙিন ছবি ছাপালে হয়তো ভালো হতো। কিছু পাতায় বিজ্ঞাপন জুড়ে দেওয়া থাকলেও এটি ছন্দের ব্যাঘাত ঘটিয়েছে বলে মনে হয়নি, বরং বলা যেতে পারে অন্যান্য পত্রিকা ও ম্যাগাজিনের তুলনায় স্বল্প কিছু বিজ্ঞাপনের ঠাঁই হয়েছে এখানে।
প্রচ্ছদ অলংকরণে সুনিপুণ দায়িত্ব পালন করেছেন বরাবরের মতো মোস্তাফিজ কারিগর। তবে প্রচ্ছদের রংটি বদলানো সম্ভব হলে ভালো হতো। আশা করছি পরবর্তী সংখ্যার বেলায় এটি বিবেচনায় আনা হবে। প্রধান সম্পাদকের দায়িত্বভার পালন করেছেন সুব্রত কুমার দাস। নির্বাহী সম্পাদক হিসেবে ছিলেন সুজিত কুসুম পাল। যারা সম্পাদকীয় পর্ষদে ছিলেন তারা হচ্ছেন: শিউলী জাহান, শেখর গোমেজ, চয়ন দাস, মো. ফায়েজুল করিম, সুরজিৎ রায় মজুমদার, কাজী জহির উদ্দিন এবং মাহমুদ হাসান। এরা প্রত্যেকেই স্ব স্ব ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত এবং শত ব্যস্ততার মধ্যেও দায়িত্ব পালনে এতটুকু অবহেলা করেননি। এর বাইরেও অনেকেই সাহায্যের হাত বাড়িয়েছেন পত্রিকার কাজ নির্দিষ্ট সময়ে শেষ করার জন্য। যার ফলে আমরা আজ এমন একটি সমৃদ্ধ সাহিত্য পত্রিকা সময়মতো হাতে পেয়েছি। এ পত্রিকায় শুভেচ্ছা বাণী দিয়ে সমৃদ্ধ করেছেন কানাডার কেন্দ্রীয় সরকারের হেরিটেজ মন্ত্রী মেলানি জলি। তাঁকে বিশেষ কৃতজ্ঞতা এমন একটি মহতী উদ্যোগকে উৎসাহিত করার জন্য।
সবশেষে, সম্পাদকের সম্পাদকীয় পাতা থেকে উদ্ধৃত করছি: ‘...কলমের কাহিনি এগিয়ে যাবে অনন্তকাল’। এ সাহিত্য পত্রিকাও এগিয়ে যাবে অনন্তকাল সবার আন্তরিক ভালোবাসায় আর টরন্টোতে আমাদের ডুবিয়ে রাখবে সাহিত্য সুধারসে। বই পড়ুন, বই উপহার দিন, লিখুন এবং সাহিত্য চর্চায় পৃষ্ঠপোষকতা করুন। ধন্যবাদ বিএলআরসি’র প্রতিটি কর্মনিষ্ঠজনকে তাদের নিরলস প্রচেষ্টার জন্য।