তমিজ উদ্দীন লোদীর কবিতা

অলংকরণ: মাসুক হেলাল
অলংকরণ: মাসুক হেলাল

অরন্তুদ বেদনার মাস্তুল

মানুষকে আলাদা করে দিয়েছে ধর্ম, মতবাদ আর পুঁজির প্রতাপ।
মানবিক ধর্ম থেকে বিচ্যুত মানুষেরা খুঁজে ফিরছে কণ্ঠনালি
নির্দ্বিধায় ছুরি চালাবে বলে খুঁজে ফিরছে ঘরবাড়ি, আগুন লাগাবে বলে
খুঁজে ফিরছে শত্রু রাষ্ট্র, বারুদ ঠাসবে বলে।

রোদের ভেতর থেকেও তুলে নিচ্ছে অন্ধকার
রক্তপায়ী ভ্যাম্পায়ারের মতো একদল মানুষ
নিয়ত রক্তপায়ী অরন্তুদ বেদনার মাস্তুল।

বোবা আর্তনাদে ফেটে পড়া মৃত্যুগন্ধী অর্থহীন অভিঘাত
বিদীর্ণ সময় ব্যাপী শুয়ে আছে হাহাকার
সমান্তরালে আধিপত্য ও সন্ত্রাস
পরে আছে ধর্ম-মুখোশ
আর মতবাদের হিংস্রতা, আক্রোশ।

গোলার্ধব্যাপী ত্রাসের খর নদী, পানির বদলে রক্তস্রোত যেন
মায়ানমার থেকে ইয়েমেন, কূটচাল, যুদ্ধের বাতাবরণ
মানুষ নেই কোথাও
শুধু পড়ে আছে ধর্ম, মতবাদ আর পুঁজির প্রতাপ।

পম্পেইয়ের মতো

বাগাড়ম্বরহীনতার ভেতর দিয়ে যাচ্ছে পুনর্নির্মিত মৃতের শরীর।
অ্যানাটমি না জানা ভাস্কর গড়ে তুলছেন তাকে।
বাইরে বাইসনের ভিড় আর উঁচু পোডিয়ামের ওপর ভিসুভিয়াসের গ্রাস।
প্রলম্বিত অনির্বাণ হোমের আগুন।

ক্যারাভান থেকে নেমে আসছে অচেনা কৌতূহল।
যেন আসহাবে কাহাফ। ঘোড়ার কেশর চেপে
কে-ও দৌড়চ্ছে অবিরাম, গ্ল্যাডিয়েটর নাকি সময়?

মাঠ কাঁপিয়ে হত্যার মহড়া। মৃত্যু যেন খেলা, ফিনকি-ওঠা
রক্তের অভিশাপ। অন্ধকার আর নৈঃশব্দ্যে ভেজা
মৃত কোনো নগরী যেন।
যেন দেবী ভেনাসের পদতলে মুণ্ডুর গড়াগড়ি।

তবু উদ্‌গিরণ ঢেকে দিল সব।
রক্ত, মুণ্ডু আর নৈবেদ্য ঢেকে গেল
গনগনে লাভা আর ছাইয়ের ভেতর।

জায়গাটি এখনো শূন্য

মেধাশূন্য করার হীন উদ্দেশ্য ছিল পরিকল্পিত
তারা ছিলেন আলোর বরপুত্র, বিবেক
জায়গাটি এখনো শূন্য
মেধার জায়গাটি যেন পূরণ হবার নয়।

ধামাধরা একদেশদর্শীরা হাঁটছে সদর্পে
সুযোগসন্ধানী বিড়ালেরা পা ফেলছে সন্তর্পণে
ভান আছে সর্বত্র
শুধু নেই, তারা নেই, যারা ছিলেন মেধাময়
আলোর বরপুত্র।

তারা হারিয়ে গেলেন আর চরম সত্য কিংবা অপ্রিয় সত্য
বলাও হারিয়ে গেল কেমন অমোঘ সত্যের মতো।

অলংকরণ: মাসুক হেলাল
অলংকরণ: মাসুক হেলাল

মৌনব্রত

দেয়ালে পিঠ ঠেকে নাই সম্ভবত
না হলে বৃষ্টি হতোই
নিদেনপক্ষে বজ্রের গর্জন, বিদ্যুৎচ্চমক
কিংবা বাষ্পের গন্ধটুকু পাওয়া যেতো
মেঘও কেমন, ঈশানে জমে উঠেই হাওয়া।

সব অনুমানই কেমন অসার আর মিথ্যে হয়ে যাচ্ছে
বিভ্রমের ভেতর একটি ক্যাঙারু কেবল
দু’পায়ে লাফাতে লাফাতে পার হচ্ছে উপত্যকা
আর সব কেবল হাঁসজারু, কেবল খচ্চরের অনুরূপ
ঘোড়া নেই কোনো।

সময়ের নাম এখন ঝিম। কেবল ঝিম মেরে থাকা।
পিঠে খামচি দিয়ে চলে যাচ্ছে শাখামৃগ
পেছনের পায়ে লাথি হাঁকছে প্রমত্ত গাধা
আর ল্যাংচাতে ল্যাংচাতে পার হয়ে যাচ্ছে তারা, ওরা।

এখন কেবল ঝিম মেরে থাকা, কেবল মৌনব্রত।

পাথরগুলো দেখে

আমাদের নদীপারে যে স্লাবগুলি ছিল, পাথরগুলো ছিল গায়ে গা লাগিয়ে
সেগুলো হঠাৎ কেমন আলগা হয়ে গেছে। দৃশ্যমান একটি ফাটল বিস্তৃত হচ্ছে ক্রমশ।

বিশেজ্ঞরা বলছেন ফাটলটি আরও বিস্তৃত হতে পারে
এবং ধসে যেতে পারে যে কোনো সময়।
আমাদের শঙ্কা এখন তুঙ্গস্পর্শী।
আমরা রোজ স্লাব আর পাথরগুলো দেখি।

আসন্ন ভাঙনের চিহ্ন দেখে, আলগা পাথরগুলো দেখে
আমরাও ক্রমশ বোধহীন পাথর হয়ে যাচ্ছি।

জেরুজালেম

নবী কিংবা রাজা সুলাইমানের তর্জনী থেকে
বেরিয়ে এসেছে যে নগর
কিংবা মুসা কি মুজেসের
ঈসা কি যিশু খ্রিষ্টের
যেখানে এসে মিশে গেছে ইহুদি, খ্রিষ্টান, মুসলিম
আহলে কিতাবের সকল অনুসারী।

সেখানে কে তুমি একদেশদর্শী, শানাচ্ছ কৃপাণ!
উদ্দেশ্যপ্রণোদিত জ্বালিয়ে দিতে চাচ্ছো লেলিহান আগুন।