তমিজ উদদীন লোদীর কবিতা

তমিজ উদ্দীন লোদী
তমিজ উদ্দীন লোদী

ভালো কোনো কবিতায় তিনি কী আশা করেন, সে-কথার জবাবে বুদ্ধদেব বসু লিখেছিলেন, কবিতায় থাকতে হবে ইন্দ্রিয়গ্রাহ্যতা, সান্দ্রতা, সেই আর্দ্র ও ঈষৎ অন্ধকার বাতাস, যা প্রাণের জীবাণুর পক্ষে অনুকূল। এখানে ‘সান্দ্রতা’ কথাটা আমার কাছে আগ্রহোদ্দীপক মনে হয়েছে। সান্দ্রতা আক্ষরিক অর্থে নিবিড়, তরল অথচ ঘন এমন কিছু। কবিতায় ইন্দ্রিয়গ্রাহ্যতা অর্জিত হয় চিত্রকল্পে যে-চিত্রকল্প স্মৃতিকে উসকে দেয়, দেহ ও মনকে নিকটতর করে। কিন্তু সান্দ্রতার কাজ ভিন্ন, কবিতাকে সে ঐন্দ্রজালিক বিস্ময়ের প্রতিবিম্ব হিসেবে স্থাপন করে। এই ঐন্দ্রজালিকতার কথা মনে করেই কার্ল স্যাণ্ডবার্গ কবিতাকে এক প্রতিধ্বনির সঙ্গে তুলনা করেছিলেন, যে-প্রতিধ্বনি ছায়াকে নৃত্যে আহ্বান করে। 

তমিজ উদদীন লোদীর কবিতা পড়তে গিয়ে আমি এই সান্দ্রতার খোঁজ করেছি। লোদী আশির দশক থেকে কবিতা লিখছেন, গত এক দশক আছেন যুক্তরাষ্ট্রে, যদিও তাঁর আসল বশ্যতা ফেলে আসা স্বদেশের প্রতি। ‘কবিতা হারিয়ে যায়, শুধু থাকে বিস্ময়’, এই রকম একটি সান্দ্র বাক্যে তিনি আমাদের ধরিয়ে দেন, কবিতার আসল কাজ মানবমনে বিস্ময়বোধকে জাগিয়ে রাখা। এই বিস্ময়বোধই আসলে কবিতা, কারণ যা শ্রুতিগ্রাহ্য ও দৃষ্টিগ্রাহ্য নয়, এমন প্রিয় স্মৃতিকে ধরে রাখে সে। কবিতা, তা এপিক অথবা লিরিকধর্মী, যাই হোক, তার কেন্দ্রে থাকে কাছের ও দূরের স্মৃতি। এই দুয়ের তফাৎ এই যে, এপিক কবিতায় ফুটে ওঠে কোনো দেশ বা গোত্রের সম্মিলিত স্মৃতি; কিন্তু লিরিক কবিতার স্মৃতি ব্যক্তিনির্ভর। কবি নিজেকে আধার হিসেবে ব্যবহার করে একটি ব্যক্তিগত মানচিত্র নির্মাণ করেন, যা মুখ্যত তাঁর যাপিত জীবনের প্রতীকী বিবরণ। পাঠককে তিনি সে-মানচিত্রে নজর দিতে আমন্ত্রণ জানান সম্ভবত এই বোধ থেকে যে, যতই নির্জন ও নিভৃত হোক এই স্মৃতিমন্থন, কবি আশা করেন, কেউ না কেউ তাতে নিজের অভিজ্ঞতার প্রতিফলন দেখতে সমর্থ হবে। যত নিবিড় এই অভিজ্ঞতার প্রকাশ, তত সে সান্দ্র। ইন্দ্রজালের বিস্ময় মোড়ক সত্ত্বেও পাঠক তাতে নিজের অভিজ্ঞতার প্রতিধ্বনি পান, দেখেন নৃত্যরত সে-প্রতিধ্বনির ছায়াকে।
তার কবিতাসমূহ মূলত তিনটি বিষয় ঘিরে আবর্তিত হয়: স্বপ্ন, বেদনা ও আক্ষেপ। এক অর্থে তারা একই বিষয়ের তিনটি দিক-সকল স্বপ্ন নির্মাণের পেছনেই তো রয়েছে বেদনা ও আক্ষেপ। কিন্তু মানবিক অভিজ্ঞতার স্বরসংগতি খোঁজা অর্থহীন। ফলে এই তিনটি বিষয় ভিন্ন-ভিন্নভাবে উদ্ধারে আমাদের আশ্রয় করতে হয় প্রতীকময়তার বিনির্মাণে, যার ভেতর দিয়ে প্রকাশিত হয় লেখকের এবং পাঠক হিসাবে আমাদের অন্তর্গত মানবিকতা।
তাঁর একটি কবিতা ‘মানুষের মুখ’-এর কথাই ধরা যাক। কবিতাটির উদ্বোধন এভাবে: ‘আমাকে মানুষের মুখ আঁকতে বলা হয়েছিল। কিন্তু আমি আঁকতে গিয়ে টের পাই পৃথিবীর অন্যতম কঠিন একটি কাজে/আমার অজান্তেই আমি হাত দিয়ে ফেলেছি।’ কারণ, ‘মুখ আঁকতে গিয়ে দেখি মুখের আড়ালে আরও আরও মুখ আছে’, এই অভিজ্ঞতা থেকে কবির উপসংহার, ‘মানুষের মুখ আঁকতে গিয়ে অবশেষে/আমি প্রতিবিম্ব ছাড়া আর কিছুই আঁকতে পারিনি।’
একই সঙ্গে বেদনা ও আক্ষেপের উচ্চারণ, কিন্তু তার পেছনে কাজ করে মানবিক মূল্যবোধের প্রতি আস্থা, তাকে উদ্ধারের অপেক্ষা। অন্যথায় কবি মানুষের মুখ আঁকার এ-দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নেবেন কেন? অনাবৃত বেদনার প্রকাশ সত্ত্বেও তাঁর এ-অপেক্ষা, তাকে আমরা স্বপ্ন বলে চিহ্নিত করতে পারি। আর স্বপ্ন, সে তো সর্বদাই ইতিবাচক। এই উদ্বোধনী কবিতা থেকেই আমরা তমিজ উদদীন লোদীর কবিতার ইতিবাচক ভাবনার সঙ্গে পরিচিত হই। তাঁর কবিতাসমূহে আমরা তিনটি বৈশিষ্ট্যের সঙ্গে পরিচিত হই: কবির ব্যক্তিগত কণ্ঠস্বর, শিল্পের আড়াল নির্মাণে কুশলতা ও কাব্যকণ্ঠের লাবণ্য। বিষয়টি ভেঙে দেখা যাক।
‘এলোমেলো’ ও ‘মৃত্যু এক হলুদ-লালচে পাতা’ এই নামের দুটি কবিতায় লোদী মৃত্যু-বিষয়ে ভিন্ন ভিন্ন অথচ অন্তর্গতভাবে অভিন্ন দুটি সলিলোকি নির্মাণ করেছেন। প্রথম কবিতায় ঋতু পরিবর্তনের প্রতীকে মৃত্যুকে অবলোকন করেন তিনি; দ্বিতীয় কবিতায় দিন ও রাত্রির প্রহরাগমনে খুঁজে পান মৃত্যুর অমোঘ পদধ্বনি।’ ‘কাঁধে এক নদী’ কবিতায় দেশত্যাগের সিদ্ধান্তে কবির মনে অজানা-অচেনা এক বাউল জেগে ওঠে। কিন্তু সেই দেশত্যাগ যখন বাস্তব হয়ে ওঠে ‘নিউইয়র্কে গ্রীষ্মকাল’ কবিতায়। কবি তখন কঠোর অথচ কোমল প্রকৃতির ভেতর নতুনকে আবিষ্কার করেন; বিশুষ্ক শাখা থেকে খুঁজে পান নতুন কুঁড়ি। অন্য কথায় একদিকে আক্ষেপ, অন্যদিকে অপেক্ষা। ‘রয়েছি সুদূর পথে’ কবিতায় এই প্রতীক্ষা পরিণত হয় সাগ্রহ আলিঙ্গনে, কারণ ‘জমে যাওয়া শরীরের ত্বকে’ও তিনি পান ‘শীতল হাত-জলকণার আনন্দ-আলোক।’
আশ্চর্য সব দৃশ্যচিত্র নির্মাণের ক্ষমতা রয়েছে লোদীর। পরিযায়ী পাখির ডানায় তিনি দেখেন ‘রোদের গন্ধ’, তার চঞ্চুতে পান ‘প্রকৃতির মতো অনুপ্রাস’। অবিরল তুষারপাতের পর তিনি দেখতে পান ‘দুগ্ধ সরোবরে’ লাফানো ‘জ্যোৎস্নার চিতা’। বেদনার ভাষা নির্মাণ করতে গিয়ে আবিষ্কার করেন ‘কফের মতো বসে থাকা কান্না’।
লোদীর কবিতার অন্য আরেকটি বৈশিষ্ট্য তাঁর রাজনৈতিক স্টেটমেন্ট। অতি নিম্নকণ্ঠে, যেন নিজেকে বলছেন, এমন স্বগত উচ্চারণে তিনি প্রবল কষাঘাতসম্পন্ন সাক্ষ্যভাষা দিয়ে যান তাঁর চারধারে ঘটে যাওয়া নষ্ট জীবনের। ‘অস্থির মানুষেরা গিলে ফেলতে চাচ্ছে সব’, এমন সিদ্ধান্তে আসতে তাঁর কোনো দ্বিধা হয় না, কারণ তিনি দেখেছেন ‘হাড়বজ্জাত মানুষেরা চিনে গেছে মই’। তিনি অপরিচিত নন পরিবর্তন ও বিপ্লবের সম্ভাবনার সঙ্গে, কিন্তু ‘স্পন্দমান অপচয়গুলো ভেসে যায় ছেঁড়া খড়ের মতো’ এও তাঁর অভিজ্ঞতার অন্তর্গত। যারা স্বপ্ন দেখাতে উৎসাহ দিয়েছিল, এখন তারাই ‘সত্য বলা মহাপাপ’ এই ব্রতে মুখে কুলুপ সেঁটে আছে।
কিন্তু অমানিশাই শেষ কথা নয়। মানুষের ইতিবাচক ভবিষ্যতে, তার বিজয়ে ও প্রেমে এক গভীর ও সংশয়হীন আস্থা থেকে কখনোই বিচ্যুত হন না কবি। তিনি জানেন, ‘মানুষ চাইলেই খুব উচ্চতায় যেতে পারে/অথচ সজ্ঞানে সে খাটো হয়ে থাকে।’ ‘অনন্তের মাঝখানে যারা দ্বিধাহীন দাঁড়াতেই পারে’, কবি তাদের উদ্দেশে বলেন, ‘ছায়াচ্ছন্ন আঁধারেও’ তোমরা তৈরি করে নিতে পারো, ‘প্রকৃতির দৃশ্যপট’। তিনি এই বিশ্বাসে অবিচল থাকেন যে, ‘মানুষেরা যায় তবু মানুষ ফুরায় না’। সে জন্য একমাত্র মানুষই পারবে ‘কাঁটাতার ছিঁড়েখুঁড়ে জ্যোৎস্নার ভেতরে চাঁদ নিয়ে আসতে।
কাব্যভাষায় সান্দ্রতা-তার নিবিড়, তরল অথচ ঘন অনুভূতি তমিজ উদদীন লোদী কতটা অর্জন করতে পেরেছেন, তা বিচারের নিক্তি আমার কাছে নেই, তবে এটুকু বলব তাঁর কবিতা পাঠের পর কবিতার সম্ভাবনা নিয়ে আমার আস্থা আরও দৃঢ় হয়েছে।

১ জানুয়ারি কবি ও কথাশিল্পী তমিজ উদ্দীন লোদীর জন্মদিন
আশির দশকে যাঁরা বাংলাদেশে কবি হিসেবে পরিচিতি পেতে শুরু করেছেন তমিজ উদ্দীন লোদী তাঁদের অন্যতম। সিলেট জেলার বিয়ানীবাজার উপজেলার মাথিউরা গ্রামে ১৯৫৯ সালের ১ জানুয়ারি তিনি জন্মগ্রহণ করেন। গল্প দিয়ে লেখালেখির যাত্রা শুরু হলেও আশির দশকে তিনি কবিতার প্রতি অধিক মনোযোগী হয়ে ওঠেন। তবে পরবর্তী কালে কবিতার পাশাপাশি বাংলাদেশের জাতীয় পত্র-পত্রিকায় গল্প ও উপন্যাসও লিখেছেন এই কবি ও কথাকার। আশির দশকেই বাংলাদেশের প্রথম শ্রেণির পত্রিকাগুলো ছাড়াও তাঁর লেখা প্রকাশিত হয়েছে ভারতের সাপ্তাহিক দেশ ও মাসিক চতুরঙ্গ-সহ নানা কাগজে।
দীর্ঘ দিন বাংলাদেশ রেলওয়েতে সংকেত ও টেলিযোগাযোগ প্রকৌশলী হিসাবে কাজ করে সম্প্রতি স্বেচ্ছা-অবসর নিয়েছেন তিনি। বর্তমানে আমেরিকায় প্রবাস জীবন যাপন করছেন এবং সাপ্তাহিক বাংলা পত্রিকার সাহিত্য সম্পাদক হিসাবে কর্মরত আছেন। তাঁর প্রকাশিত গ্রন্থগুলোর মধ্যে-কখনো নিঃসঙ্গ নই (কবিতা), এক কণা সাহসী আগুন (কবিতা), নানা রঙের প্যারাশূট (কবিতা), চাঁদভস্ম (কবিতা), আমাদের কোনো প্লাতেরো ছিল না (কবিতা) অনিবার্য পিপাসার কাছে (কবিতা), আনন্দময় নৈরাশ্য ও ইস্পাত মানুষেরা (কবিতা), নির্বাচিত কবিতা, হ্রেষাধ্বনির বাঁকবদল (গল্প), নিরুদ্দিষ্টের জলাবর্ত (গল্প), হাডসন স্ট্রিটের সুন্দরী (গল্প) ও শতাব্দীর সেরা আমেরিকার নির্বাচিত গল্প (অনুবাদ) উল্লেখযোগ্য। আগামী ২০১8-এ বই মেলায় তাঁর নতুন আরেকটি কবিতাগ্রন্থ ‘দৃশ্যকল্প ও কতিপয় রাতের রমণী’ প্রকাশিত হতে যাচ্ছে। তিনি বাংলা একাডেমির সদস্য এবং বিভিন্ন সাহিত্য সংগঠনের সঙ্গে জড়িত।

তমিজ উদ্দীন লোদী দুটি কবিতা

হেলুসিনেশন

দূর রাস্তায় ছায়ার মতো চলেছ তুমি। নষ্ট হয়ে গেছে জিপিএস রিসিভার। নিভে গেছে স্ক্রিন। হাতড়ে চলেছ নক্ষত্র দেখে। যেন পৌরাণিক নাবিক।
ঘন হয়ে উঠেছে আকাশ। পাকিয়ে উঠেছে কুয়াশা। তুমি হাফ অন্ধ আর অনুমাননির্ভর। তুমি পালাচ্ছ। যেন পেছনে ছুটছে শিকারি কিলার ওয়েইল আর হাঙরের দল।
কোনো প্রতিফলন নেই আলোর। ধূসর কুয়াশার মেঘ ক্রমশ অন্তরাল হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। বাতাস থম ধরে আছে। শব্দ নেই। চারপাশে কবরের মতো নিস্তব্ধতা।
তুমি ছুটতে চাইছ কিন্তু পারছ না। উষ্ণতা চাইছ কিন্তু হিম ছাড়া আর কিছুই অনুভব করছ না। শুধু অনুভব করছ ধারালো কাচ দিয়ে কাটা হচ্ছে তোমার মুখ।
ক্রমশ আটকে যাচ্ছ একটি বৃত্তে। যা থেকে তুমি কিছুতেই বেরোতে পারছ না।

হ্যাঙওভার

মুখোশের আড়ালে কোমলতা লুকোতে লুকোতে ক্রমশ হাঁপিয়ে ওঠা গেল। তবু চাপা অহংকার ঝলসে যাচ্ছে চোখেমুখে। বড় যান্ত্রিক বড় স্টিরিওটাইপ। অ্যালসেসিয়ানের লোমের মতো মসৃণ সন্ধ্যা তবু ঘনায় চারপাশে। পরচর্চা আর পিণ্ডি চটকানোর মতো সামাজিকতা নামে ঝাড়বাতি আর রঙিন ফোয়ারার নিচে।
তবু কোথা থেকে ভ্যাপসা গুমোট গন্ধ ঘাই মারে। ম্যাড়মেড়ে একটি বালিশের তুলো উড়ে বেড়ায়। একটি ফিঙে কি দোয়েল অনবরত শিস দেয়। ভেজা স্যাঁতসেঁতে আঙিনা লাফায়। তৃতীয় একটি চোখ কিছুতেই সরে না। ব্ল্যাক আউট হয় না কিছু। ভাঙা ভাঙা সব ছবি সেলুলয়েডের ফিতের মতো ঘোরে।
মনে হয় পাখাময় একটি ঘোড়া উড়ে যাচ্ছে আকাশে। জবুথবু পালকহীন একটি পাখি বসে থাকে পাতাহীন শাখায়। মনে হয় লোলচর্ম একটি পথকুকুর ল্যাংচাচ্ছে অবিরাম।
বল্লমের মতো বিঁধে যাচ্ছে কিছু। খয়েরি কয়েকটি শেয়াল দ্রুত পালিয়ে যায় ঝোপের আড়ালে। বিড়ি ও হুঁকো ফুঁকা মুনিষ ও চাষিদের মুখ ভেসে ওঠে। ভেসে ওঠে একটি নদী। বোরো কি আউশের সোঁদা গন্ধ। জলজ ঘ্রাণ।