সারফুদ্দিন আহমেদের তিনটি কবিতা

এক পাড়ায়

আমরা দুজন একটি পাড়ায় থাকি
সেই আমাদের একটি মাত্র মিল
তার জানালায় বসে চড়ুই পাখি
আমার ছাদে কটকটে লাল চিল

তার বিড়ালে আসে আমার ঘরে
রান্নাঘরে তালাশ করে মাছ
মাছ না পেয়ে ইঁদুর খুঁজে মরে
তাও না পেয়ে ঘাঁটে কী ছাইপাঁশ!

আমাদের এই পাড়ার নামটি যার জানা
আমাদের এই বাড়ির নামও তার জানা
আমার নাম তো জানে পাড়ার দশজনে
আমাদের সেই তাহার নামটি ফারজানা

দুইটি বাড়ি বড়ই কাছাকাছি
মাঝে শুধু একটি গলির ফাঁক
গলির মোড়েই থাকে ধীরেন গাছি
আরও থাকে এক জোড়া দাঁড় কাক

তাদের বাড়ির কাজের ছেলে হারুন
আমার বাড়ির নূরীর কাছে আসে
এই জুটিকে মানায় কী যে দারুণ!
যখন দুজন দাঁড়ায় এ ওর পাশে

আমাদের এই পাড়ার নামটি যার জানা
আমাদের এই বাড়ির নামও তার জানা
আমার নাম তো জানে পাড়ার দশজনে
আমাদের সেই তাহার নামটি ফারজানা

আমাদের এই পাড়ার গলি পরে
বিকেল বেলা বসে ফুচকাওয়ালা
ফচকে ফাজিল কেউ থাকে না ঘরে
যতই তখন মেইন গেটে দাও তালা

তাদের ছাদে চোখ চলে যায় ভুলে
সন্ধ্যে বেলা যখন বাড়ি ফিরি
ভয়ে আবার হাঁটি চশমা খুলে
ভয়টা যে তার দাদার দাদাগিরি

আমাদের এই পাড়ার নামটি যার জানা
আমাদের এই বাড়ির নামও তার জানা
আমার নাম তো জানে পাড়ার দশজনে
আমাদের সেই তাহার নামটি ফারজানা।

 আমায় তোরা মাফ করে দিস ভাই

(মুজিব ইরমের ‘আহাজারি’ কবিতা পড়ার পর)

শীত নামছে, শীতল কাতলা বিলে
ওশ নামছে ঠান্ডা ঘাসের গায়
যতীন গাছি খেজুর রসের ঠিলে
কাঁধে নিয়ে যাচ্ছে খালি পায়।

বারান্দার এক কোনায় মাজা ঘষা
কাঁসার গেলাস, মাটির ভাঁড়ে দই
পাশে গুড়ের বাটির সাথে বসা
এক গামলা বেছন ধানের খই।

তার ওধারে পাটের খড়ির মাচা
সারা মাচায় মাকড়সা জাল-ঝুল
চাল কুমড়োর জালির মতো কাঁচা
ঝুলছে সাদা একটা কদুর ফুল।

ন্যাংটা শিশুর ঠোঁটের ফাড়া ঘায়
ওষুধ এখন দুর্বা ঘাসের ওশ
মাফলারে কি গতর ঢাকা যায়?
অঘ্রান শেষ। নামল এবার পোষ।

ওরে পৌষ! ওরে গুড়ের বাটি!
রসের ঠিলে! ওরে খেজুর পাটি!
ওরে মাচা! ওরে কদুর জালি!
দুর্বা ওরে! ওরে কুমড়ো ফালি!

বাটি-পাটি-জালি-ফালি
আমায় তোরা মাফ করে দিস ভাই
তোদের আমি বুঝতে পারি নাই।
আমি এখন রাজধানীতে চাকরি করে খাই।

হাঁটু পানির পাগার পাড়ি দিয়ে
মক্তবে যায় শেলীর ছেলে অলি
রেহেলবন্দী লাল সিপারা নিয়ে
ঠিক যেন এক ডালিম ফুলের কলি।

দিঘির ঘাটে ক্লাস নাইনের মালা
রোদ পোহাতে মাদুর পেতে বসে
এক হাতে তার চিতই পিঠার থালা
থালায় পিঠা ভাসে খেজুর রসে।

ঘাটের ডোবা সিঁড়ির শ্যওলা তলে
ব্যাঙ্গাচি আর তেলাপিয়ার ছাও
শোলের পোনা তারার মতো জ্বলে
পাশেই বাঁধা ভাঙা ডিঙ্গি নাও।

ঘরের পাশে ছালার জামা পরা
তিনটে ছাগল চাবায় কাঁঠাল পাতা
তাদের গোছড় নুরীর হাতে ধরা
নুরীর গায়ে ময়লা ছেঁড়া কাঁথা।

ওরে দিঘি! ওরে পিঠার থালা!
ওরে ডোবা! ওরে কাদার নালা!
ওরে ছালা! ওরে কাঁঠাল পাতা!
ওরে নুরী! ওরে ময়লা কাঁথা!

থালা-নালা-পাতা-কাঁথা
আমায় তোরা মাফ করে দিস ভাই
তোদের আমি বুঝতে পারি নাই
আমি এখন ঢাকা শহর, কামলা দিয়ে খাই।

ধার-উধার

বইমেলাতে আমার একটা বই বেরোবে।
বই মানে সেই কাব্যগ্রন্থ। শব্দগাঁথা পঙ্‌ক্তিমালা।
শব্দগুলো গাঁথতে হবে। তারপরে তো কাব্য হবে!

পাতার মতো শব্দ থাকে মনের গাছে
যত্নে ছিড়ি শব্দপাতা, পেঁচিয়ে ফুঁ দেই—
গানের মতো বেজে ওঠে পদ্য রাশি।
তখন পাতা আর পাতা নয়, তখন সে হয় পাতার বাঁশি।

পাণ্ডুলিপি শেষের পথে। একটা পদ্য কম পড়েছে।
ও কবি, তুই একটা পদ্য ধার দিবি?
তার বদলে আমার যা চাস তাই নিবি!

ধার চেয়েছি এ ওর কাছে; নদীর কাছে, বিলের কাছে
জীবন দাশের খরায় পোড়া ধূসর ডানার চিলের কাছে
এমন কৃপণ! দেওয়ার আগেই শুনতে হলো, ‘ফেরত দিবি কবে?’
ও কবি, তোর বুকপকেটে একটা পয়ার হবে?

মাইরি বলছি, এইবারই শেষ! আর চাব না
ও কবি, তুই একটা পদ্য ধার দিবি?
তার বদলে আমার যা চাস তাই নিবি!