তুষার বন্ধু 'বম্ব সাইক্লোন'

কবিতার ভাষায় বলি, 

নগর কোতোয়াল বদল হয়েছেন
আইন চলছে কিছুটা বেসামাল
সে খবর যদি প্রেমিকা না জানে
কার সাথে প্রেম হবে?
স্ট্রিট লাইট? নাকি মুদি দোকানের টিম টিমে কুপি বাতির সাথে!

ভালোবাসার নিউইয়র্ক শহরকে বদলে দিয়েছে প্রকৃতি। অসুরীয় শক্তিমত্তার সঙ্গে দানবীয় আলিঙ্গনে এ শহর আজ শুভ্র শ্বেত উপত্যকা। মাত্র এক দিনের তুষারঝড়ে প্রতিটি নগরবাসীর উদ্বেগ আর উৎকণ্ঠার মাত্রা রেকর্ড ছাড়িয়ে যাওয়ার পর্যায়ে প্রায়। ভোরের আলো ফোটার আগেই পেঁজা পেঁজা তুলাসদৃশ তুষার নেমে এসেছিল সবখানে। শুধু তুষার আর তুষার! রাতের শেষভাগে বাতাসে ভেসে বেড়াল তুষার। এরপরই কিনা বিন্দু বিন্দু আকারে ফোঁটায় ফোঁটায় নেমে এল এফডিআর ড্রাইভে, কুইন্সের বিকিউতে। সঙ্গে জ্যামাইকার ওয়ান ফ্যামিলি হাউসের পিচঢালা চত্বরে। কখনো নিরবচ্ছিন্নভাবে ঝরতেই থাকল বালিকার কান্নার মতো।

এবারের তুষারঝড় ছিল আরও জীবন্ত ও রাগী প্রকৃতির রূপ নিয়ে। খ্যাপা বাতাসের দমকা ঝাপটায় মানব কিংবা মানবী কেউই স্থির থাকেনি। ডান নয়তো বাঁ থেকে দিয়েছে বরফ শীতলের বিরক্তিকর ছোঁয়া। একেবারে বিচ্ছিরি কাণ্ড এবং একেবারে অনাহূত পাশাপাশি চলা। ভোরের আলোর সঙ্গে এ নগরীর বড় অংশের খেটে খাওয়া মানুষের দীর্ঘদিনের সখ্য। কেউবা ঘর ছেড়ে দায়িত্ব পালন করতে বের হন। কেউবা আবার সারা রাত প্রিয় এ শহরটিকে নিদ্রাহীন রেখে ভোরের এ আধো আলোতে বাড়ির পথ খোঁজেন। আজ সবার ভুরু কুঞ্চিত। কেউবা বাড়ি থেকে বের হতে গিয়ে হন অবাক! দরজার বাইরের দিকটা বরফে ঠাসা। দরজা আটকানো। কোনোমতেই খোলা যাচ্ছে না! ঘড়ির কাঁটা টিক টিক চলছে। কিন্তু সে নিজেই যে আজ থেমে আছে দরজার ওপাশে! বাড়ি মুখরা ভাবনাতে কাটাল সেই ভোরের শুরুর সময়টাতে।
বাইরে কিন্তু তুষারের সোহাগ বিলানো থেমে নেই। বিরামহীন চলছে তো চলছেই। সাহস করে যাঁরা বেরুলেন শুধু তাঁরাই তুষারমাখা রাস্তার পাশ ঘেঁষে গুটিসুটি মেরে পা টিপে টিপে হাঁটছেন। এ যেন উত্তর মেরুর অভিযাত্রীদের মূল ক্যাম্প লক্ষ্য করে হেঁটে চলা। পৌঁছাতেই হবে লক্ষ্যে। সবকিছু আজ এই ভোরে অতি ব্যতিক্রমী বলে চিত্রায়িত। আজকের ভোরের এই রুদ্রমূর্তির সঙ্গে এতটা জানাশোনা নেই বলেই হয়তো আশপাশ বেশ অচেনা লাগছে।
তারপরও চেনা এই ভালোবাসার নগর, এই শহর আমাদের প্রতিদিনের শারীরিক আর মানসিক সত্তার সঙ্গে লেপ্টে আছে অন্যান্য দিনের মতোই। প্রতিটি নাগরিক সুবিধাকে আমরা ভোগ করি সানন্দে। মাঝে মাঝে এর যে ব্যতিক্রম ঘটে, তা-ও যেমন সত্যি তেমনি আমাদের ভালোবাসাতেও কখনো ছন্দপতন ঘটে যায়। তা কখনো উৎকণ্ঠায় নয়তো অনাকাঙ্ক্ষিত কোনো কারণে। আজ তা-ই হলো। এই দানবিক তুষারপাতের পুরোটা সময়জুড়েই ভালোবাসার এই শহর ছিল অনেক ক্ষেত্রে ব্যতিক্রমী।
অনেকে আজ কাজে যেতে পারেননি। পাতালরেলের চলাচল স্বাভাবিক ছিল না। পথচারীরা অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে ছিলেন বাসের জন্য। পাতালরেলের এক লাইন থেকে অন্য লাইনে যাত্রা বদল করতে গিয়ে হিমশীতল আন্ডারগ্রাউন্ড স্টেশনে অপেক্ষার জ্বালা বাড়ল। কয়েক পরত শীতবস্ত্র গায়ে পরেও হিমের জাপ্টেধরা অনুভূত হয়েছে। দুই হাতের আঙুলগুলো উলের তৈরি দস্তানার ভেতরে অনুভূতিহীন অসাড় হয়ে রইল সারাক্ষণ। পরদিন সব কটি আঙুলে ছিল পুরো দিনজুড়ে ব্যথা। তারপরও আমরা বলতে ভালোবাসি আমি নিউইয়র্কে থাকি। আমি নিউইয়র্কার!
শীতের এই তুষারঝরা আনন্দ আমেজের সময়টি অনেকের কাছে ছিল উৎসবমুখর। বিরূপ আবহাওয়াতে নগর কর্তৃপক্ষ বাচ্চাদের স্কুলগুলো আগেই ছুটি ঘোষণা করেছিল। অনেকেই কাজ থেকে পেয়ে যান সাময়িক ছুটি। সবাই বাসায় হিটারের উষ্ণতায় বসে সারা দিনের আনন্দময় দিনের ছক আঁকলেন। সুগৃহিণীদের সাজানো রন্ধনশালায় শুরু হলো নানা ধরনের মুখরোচক খাবারের প্রস্তুতি। কে বলে প্রকৃতির এই বিরূপ আচরণে আমরা কখনো হতাশ হই! মোটেই না।
বাড়ির চার দেয়ালের মধ্যেই বাদল দিনের গানে সবাই আবেগে একেবারে মাখামাখি। ছোটদের টিভিতে বা ফোনস্ক্রিনে কার্টুনের নানা আওয়াজের সঙ্গে ওদের সরল উচ্ছ্বসিত হাসি। মেন্যু নির্বাচনে একে অন্যের পছন্দে কখনো সায় কখনো বাগড়া দেওয়া। এরপরও খাড়া হয়ে গেল সবার পছন্দের কয়েক পদের মজার মজার খাবার। মধ্যে কয়েকবার চলল ঝালমুড়ির সঙ্গে কড়া করে দুই রাউন্ডের চা ও কফি। এর ফাঁকে চলল ফেসবুকের মেসেঞ্জারে দেশ-বিদেশের বন্ধুদের নানা প্রশ্নের জবাব! ক্যাপশনসহ আজি যাসনে ঘরের বাহিরে, এমনো তুষার ঝরার দিনে! আর চলছে জানালার পাশে দাঁড়িয়ে তুষার ঝরার ছবি তুলে ফেসবুকে আপলোড করা।
এদিকে কেউ কেউ খাবার তৈরি করে ফেসবুকে দিয়ে কাছাকাছি থাকেন এমন বন্ধুদের সাদরে ডেকে ডেকে বলা, কী হলো, তোমরা চলে এসো! এত দেরি করছ কেন? মজার মজার খাবার তৈরি করেছি। তোমরা এলেই গরম গরম টেবিলে দেব! তবে তোমরা যদি আজ না-ও আসো, তাতেও অসুবিধা নেই! আজ আমরা এক নতুন বন্ধু পেয়েছি। যে ভোর থেকে আমাদের সঙ্গেই আছে। সে অনেক দূর থেকে এসেছে উদ্দাম হয়ে, উড়াল দিয়ে! অনেক অনেক ভালোবাসা নিয়ে শীতল বন্ধুর বেশে ভেসে ভেসে। ওই রাজকুমার তুষার বন্ধুর নাম ‘বম্ব সাইক্লোন’! তার সঙ্গেই খেলব আমরা! তোমরাও চলে এসো!