কার হাত পৌঁছায় এত উচ্চতায়?

ঘটনা পাঁচ বছর আগের। ২০১৩ সালের। কুইন্সের আমার বাড়ির একটি অংশে ভাড়া থাকত এক স্প্যানিশ নারী। একপর্যায়ে সে ভাড়া দেওয়া বন্ধ করে দিল। বাড়ি ছাড়ার কথা বললে জানাতো, সে ছাড়বে না। আমি আশ্রয় নিলাম আদালতের। যথারীতি শুনানির পর আদালত রায় দিল আমার পক্ষে। একদিন বিকেলে মার্শাল এসে বাড়ির দখল বুঝিয়ে দরজায় নোটিশ লাগিয়ে গেল। সন্ধ্যায় আমি যখন মিস্ত্রিকে দিয়ে তালা পরিবর্তন করছিলাম, আচমকা সেই ভাড়াতে সঙ্গী সাথি নিয়ে এসে হইচই শুরু করে দিল। সে পুলিশ ডাকল, আমিও ডাকলাম। আদালতের রায় এবং মার্শালের নোটিশ দেখানোর পরও পুলিশ ভাড়াটের পক্ষ নিল। 

এক তরুণ পুলিশ অফিসার আমাকে বলল, ‘দেখো আমার সার্জেন্ট বলেছেন তোমার কাগজপত্র পর্যাপ্ত নয়। এই ভাড়াটেকে তাঁর ঘরে ঢুকতে দিতে হবে।’ হলোও তাই।
আমি নির্বাক। হতবাক। আদালতের হুকুমে মার্শাল যখন সমজে দেওয়ার পরও বেদখল হয়ে গেল বাড়ি। এখন কি আমার করণীয়?
সেদিন ছিল শুক্রবার। শনি রোববার ছুটি। অপেক্ষা করতে হবে সোমবারের। অফিস বন্ধ থাকায় আমার অ্যাটর্নির সঙ্গেও যোগাযোগ করা যাচ্ছিল না। শুভানুধ্যায়ী দু-একজন পরামর্শ দিলেন, কমিউনিটি পুলিশ আছে, তাদের সঙ্গে কথা বলেন। আবার পরিচিত কয়েকজন কমিউনিটি নেতা আছেন, তাঁরা পুলিশ প্রশাসনের সঙ্গে সভা বৈঠক করেন। পত্র পত্রিকায় খবর ছবি বের হয়। ভাবলাম, তাঁদের পরামর্শ নিতে পারি। একজন একজন করে তাঁদের সবাইকে ফোন করলাম। পরামর্শ যা পেলাম, তাঁর সারাংশ হলো-তাদের হাত এত উচ্চতায় পৌঁছাবে না। যা করার আমাকেই করতে হবে।
সত্যি বলতে কি, সেদিন শুধু হতাশই হইনি। মূলধারায় আমাদের জিরো উপস্থিতির কথা ভেবে দারুণ কষ্টও পেলাম। আমাদের কি এমন নেতা নেই, যার হাত কর্তৃপক্ষের দরজায় নক করবে। এমন কোনো কণ্ঠ নেই, যার আওয়াজ ধ্বনি প্রতিধ্বনি হবে? এমন কোনো মুখপাত্র নেই, যার কথা শুনে প্রশাসন নড়ে চড়ে বসবে?
আর্ল শার্পটন। প্রতিবাদী এক নেতার নাম। একসময় প্রতিবাদী ভূমিকা উজ্জ্বল ছিলেন শিকাগোর জেসি জ্যাকসন। আর্ল শার্পটন কৃষ্ণাঙ্গদের অধিকার আদায়ে সদা সোচ্চার। কেউ কোথাও আক্রান্ত হলে, অবিচার অনাচার নেমে এলে সঙ্গে সঙ্গে হাজির আর্ল শার্পটন। কণ্ঠে ঝরে পড়ে ক্ষোভ, জ্বলে ওঠেন নিজস্ব ভঙ্গিমায়। তাঁর কণ্ঠ ইথারে ভেসে পৌঁছে যায় সকল দুয়ারে।
স্পেনিশদের কথা বলার অনেকে আছে। তাদের টিভি চ্যানেল ৪১ একাই এক শ। কথা বলে পারে ভারতীয়, চায়নিজরা। তিব্বতিদের হয়েও কথা বলে যান দালাই লামা। বাংলাদেশিদের জন্য কথা বলতে পারতেন নোবেল জয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনুস। কেন বলেন না, জানি না।
নিজের মনে প্রশ্ন জাগে, এক ছোট্ট ঘটনায় এত বড় বড় কথা বলা কি আমার সাজে? হয়তো সাজে না। আবার ভাবি, হয়তো আমরা জানি না। অগোচরে কত ঘটনাই ঘটে যায়। কতজনই হয়তো আমার মতো স্বপ্ন দেখেন, এই অন্যায়ের প্রতিবাদ হোক। আমাদের পাশে এসে কেউ দাঁড়াক।
একটি কণ্ঠ সোচ্চার হোক। এমন এক কণ্ঠ যিনি কথা বলবেন ফার্নান্দো মেটিওর মতো।
মেটিও নিউইয়র্ক ট্যাক্সি চালক ফেডারেশনের নেতা। খবরে দেখি, কোথাও কোনো ক্যাবচালক আক্রান্ত হলে সর্বাগ্রে হাজির হন ফার্নান্দো। প্রতিবাদে মুখর হন। দাবি করেন প্রতিকার। ক্যাবিদের কোনো ঘটনায় ধরে নেওয়া যায় ফার্নাদো পাশে দাঁড়াবেনই। মিডিয়াও জানে, ফার্নান্দোর কথা জানতে হবে, জানাতে হবে।
আমাদের কে আছে? কার কথা শুনবে?
মনে পড়ে যুক্তরাষ্ট্রে প্রথম বাঙালি কাউন্সিলম্যান শাহাব আহমেদ সুমিনের কথা। ব্যক্তগত আলাপচারিতায় বলছিলেন, ‘রাজনীতি করবেন? প্রথমে জানতে চাইবে, কে আপনি? কি আপনার যোগ্যতা? দেশকে দেওয়ার কী আছে আপনার? শিক্ষা? ধন? না হয় অসাধারণ প্রজ্ঞা। এর কোনো না কোনো একটি থাকতে হবে।’ মনে রাখার মতো যে কথা বলেছিলেন, তা হলোঃ বিস্ময়ের বিষয়, আমরা যখন সাদা লোকের মুখোমুখি হই। আপনা-আপনি নুয়ে পড়ি। মাথা উঁচু রাখতে পারি না। রাজনীতি করতে চাইলে মনস্তাত্ত্বিক এই জগৎ থেকে বেরোতে হবে।
আমি বরাবর আশাবাদী। সুমিনের পথ ধরে মিশিগানের হ্যামট্রামিক সিটিতে বাঙালি কাউন্সিলম্যানদের এখন জয়জয়কার। নিউজার্সির প্যাটার্সন সিটিতেও রচিত হয়েছে বাঙালির সাফল্যের ধারা। ড. নুরুন্নবী নিউজার্সির একটি শহরে কাউন্সিলম্যান নির্বাচিত হয়ে আসছেন। ফিলাডেলফিয়াতে নীনা আহমেদ যুক্তরাষ্ট্র কংগ্রেসে নির্বাচিত হবেন, এমন আশায় বুক বেঁধেছেন বাঙালিরা।
মিশিগানের হেনসেন ক্লার্ক, যার পিতা সিলেটের বিয়ানীবাজার উপজেলার শ্রীধরা গ্রামের। হেনসেন ক্লার্ক কংগ্রেসম্যান নির্বাচিত হয়েছিলেন। হেনসেন ক্লার্ককে বাঙালি মনে করে সবাই যখন গর্ব করছিলেন, একদিন দেখা গেল ইএসপিএন টিভিতে স্বয়ং মি. ক্লার্ক বলছেন, তাঁর পিতা ভারতীয় এবং মা আফ্রিকান আমেরিকান!
নিউইয়র্ক সিটিতে মূলধারার রাজনীতিতে মুর্শেদ আলম হাঁটি হাঁটি করে এগোচ্ছিলেন। হঠাৎ করেই তিনি থেমে গেলেন। কারও কারও মতে থামিয়ে দেওয়া হয়েছে। গিয়াস আহমেদ শুরু করলেও এখন দেখা নেই এই অঙ্গনে। বর্তমানে মিসবাউদ্দিন, হেলাল শেখ, তৈয়বুর রহমান, অ্যাটর্নি মঈন চৌধুরী, এম এন মজুমদার, আব্দুশ শহীদসহ অন্যান্যরা তাদের সরব উপস্থিতি জানিয়েছেন। আশা করি তাদের কেউ অথবা আমাদের অজানা কেউ সাফল্যের হাসিতে বাঙালির মুখ উজ্জ্বল করবেন। হবেন আমাদের নেতা, আমাদের কণ্ঠ।

পুনশ্চ: অ্যাটর্নির দৃঢ়তায় আমার বাড়িটি বেদখল মুক্ত হয়েছিল
লেখক: প্রবাসী সাংবাদিক।