ডা. এম এ রকিব: একজন কল্যাণব্রতীর চিরপ্রস্থান!

এম এ রকিব
এম এ রকিব

পরার্থে জীবন উৎসর্গ করার যে মহান ব্রত মানুষ যুগে যুগে পালন করেছে, ডা. এম এ রকিবকে তার উদাহরণ বলা যেতে পারে। ব্যক্তির স্বপ্নকে সর্বজনীন রূপ দিয়ে সেটাকে জনকল্যাণমুখী করে তিনি প্রমাণ করেছেন সত্যিই মানুষের অসাধ্য কিছু নেই!

সিলেট ডায়াবেটিক হাসপাতাল ও হার্ট ফাউন্ডেশন হাসপাতাল প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে তিনি জনসেবার যে উদাহরণ সৃষ্টি করে গেছেন, তা শুধু অনুকরণীয়ই নয়, আমাদের কালের মাইলফলকও বটে।

নিভৃতচারী এই জনসেবক ১৯৩৩ সালে সুনামগঞ্জের লক্ষণশ্রীতে জন্মগ্রহণ করেন। পিতা মরহুম আলমাছ আলীর আদরের এই সন্তান ছাত্র হিসেবে ছিলেন অসম্ভব মেধাবী। রকিব চিকিৎসক হবেন এবং মানুষের কল্যাণে কাজ করবেন এই অভিলাষ ছিল তার মা-বাবার। তাঁদের সেই প্রত্যাশাই শুধু তিনি পূরণই করেননি, ১৯৬৩ সালে ব্রিটেনে পাড়ি জমিয়ে সিলেটের প্রথম ডাক্তার হিসেবে অর্জন করেন এমআরসিপি ডিগ্রি। ইচ্ছে করলে সেখানে থেকে যেতে পারতেন। কিন্তু সেখানকার বিলাসবহুল জীবন তাঁকে আটকে রাখতে পারেনি।

মা মাটির প্রতি ভালোবাসা আর দায়বোধ তাঁকে নিয়ে আসে জন্মভূমে। ১৯৬৫ সালে দেশে ফিরে তিনি নিবিষ্ট মনে শুরু করেন মানবসেবা। মূলত সিলেট হার্ট ফাউন্ডেশন প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়েই শুরু হয় তাঁর কল্যাণযাত্রা। এরপর প্রতিষ্ঠা করেন ডায়াবেটিক হাসপাতাল। প্রয়াত জাতীয় অধ্যাপক ডা. মো. ইব্রাহিম ঢাকার শাহবাগে ঠিক যেভাবে প্রতিষ্ঠা করেন বারডেম হাসপাতাল একইভাবে ডাক্তার এম এ রকিব সিলেটে গড়ে তোলেন ডায়াবেটিক সমিতি। এই সমিতির মাধ্যমেই ১৯৮৪ সালে ডায়াবেটিক হাসপাতাল যাত্রা শুরু করে। হাটি হাটি পা পা করে এগিয়ে চলা এই হাসপাতালটিই বর্তমানে সিলেট অঞ্চলের ডায়াবেটিক রোগীদের অন্যতম ভরসাস্থলে পরিণত হয়েছে। 

মহৎ কোনো উদ্যোগ অর্থের অভাবে কখনো যে আটকে থাকে না, সিলেট এলে এই কথাটির সবচেয়ে বড় প্রমাণ মেলে ডায়াবেটিক হাসপাতালে। ৩৩ বছরের যাত্রাপথে হাসপাতালটি মানবসেবার এক অনন্য সেবাকেন্দ্রে পরিণত হয়েছে ডাক্তার রকিবের একাগ্রতায়। তিনি এই হাসাপাতালটিকে কখনো চিকিৎসালয় মনে করেননি। এটি তাঁর কাছে ছিল সন্তানসম। জীবনের সোনালি সময় ব্যয় করেছেন এই হাসপাতালের অগ্রগতিতে।
ডাক্তার রকিব ডায়াবেটিক হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা থেকে শেষ দিন অবধি কোনো সম্মানী নেননি। তিনি দেখিয়ে দিয়েছেন, কীভাবে সত্যিকারের মানবসেবা করতে হয়। স্ত্রী ডা. হাসনা রকিবসহ পরিবারের সদস্যদের ঠিক ততটা সময় দেননি যতটা দিয়েছেন এই হাসপাতালকে। যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী ছেলে-মেয়েকে বছরে একবার কিংবা দু’বার গিয়ে সঙ্গ দিলেও বাকিটা সময় কাটিয়েছেন এই ‘সন্তানের’ সঙ্গে। এ প্রসঙ্গে তাঁর সরল স্বীকারোক্তি ছিল, ‘ডায়াবেটিক হাসপাতাল আমার আরেক সন্তান।’
শূন্য থেকে শুরু করা সিলেট ডায়াবেটিক হাসপাতাল আজ পরিপূর্ণ প্রতিষ্ঠান। স্বল্প খরচে এখানে ডায়াবেটিকের পাশাপাশি নানা রোগের চিকিৎসা প্রদান করা হয়ে থাকে। হাসপাতালটিকে একটি ব্যতিক্রমী প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে তুলেছেন তিনি। নিজে সভাপতির পদ অলংকৃত করলেও সাধারণ সম্পাদক হিসেবে যাদের কাছে পেয়েছিলেন এদের সবাই কোনো না কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন। রাজনীতির কারণে দেশের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সুনাম ক্ষুণ্ন হলেও এই হাসপাতালের সম্প্রীতি কিংবা সৌহার্দ্য কোনোটাই বিনষ্ট হয়নি। যে দলই ক্ষমতাসীন ছিল সে দলই সাহায্য করেছে প্রতিষ্ঠানটির অগ্রযাত্রায়। আর এটা ডা. রকিবের কারণেই সম্ভব হয়েছে।
ঠিক একইভাবে সিলেট হার্ট ফাউন্ডেশন হাসপাতালকে তিনি আসীন করেছেন এক অনন্য উচ্চতায়। তাঁর প্রচেষ্টায় ১৯৮২ সালে সিলেটে হার্ট ফাউন্ডেশন প্রতিষ্ঠা লাভ করে। সেই থেকে ফাউন্ডেশনের সভাপতি ও হাসপাতালের চেয়ারম্যানের দায়িত্বে ছিলেন তিনি। ২০০৫ সালে ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশন হাসপাতালটি পরিপূর্ণ হাসপাতালে রূপান্তরিত হয়। ১৪৬ জন আজীবন সদস্যের এই সেবামূলক প্রতিষ্ঠানে শতকরা ৩০ শতাংশ রোগীকে বিনা মূল্যে চিকিৎসা সেবা প্রদান করা হয়ে থাকে। এটি সিলেট অঞ্চলে হৃদ্রোগের একমাত্র প্রতিষ্ঠান!
সিলেট এমএজি সম্মানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের অধ্যক্ষ হিসেবে ১৯৯২ সালে সরকারি কর্মজীবনের ইতি টানেন ডা. রকিব। অবসরে গিয়েও একদিনের জন্যও অবকাশ যাপন করেননি তিনি। ডায়াবেটিক হাসপাতাল, হার্ট ফাউন্ডেশন হাসপাতাল আর রোগীদের নিয়েই কেটেছে তাঁর সময়। রোগীদের তিনি শুধু ভালোবাসতেন না তাদের সম্মান করতেন স্বজনদের মতো। মানুষ আপনজনের যেভাবে খোঁজ-খবর নেয়, তিনিও সেভাবে তাদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতেন। সবার সঙ্গে কথা বলতেন হাসিমুখে। পান খেতে ভালোবাসতেন। তাই দূর-দুরান্ত থেকে তাঁর কাছে ছুটে আসত অসংখ্য রোগী। এমনকি দেশের বাইরে থেকেও এসেছেন অনেকে। মঙ্গলবার সেই মায়ার জগৎকে চিরবিদায় জানিয়েছেন তিনি। যার ফলে তার প্রিয় দুটি প্রতিষ্ঠান যেমন অভিভাবকহীন হয়ে পড়ল তেমনই তাঁর হাতে গড়া অন্যান্য প্রতিষ্ঠান হলো নির্দেশকহীন, স্বজনহারা।
এম এ রকিবের মৃত্যুতে সত্যিকারের একজন সেবাব্রতীকে হারিয়েছে দেশ। তাঁর চলে যাওয়ায় যে শূন্যতা তৈরি হয়েছে তা পূরণ হবে না কোনো দিন।