তারকাদের দিনলিপি

তারকারা কি অন্য জগতের বাসিন্দা? মোটেও সেটা নয়। তাঁরা সবাই আমাদের মতোই মানুষ। নিউইয়র্কে বাঙালি বসতির দ্রুত বৃদ্ধি যেমন ঘটছে, তেমনি এখানে স্থায়ী হয়েছেন বাংলাদেশের তারকা জগতের অনেক পরিচিত মুখ। উত্তর আমেরিকায় বসবাসকারী সাংস্কৃতিক অঙ্গনের মানুষদের নিয়ে এই প্রতিবেদন ‘তারকাদের দিনলিপি’। আজকের তারকা বাংলাদেশের এক সময়ের টিভি, মঞ্চ ও সিনেমার জনপ্রিয় অভিনেতা টনি ডায়েস
টনি ডায়েস ও তাঁর  স্ত্রী প্রিয়া
টনি ডায়েস ও তাঁর স্ত্রী প্রিয়া

আমি ঘুম থেকে উঠি ভোর সাড়ে ছয়টায়। অ্যালার্ম দিয়ে উঠতে হয় না। মেয়ে অহনা সকালে উঠে পুরো বাড়িতে এমন দুমদাম শুরু করে দেয় যে আর ঘুমানোর সুযোগ থাকে না। উঠে শাওয়ার নিয়ে নাশতা করে মেয়েকে স্কুলে নামিয়ে দিয়ে আসি। তারপর অফিসে রওনা হই। আমার বাসা লং আইল্যান্ডের নাসা কাউন্টির এক্সভিলে। সেখান থেকে জ্যামাইকার হিলসাইডে আমার অফিসে আসতে গাড়িতে ৪০ মিনিট সময় লাগে।

বিকেলে আবার বাসায় ফিরতে ৪০ মিনিট লাগে। সাড়ে সাতটা বেজে যায়। রাতের বাকি সময়টা স্ত্রী প্রিয়া আর কন্যা অহনার সঙ্গে কাটাই। তিনজনে মিলে সিনেমা দেখি। অহনা এখানকার আমেরিকান চ্যানেলগুলোতে নানারকম অনুষ্ঠান দেখে। মেয়েকে সঙ্গ দিতে সেসব দেখতে হয়। রাত এগারোটার মধ্যে ঘুমানোর চেষ্টা করি। রাতে সাত/আট ঘণ্টা ঘুমানোর চেষ্টা করি। রাতের ঘুমটা আমার খুব প্রিয়।

খাওয়ার বেলায় একটা নির্দিষ্ট ডায়েট অনুসরণ করার চেষ্টা করি। সকালে পিনাট বাটারের সঙ্গে পাউরুটি। দুপুরে অফিসে বসে বাসা থেকে আনা সালাদ খাই। আর বিকেলে চা আর টোস্ট। এরপর রাতে আর কিছু খাই না। তবে পার্টি থাকলে আলাদা কথা। সেখানে তো খেতেই হয়। তবে সর্বোতভাবে চেষ্টা করি রেড মিট মানে গরুর মাংস কিংবা খাসির মাংস না খেতে। চিংড়িও পারতপক্ষে ছুঁয়ে দেখি না।

কোনো জিমনেশিয়ামে যাওয়া হয়ে ওঠে না। তবে বাসায় সপ্তাহে তিন দিন খালি হাতে ব্যায়াম করি। বুধবার, শুক্রবার ও রোববার—এই তিন দিন ব্যায়াম করা হয়। গ্রীষ্মকালে প্রতিদিন নিয়ম করে ৪৫ মিনিট দৌঁড়াই। আসলে স্কুল জীবনের একটা বড় সময় মিশনারি স্কুলে কাটিয়েছি। তাই নিয়ম কানুনের মধ্যে থাকতেই ভালো লাগে। এখানে যেটাকে বলে মিডল স্কুল সেই সময়টা ষষ্ঠ থেকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত আমি চট্টগ্রামের আনোয়ারা মিশনারি স্কুলে পড়েছি। 

আমার ঢাকা থেকে চট্টগ্রামে পড়তে যাওয়ার পেছনে একটা ছোট কাহিনি আছে। আগে বলে নেই, ১৯৭১ সালের আগস্টে আমার জন্ম ইস্কাটনের হলিফ্যামিলি হাসপাতালে। আমি খুব গর্বিত এই কারণে যে আমার জন্ম বাংলাদেশের জন্ম সালে। আমার বাবা-মা তখন হলিফ্যামিলি হাসপাতালে চাকরি করতেন। থাকতেন মগবাজারের পেয়ারাবাগে। পরে ১৯৭৩ সালে মোহাম্মদপুরের কাজী নজরুল ইসলাম রোডে চলে যান। আমাকে এখন দেখে খুব শান্তশিষ্ট মনে হয়। কিন্তু ছোটবেলায় আমি ছিলাম বেশ চঞ্চল, দুষ্টুমিতে মেতে থাকতাম। পড়াশোনায় একদম মন ছিল না, সারাক্ষণ খেলতাম। মোহাম্মদপুর ফিজিক্যাল কলেজ মাঠে খেলতে যেতাম। সাত মসজিদ রোডে আবাহনী ক্লাব মাঠেও খেলতাম। তখন আবাহনীতে খেলতেন কাজী সালাউদ্দিন-আশরাফউদ্দিন চুন্নুর মতো ফুটবলাররা। বসে বসে তাদের অনুশীলন দেখতাম।
আমার দুরন্তপনা দেখে বাবা-মা পাঠিয়ে দিলেন চট্টগ্রামের সেই মিশনারি স্কুলে। উদ্দেশ্যে আমি যাতে নিয়ম-শৃঙ্খলার মধ্যে আসি। বাবা-মার ওই সিদ্ধান্তটা পরবর্তী জীবনে খুব কার্যকর প্রভাব রেখেছিল। পারিবারিক মূল্যবোধের শিক্ষাটা ওই বয়সে পাই। যেটা আমার পুরো জীবনে ইতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। আমার সব চিন্তা পরিবারকে নিয়ে। শুধু নিজের স্ত্রী-সন্তান নয়, আমার বাবা-মা, ভাই-বোন, আমার শ্বশুরবাড়ির লোকজন, আমার চাচারা এখানে থাকেন—তাদের সবাইকে নিয়েই আমার পৃথিবী।
পরিবারের সবাই এখানে থাকে বলে বাংলাদেশ ছেড়ে থাকতে অতটা খারাপ লাগে না। আর অভিনয় জগতের কথা বলছেন, আমি আসলে সেভাবে কখনই পেশাদার অভিনয় শিল্পী ছিলাম না। অভিনয় করতাম শখের বশে। বাংলাদেশে অনেক দিন অভিনয় করার পর বুঝলাম, আসলে আমার নতুন করে কিছু দেওয়ার নেই। আর আমাদের নাটক বলুন আর সিনেমা বলুন, বাজারটা খুব ছোট। আমাদের অনুষ্ঠান আমরা ছাড়া কেউ দেখে না। এমনকি পশ্চিমবঙ্গের বাঙালিরাও না। কলকাতায় একজন কেউ ভালো করলে তার সুযোগ থাকে মুম্বাইয়ে যাওয়ার, কিংবা তামিল ছবিতে কাজ করার, আমাদের দেশে সেই সুযোগ নেই।
এখানে প্রত্যেকটি হলে নিয়মিত ভারতের সিনেমা প্রদর্শন করা হয়। ওখানকার শিল্পীদের সারা পৃথিবীর মানুষ চেনে। বাংলাদেশের একজন প্রতিভাবান অভিনেতা, ধরুন রাজ্জাক, তাঁকে বাংলাদেশ আর কলকাতার বাইরে কেউ চিনত? কেউ না। রুনা লায়লা-সাবিনা ইয়াসমিন এত ভালো শিল্পী হয়েও শুধু বাংলাদেশে জন্ম নেবার কারণে বিশ্বজোড়া খ্যাতি পাননি।
২০০৯ সালের অক্টোবরে আমেরিকায় অভিবাসী হয়ে আসি আমি। তার আগে আসা যাওয়ার মধ্যে ছিলাম। এখানকার জীবনযাত্রার বেশির ভাগ জিনিসই আমার ভালো লাগে। প্রথমত ভবিষ্যৎ নিয়ে কারও কোনো চিন্তা নেই। সেটা ভাবার জন্য রাষ্ট্র আছে। রাস্তায় বের হলে মাস্তানের আক্রমণের শিকার হওয়ার ভয় নেই। বাজারে মাছে ফরমালিন নেই, পুলিশের হয়রানি নেই, লোডশেডিং নেই।
তবু মাতৃভূমির প্রতি টান তো থেকেই যায়। এখানকার তুলনায় প্রিয় জন্মভূমির আবহাওয়া অনেক ভালো। বিশেষ করে এই শীতকালটা আমার একদম অসহ্য। সারাক্ষণ ঘরে বন্দী হয়ে থাকতে হয়। আর দিন গুনতে হয়—‘কবে মার্চ মাস আসবে?’ বাংলাদেশে মানুষের আন্তরিকতার কোন তুলনা নেই। বাংলাদেশের জীবনযাত্রা এখানকার মতো দ্রুতগতির নয়। আমরা বন্ধুবান্ধবেরা মিলে প্রায় প্রতিদিনই আড্ডা দিতাম। এখানে কোনো পার্টি ছাড়া সাধারণত সবার সঙ্গে দেখা হয় না। আবার বাসায় পার্টি বা অনুষ্ঠান হলে সব কাজ নিজেদের করতে হয়। বাংলাদেশে যেমন গৃহকর্মীরা সহায়তা করত, এখানে সেটা আশাই করা যায় না।

তবে গৃহকর্মী না থাকার একটা ভালো দিক হলো, বাসায় যেকোনো কাজ আমরা তিনজন মিলে করি। আমার স্ত্রী প্রিয়া সাধারণত রান্না-বাড়া করে, লন্ড্রির কাজও সে করে। তবে বড় পার্টি হলে খাবার-দাবার বাইরে থেকে কিনে আনি। বাসার গোছগাছ-পরিষ্কার করার দায়িত্ব আমার আর অহনার। বিশেষ করে তিনটা বাথরুম পরিষ্কার করার দায়িত্ব আমার, সেটা আমার বউ বা কন্যা কখনো করবে না। কি আর করা!

পার্টি নিজের বাসার হোক আর অন্যত্র হোক, সব সময় চেষ্টা করি মাছ ও শাক সবজি জাতীয় খাবার খেতে। আমার আত্মীয়-বন্ধুরা সবাই জানে, টনি মাছ খেতে পছন্দ করে। তাই আমার কথা ভেবে সবাই মাছের পদ রাখে। বিভিন্ন মাছের মধ্যে আমার দেশি মাছ খুব পছন্দ। ইলিশ সবচেয়ে প্রিয়। তারপর পুঁটি-টেংড়া কোনটাতে না নেই। আমি মাছ খাওয়ার পরে প্লেট দেখলে বোঝা যাবে না কিছু খেয়েছি। মাছের কাটা পর্যন্ত চিবিয়ে খাই।
মাছ খাওয়ার পেছনে আমার বাবা এডমন্ড ডায়েসের একটা প্রভাব আছে। আমরা যখন মোহাম্মদপুরে থাকতাম, বাবা প্রতিদিন টাউন হল বাজারে যেতেন। আমিও সঙ্গে যেতাম। তখন প্রতিদিন বাসায় টাটকা মাছ রান্না হতো। মা মেরি ডায়েস রান্না করতেন। আমার বাবা পৃথিবী ছেড়ে চলে গেছেন। মা এখনো জীবিত। থাকেন নিউইয়র্কেই। তাঁর বয়স আশির ওপরে। এলমহার্স্টে আমার ছোট বোনের বাসায় থাকেন তিনি। ওখানে থাকার কারণ, মা একা ঘুরতে পছন্দ করেন। আমার এখানে ট্রেনের সুবিধা নেই। তিনি ট্রেনে করে একাই ম্যানহাটন-ব্রঙ্কসে চলে যান। এমনকি একাই আপ স্টেটে বোনদের কাছে চলে যান।
আমি খুব বেশি ধার্মিক নই। তবে প্রতি রোববার গির্জায় যাই। ঢাকায় থাকতে বাবা-মায়ের সঙ্গে ফার্মগেটে ক্যাথলিক চার্চে যেতাম। এখানেও সেই ধারাটা বজায় রেখেছি। আমার মেয়ে যেমন এখন রোববার হলেই মনে করিয়ে দেয়, বাবা গির্জায় যাবে না? মানুষ যে ধর্মেরই হোক না কেন, এই চর্চাটা পরিবারের মধ্যে রাখা উচিত। আমার মুসলমান বন্ধুরা শুক্রবার জুমার নামাজ পড়তে যায়, আমার খুব ভালো লাগে।
আমি সব সময়ই বিশ্বাস করি, দিন শেষে মানুষের আসল শক্তি তার পরিবার। এটা আমাদের সন্তানদের বোঝাতে হবে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের দৌরাত্ম্য তরুণ প্রজন্মকে কেমন যেন স্বার্থপর করে দেয়। তারা ভাবতে শুরু করে, কবে আমি বড় হব। আয় করব। আলাদা হয়ে যাব বাবা-মায়ের কাছ থেকে। ওরা যাতে এটা না ভাবে, সে জন্য সন্তানকে বেশি করে সময় দিতে হবে। একটা পারিবারিক-মানসিক বন্ধন তৈরি করতে হবে।
আমি চাইলে নিউইয়র্ক ছেড়ে অন্য অঙ্গরাজ্যে থাকতে পারতাম। কিন্তু এখানে থাকি, কারণ এই অঙ্গরাজ্যে আমার মা, বোন, চাচারা, শ্বশুরবাড়ির লোকেরা থাকে। তাদের সঙ্গে আমার নিয়মিত যোগাযোগ হয়। আমার মেয়ে বাঙালি সংস্কৃতির আবহে বড় হচ্ছে। আমার বাড়িতে ক্রিসমাসে পার্টি হলেও তাতে বাঙালিয়ানা থাকে। আমাদের পোশাক, খাবারে, গান-বাজনায় বাঙালি পরিচয়টাই ফুটে ওঠে। এই সময় আমার স্ত্রী নানা পদের পিঠা বানায়। অতিথিরাও তাদের বানানো পিঠা নিয়ে আসে। সবই গ্রাম বাংলার পিঠা পুলি।
নিউইয়র্কে থাকি বলে নাটক করা ছেড়ে দিয়েছি, এমন ভাবার কোন কারণ নেই। শিগগিরই বাংলাদেশের দীপ্ত টিভিতে আমার অভিনীত একটা মেগা সিরিয়াল আসছে। ‘নিউইয়র্ক থেকে বলছি’ নামে ধারাবাহিকটির পরিচালক রহমতউল্লাহ তুহিন। আমি ছাড়া এই ধারাবাহিকে আরও আছেন রিচি সোলাইমান, নাফিসা, তারিন, রাইসুল ইসলাম আসাদ, নওশীন, হিল্লোলসহ অনেকে। ভ্যালেন্টাইন ডে উপলক্ষে এক পর্বের একটা নাটকও প্রচারিত হবে আগামী মাসে। নাটকের নাম- ‘ওপারে তুমি’। নাটকটির শুটিং হয়েছে ম্যানহাটন, লং আইল্যান্ড সিটি, রিগো পার্ক এলাকায়।
আসলে দূরে থাকলেও শিল্পের প্রতি আমার ভালোবাসাটা এখনো তেমনই রয়ে গেছে।

অনুলিখন : মনিজা রহমান।